‘অঙ্গদানই হতে পারে শ্রেষ্ঠ এবাদত’

Comments

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজির অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল বলেন, অঙ্গদানই হতে পারে জীবনের শ্রেষ্ঠ এবাদত।

শুক্রবার, ৩০ আগষ্ট, ২০১৯, সন্ধ্যেয় ছায়ানট ভবনে মৃত্যুঞ্জয়ের “অঙ্গদান নয় জীবনদান” শিরোনামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা অঙ্গ ও দেহদান বিষয়ে অভিজ্ঞতালব্ধ বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির প্রাক্তন সভাপতি ডা. মো. আলী আসগর মোড়ল সন্ধানীর সূচনালগ্ন আলোচনায় বলেন, “১৯৭৭ সালে সন্ধানী মানব কল্যাণে কাজ শুরু করেছিল রক্তদানের মাধ্যমে। পরে ১৯৮৪ সাল থেকে চক্ষুদানের কার্যক্রম শুরু করা হয়। অদ্যাবধি প্রায় ৪ হাজার মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে পেরেছে সন্ধানী। সন্ধানীর সক্ষমতা বেড়েছে, সন্ধানীর রয়েছে নিজস্ব Eye Bank যাতে মরদেহ থেকে কর্নিয়া সংগ্রহ করে অনেকদিন পরেও তা ব্যবহার করা যায়। এখন আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে সন্ধানী অক্ষিগোলকের কোন বিকৃতি না ঘটিয়েই কর্নিয়া সংগ্রহ করতে পারে।”

Mrittunjoy06

ডা. মো. আলী আসগর মোড়ল

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “সন্ধানীতে মরণোত্তর চক্ষুদানের অঙ্গিকার করেছেন প্রায় ৪০ হাজার মানুষ, এর মাঝে অনেকের মৃত্যু হয়েছে কিন্তু আমরা তাঁর কর্নিয়া নিতে পারিনি। কারণ তাঁর উত্তরসূরি যারা আছেন তারা সন্ধানীকে মৃত্যু সংবাদটি জানাননি। তাই উত্তরসূরিদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে যাতে তারা দাতার শেষ ইচ্ছা পূরণে সহায়তা করেন।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক, বাংলাদেশে কিডনি প্রতিস্থাপনে অগ্রণী ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল তার বক্তব্যে সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, “২০১৮ সালে ‘মানবদেহে অংগ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯’ সংশোধন করে ‘মানবদেহে অংগ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ২০১৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে সে জন্যে সরকারকে ধন্যাবাদ। এতে মানবদেহে অঙ্গপ্রতিস্থাপন অনেক সহজ হয়েছে, অঙ্গদাতার ব্যাপ্তি বেড়েছে। তবে এটি আরো যুগোপযোগী করবার প্রয়োজন আছে। আশাকরি অচিরেই সরকার সে কাজটি করবে।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ১০ লক্ষাধিক কিডনি রুগী রয়েছে। ১৯৮২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ২ সহস্রাধিক রুগীর কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়েছে। কেবল্মাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন প্রতি সপ্তাহে একটি করে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। তবে এই হাসপাতালে প্রতি সপ্তাহে ৩টি করে কিডনি প্রতিস্থাপনের সক্ষমতা থাকলেও কিডনি ডোনারের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না।”

Mrittunjoy02

ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল

এ প্রসঙ্গে আলোকপাত করে তিনি বলেন, “রুগীর প্রয়োজনীয় কিডনি অন্যের সাথে ম্যাচ করা খুব সহজ নয়, সব সময় নিকটজনের কিডনি রুগীর সাথে ম্যাচ নাও করতে পারে তখন প্রয়োজনীয় কিডনি দুস্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। তখন আইনানুযায়ী প্রয়োজন হয় মরণোত্তর কিডনি প্রাপ্তির। এই কিডনি কেবল তখনই পাওয়া সম্ভব যখন লাইফ সাপোর্টে থাকা কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে অর্থাৎ চিকিৎসক যখন তাকে ‘ব্রেন ডেড’ ঘোষণা করেন। কেবল তখনই ঐ মৃত ব্যক্তির দেহ লাইফ সাপোর্টে থাকা কালে তাঁর কিডনি সংগ্রহ করে ন্যুনতম সময়ের মধ্যে তা প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।”

ডা. দুলাল বলেন, “মরণোত্তর অঙ্গ ও দেহদানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে একে আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। মানুষের মাঝে মৃত্যুর পরে অঙ্গ ও দেহদান সম্পর্কে কিছু সংস্কার রয়েছে তা দূর করবার লক্ষ্যে দেশের সুধীজন এবং ধর্মীয় নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে।”

তিনি বলেন, “মানবকল্যাণে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন হয়েছিল। সেই মানুষের কল্যাণে, যদি আমার এই নশ্বর দেহ মৃত্যুর পরে একটি মানুষের জীবন রক্ষা করে তবে এর চেয়ে বড় এবাদত আর কিই হতে পারে?”

ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল কিডনি প্রতিস্থাপন ও অঙ্গদান বিষয়ে উপস্থিত সুধীজনের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন।

Mrittunjoy03

অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব শৈশবের স্মৃতি উল্লেখ করে বলেন, “ভাইয়ের জটিল একটি রোগের কারণে প্রায়ই রক্তের প্রয়োজন হত, তখন স্বেচ্ছারক্তদাতা ছিলেন খুবই কম, রক্তদাতা পাওয়া গেলে তাঁকে আমাদের ফেরেশতা মনে হত, কেননা তাঁর কারণে ভাইয়ের জীবন বাঁচানো গেল। আর জীবনের এ অভিজ্ঞতাই আমায় তখন রক্তদানে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং দীর্ঘদিন ধরেই আমি রক্তদাতা। সম্প্রতি মৃত্যুঞ্জয়ের এ আন্দোলনের সংবাদ পাবার পর থেকেই আমার মনে হয়েছে যে আমার মৃত্যুর পরেও যদি আমার কোন অঙ্গ কোন মৃত্যু পথ যাত্রীর জীবন রক্ষা করতে পারে তা হলে কেন আমি আমার মরণোত্তর অঙ্গদান করবো না।”

অধ্যাপক তাসনীম আরও বলেন, “আমি ধর্মভিরু মানুষ, তাই এ বিষয়ে ধর্মীয় দিক বিবেচনায় কিছু পড়াশুনা করা শুরু করি। তা থেকে আমি যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে আমার ধর্মে এ সম্পর্কে কোন বাধা আছে বলে আমার মনে হয়নি।”

বাংলাদেশের বৃহত্তম বার্ন হাসপাতাল ‘শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাষ্টিক সার্জারী ইন্সটিটিউট’ এর সহযোগী অধ্যাপক বার্ন ও প্লাষ্টিক সার্জন ডা. তানভীর আহমদ বলেন, “বিভিন্ন কারণে দেশে বার্ন রুগীর তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এ বিষয় বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছায় ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট ‘শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাষ্টিক সার্জারী ইন্সটিটিউট’ কাজ শুরু করেছে। এই হাসপাতালে বার্ন রুগীর সর্বোচ্চ চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমাদের সম্পূর্ণ সক্ষমতা রয়েছে।”

তিনি বলেন, “একজন বার্ন রুগীর সুস্থ হওয়া নির্ভর করে তার ক্ষতস্থান ইনফেকশন বা সংক্রমণ মুক্ত রাখার উপর। যা সহজ হয় মানুষের ত্বক বা চর্ম ব্যবহার করে। এখনও আমরা রুগীর সুস্থ স্থানের ত্বক সংগ্রহ করে তা করবার চেষ্টা করি। কিন্তু তা সব সময় সম্ভবও হয় না কেননা রুগীর বার্ন যদি বেশী হয় তবে তার নিজের ত্বক পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ ব্যান্ডেজের মাধ্যমে করতে হয় যার ফল খুব ভাল হয় না।”

Mrittunjoy04

ডা. তানভীর আহমেদ

তিনি বলেন, “মরণোত্তর দেহদানের মাধ্যমে আমরা মানবদেহের ত্বক বা চর্ম সংগ্রহ করতে পারি। কিছুদিনের মধ্যেই ‘শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাষ্টিক সার্জারী ইন্সটিটিউট’ এ চর্ম ব্যাংক কাজ শুরু করছে, অর্থাৎ আমরা ত্বক সংরক্ষণের সক্ষমতা অর্জন করতে যাচ্ছি। এ অবস্থায় মরণোত্তর দেহদানের আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে। মৃত ব্যক্তির ত্বক যদি আমরা না পাই তাহলে আমাদের সমস্ত সক্ষমতা থাকা সত্বেও আমরা সর্বোচ্চ চিকিৎসাদানে অক্ষম হয়ে যাব।”

