বাংলা সঙ্গীত জগতের প্রবাদপুরুষ সলিল চৌধুরী। মানুষের জীবনের সুহৃদ, জীবনযুদ্ধের আজম্ম সৈনিক, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নির্ভীক লড়াকু-বীর, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আপোষহীন এই সংগ্রামী শিল্পী তার প্রিয় জনগণের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জীবনের পালা গেয়েছেন মানুষের মঞ্চে, মাঠে, ময়দানে। তিনি যে অসংখ্য গণসঈীত সৃষ্টি করে গেছেন, তার আবেদন চিরন্তন। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশের বাংলাভাষাভাষী মানুষ, যখন ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন তখন তার প্রয়োজন দেখা দেয় সাংস্কৃতিক হাতিয়ার হিসেবে। তিনি রাজনৈতিক চৈতন্যবোধে ছিলেন গণমানুষের একজন, তাই তার গানে ধ্বনিত হতো-হবে ভবিষ্যতেও প্রিয় জনগণের কথা। সমাজ পরিবর্তনের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের একজন পোড় খাওয়া সৈনিক সলিল চৌধরী শুধু সুর করতেন না; তিনি তার রচিত অধিকাংশ গান নিজের রচনা করেছেন। সুরকার সলিল চৌধুরী গায়কও ছিলেন। এমনও ঘটনা আছে যে, তিনি তারই সুরারোপিত অভূতপূর্ব সৃষ্টি ‘আজি বাংলার বুকে দারুণ হাহাকার’ গানটি গেয়ে জলপাইগুড়ির বিশাল জনসমুদ্রকে উত্তাল করে তুলেছিলেন কান্নায়। আবার সেই গানেরই দ্বিতীয় অন্তরায় ক্রন্দনরত মানুষকেই মুষ্টিবদ্ধ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সৈনিক হিসেবে শপথ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এমনই এক যুগস্রষ্টা সঙ্গীতসাধক ছিলেন গণমানুষের প্রাণের আত্মীয় সলিল চৌধুরী।
তিনি কবিতা লিখতেন। তার কবিতা নিষিদ্ধও হয়েছে, গ্রেফতারী পরোয়ানা এড়িয়ে তাকে চলতে হয়েছে কত না দিন! তিনি গল্পকারও বটে। এই বাংলাদেশে অথবা সেই পূর্ব পাকিস্তান সরকার বিরোধী জনগণের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মীদের যে অবদান, তার সাথে শিল্পী সুরকার সংগ্রামী সংগঠক সলিল চৌধুরীর একটা লড়াকু সস্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাইতো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং পরে তার উপস্থিতি আমাদের সকল সংগ্রামেই। চট্টগ্রামের অচিন্ত্য চক্রবর্তী, হরিপ্রসন্ন পাল, ঢাকায় শেখ লুৎফর রহমান, কুমিল্লার সুখেন্দু চক্রবর্তী, বরিশালের আলতাফ মাহামুদ, রংপুরের অজিত রায়, বগুড়ার নিজামুল হক, নাটোরের গোপাল সরখেল, নওগাঁর মোমিনুল হক প্রমুখ ভারতীয় গণনাট্যসংঘের অভূতপূর্ব দৃপ্ত অঙ্গীকারে উদ্বুদ্ধ সঙ্গীতের প্রভাবে আপ্লূত হয়েছিলেন। তাদের নিজ রচনা ও সুর সংযোজনার সাথে জোতিরিন্দ্র মৈত্র, সলিল চৌধুরী, প্রেম ধবন, পারভেজ শাহেদী, ওমর শেখ, পরেশ ধর প্রমুখ শ্রদ্ধেয় শিল্পী-সুরকারদের গান বাংলার পথে প্রান্তরে, শহরে-বন্দরে জনসমাবেশে, মিলনায়তনের অনুষ্ঠানে প্রায়শই গীত হতো এবং এর মধ্যে বহু গানই অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। যে কারণে আইপিটিএ অর্থাৎ ভারতীয় গণনাট্য সংঘের গান এবং সলিল চৌধুরী এদেশের কবি সাহিত্যক শিল্পী, সুরকার, সাংবাদিক, পেশাজীবী সকল মানুষের কাছে প্রিয়তম নাম। এদেশকে ঔপনিবেশিক শাসনের নিগড় থেকে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে দীর্ঘ তেইশ বছরের পাকিস্তানী শোষণের বিরোধিতা করেছেন সলিল চৌধুরী তার গানের ভিতর দিয়ে। তার গান আমাদের রাজনৈতিক চিন্তাকে শাণিত করতে সাহায্য করেছে প্রতিনিয়ত।
আরও পড়ুন
সলিল চৌধুরী: গানের দূরন্ত ঘূর্ণির জাদুকর
সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে আমিও গত ৬০ বছর ধরে তাকে আর উৎপল দত্তকেই অনুসরণ করেছি। এদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসাবে যখনই কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রয়োজন হয়েছে, তখনই ধর্না দিয়েছি রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুল, সুকান্ত, ইকবাল এর কাছে; কিন্তু সলিল চৌধুরীর সুর ও গণসঙ্গীত আমাদের চিত্তকে নাড়া দিয়েছে বিপুল বৈভবে। জনতার সাগরে জেগেছে উর্মি উন্মাতাল, তার সুরে কাব্যের কঠোর হাতুড়ি হেনে নজরুল-সুকান্ত যে রচনা সৃষ্টি করেছেন প্রলয়ংকরী গানে, সলিল চৌধুরী তারই উত্তরসূরী হিসেবে জীবনবাদী গান ও সুর রচনা করে মানুষকে কাস্তে ধরা কড়া হাতে অত্যাচারকে রুখবার সাহস দিয়েছেন। মানবপ্রেমের বেশ ধরে আবির্ভূত শোষকগোষ্ঠীর লোভাতুর পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে কথা বলে সলিল চৌধুরীর কবিতা ও গান। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে শাসক-শোষকের রূপ, তার শ্রেণী-চরিত্র এবং উদ্বুদ্ধ করেছে মানুষকে প্রতিরোধের পাহাড় গড়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবার জন্য। হিন্দি গানের জগতেও সলিল চৌধুরী এক নবধারার সংযোজন করেছেন। বোম্বের চিত্রজগৎকে পঞ্চাশের দশকে টালমাটাল করে তুলেছিল তার সুর। দাপটের সাথে সৃজন প্রতিভার উজ্জ্বল প্রভা বিচ্ছূরিত হয়েছে টানা তিন দশক ধরে। কিন্তু এতসব জেল্লার ভেতর সোঁদা মাটির গন্ধ, জীর্ণশীর্ণ মানুষের জীবনগাথা এবং তার পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনীতির বিশ্বাসকে তিনি হারাননি। মানুষের উপর আস্থা হারাননি কোনোদিন। তাই বার বার ফিরে এসেছেন মাটির টানে, নিজের দেশের মাটিতে। মানুষের জন্য লড়াই করার প্রয়োজনে মাঠে নেমেছেন।
সলিল চৌধুরী শান্তির জন্য গান গেয়েছেন, তাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তার কন্ঠ। তিনি তেভাগা আন্দোলনের গান লিখেছেন, ফ্যাসিস্ট চক্রান্তকে উন্মোচন করেছেন সুরে সুরে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে রুখে দেবার ধ্বনি অনুরণিত হয়েছে তার গানে। দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে মুনাফাখোর-মজুতদারকে চিহিৃত করেছেন সলিল চৌধুরী। আবার অধিকার কেড়ে নিতে হয়, অধিকার লড়ে নিতে হয়- একথা তারই কলমে উৎসারিত হয়েছে। সলিল চৌধুরীর ‘কৃষ্ণকলি’র গান শুনেছিলাম ১৯৫৬ সালে, যুবলীগের এক সম্মেলনে। পুরনো ঢাকার কারকুন বাড়ি লেনের দেয়াল-ঘেরা এক চত্বরে। গাইছিলেন সেদিনের তরুণ গায়ক আলতাফ মাহমুদ দরদী গলায়। গানটির কথাগুলো এমন ছিল-