ডা. তানভীর এ আন্দোলনে সকলের এগিয়ে আসার উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, “সমাজের জ্ঞানীগুণী, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা এবং গণমাধ্যমের এই আন্দোলনে এগিয়ে আসা খুবই জরুরী। সমাজের অগ্রগামী মানুষেরাই পারেন সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে।”

মৃত্যুঞ্জয়ের আহ্বায়ক, প্রবীণ সাংবাদিক ও সংস্কৃতিজন কামাল লোহানী অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তব্যে সকলের প্রতি এ আন্দোলনে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বুলেন, “মৃত্যুর পর আমাদের এই দেহটি যদি মানবতার সামান্য কল্যাণে লাগাবার সুযোগ থাকে তবে কেন অপরের জীবন রক্ষার সে সুযোগ আমরা নেব না? আমার মৃত্যুর পরে আমার দেহদান করেছি এবং আমার উত্তরসূরীরা তাতে সম্মতি দিয়েছে কারণ তারা আমার একাজে গর্ববোধ করছে।”

কামাল লোহানী বলেন, “আমি সকলের প্রতি আহ্বান জানাই, আপনিও আপনার উত্তরসূরীকে সে গর্বের অংশীদার করুন। নশ্বর দেহ এবং এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মাটিতে মিশিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে, পোকামাকড়ের খাদ্যে পরিণত না করে তা অন্যের জীবন রক্ষায়, মানব আর মানবতার কল্যাণে দান করে যান।”

Mrittunjoy05

সংস্কৃতিজন কামাল লোহানী

তিনি মৃত্যুঞ্জয়ের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, আমরা শুধু আলোচনা, পোষ্টার, ফেষ্টুন, ব্যানার প্রকাশেই আমাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। এ আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে অঙ্গপাচার ও অঙ্গদান বিষয়ে সচেতনতামূলক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ ও  অঙ্গদান ও অঙ্গপ্রতিস্থাপন বিষয়ে একটি ইন্টার অ্যাকটিভ ওয়েবসাইট নির্মাণেও কাজ করছি। এতে করে অঙ্গদান ও অঙ্গপ্রতিস্থাপনে সচেতনতা বৃদ্ধি ও অঙ্গদাতা, গ্রহিতা, প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি সহজ যোগাযোগ প্রক্রিয়া তৈরী করা সম্ভব হবে।

কামাল লোহানী মৃত্যুঞ্জয়ের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গণমাধ্যমসহ সকল মহলের সহযোগিতা কামনা করেন।

অনুষ্ঠানে চক্ষুদান ও অঙ্গদান সম্পর্কিত দুটি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেকে দেহ ও অঙ্গদানের প্রতিশ্রুতি বা ইচ্ছাপত্র পূরণ করেন। পরবর্তী যে কোন প্রয়োজনে যে কেউ মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে মোবাইল ০১৮১৯২০০৭৪৩ বা ইমেল [email protected] যোগাযোগ করবার অনুরোধ জানানো হয় অনুষ্ঠানে।

এ আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের অন্যতম কমান্ডার, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. হারুন-অর-রশীদ, বীর প্রতীক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক ডা. খন্দকার মানজারে শামীম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিটের ইন চার্জ অধ্যাপক ডা. মোজাফফর হোসেন, মৃত্যুঞ্জয়ের আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইনসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মরণোত্তর দেহ ও অঙ্গদান বিষয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস থেকে কাজ শুরু করে “মৃত্যুঞ্জয়”। ইতঃমধ্যে এই সামাজিক সংগঠনটি দেশের প্রখ্যাত ব্যক্তিসহ অর্ধশতাধিক মানুষ মরণোত্তর দেহ ও অঙ্গদান সংক্রান্ত অঙ্গীকারনামা সম্পন্ন করেছে এবং আরও অনেকের অঙ্গীকারনামা প্রস্তুতি প্রক্রিয়ায় রয়েছে। “মৃত্যুঞ্জয়” ২০১৪র ডিসেম্বরে দেশের অন্যতম কবি সাংবাদিক অরুণাভ সরকারের প্রয়াণ পরবর্তী দেহ ও চক্ষুদান প্রক্রিয়াটি সুসম্পন্ন করে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্তরে সাধারণ মানুষের মাঝে মরণোত্তর দেহ ও অঙ্গদান বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়।

বাঙালীয়ানা/এসএল

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.