হয়তো তারে দেখিনি কেউ
কিম্বা দেখেছিল
ছিন্নশত আঁচল ঢেকে জীর্ণ দেহখানি
ক্লান্ত পায়ে পায়ে যেতে পথে
কি জানি কি ঝড়ে
গেছে বুঝি ঝ’রে
জীবনের তরু থেকে-
তখন গগন ছড়ায় আগুন দারুণ তেজে
সেই মেয়ে
দুটি শীর্ণ বাহু তুলে
ও সে ক্ষুধার জ্বলে জ্বলে;
অন্ন মেগে মেগে ফেরে প্রসাদ পানে চেয়ে।
গায়ক, গীতিকার, সুরকার সলিল চৌধুরী মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তার আদর্শকে সামনে রেখেই তিনি দীর্ঘদিন কাজ করে গেছেন সঙ্গীতের মাধ্যমে। অহরহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন নতুনত্বের সন্ধানে। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সাথে আপোষ না করে তিনি সখ্যতা পাতিয়েছেন। আর নিজের দেশের লোকজ সুরকে সংমিশ্রণ করে আধুনিকতার ছোঁয়ায় তাকে মহিমান্বিত করেছেন তিনি। গণসঙ্গীতের সুর মূর্ছনায় যে বর্ণাঢ্য স্বরমালা বলিষ্ঠরূপে প্রকাশ করেছেন বিচিত্র ঢংয়ে তার কোন তুলনা নেই। সংগ্রাম, জীবনযুদ্ধ, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গান তিনি অজস্র লিখেছেন এবং সুরও করেছেন। এখানে বেশকিছু গান প্রভাবিত হয়েছে বিদেশী সংগ্রামী সুরে। কিন্তু তার স্বকীয়তা সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। তিনি আত্মসমর্পণ না করে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন কর্মদক্ষতার মাধ্যমে, মেধা দিয়ে। পরিশ্রম করে নতুন কিছু সৃষ্টির আনন্দে সদা উন্মাতাল ছিলেন তিনি ।
সলিল চৌধুরী বোম্বে চলচ্চিত্র জগতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কয়েক দশক প্রতাপের সাথে কাজ করেছেন। এমন সময় ছিল, যখন সলিল চৌধুরী ছাড়া লতা মুঙ্গেশকর ও হেমন্ত মু্খোপাধ্যায়- এঁদের কোন গানই রেকর্ড করা হতো না। বহু জনপ্রিয় সঙ্গীতের সুরস্রষ্টা হিসেবে হিন্দী ফিল্ম জগতে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন তিনি। আশির দশকেই তিনি পুরোপুরি ফিরে এসেছেন। বাংলায় ফিরেই কলকাতায় এক অত্যাধুনিক বিরাট রেকর্ডিং স্টুডিও গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেন এবং শেষ করেও গেছেন। সলিল চৌধুরী বাংলার মাটিতে ফিরেই রাজনীতির সাথে তার সম্পর্ককে আরো জোরদার করেছিলেন। এই সময়টায় কিছু নির্বাচনী গান রচনা ও সুর করেছেন। কিন্তু ‘এ্যাই রোকো পৃথিবীর গাড়ীটা থামাও’ এবং ‘ও মাগো মা অন্য কিছু গল্প বলো’ এ ধরনের কাহিনীমূলক গানও সৃষ্টি করে এটাও প্রমাণ করেছিলেন যে সলিল চৌধুরী বদ্ধ জলাভূমি নয়, উর্বর পলি ফেলা বহতা নদী। সলিল চৌধুরী অর্কেস্ট্রেশনে জৌলুস পয়দা করেছিলেন। নানা ধরনের যন্ত্রকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা দিয়ে ব্যবহার করে সুরের যাদু দেখিয়েছেন সলিল চৌধুরী। তিনি ছিলেন গানের রাজা, সুরের যাদুকর। যতদিন বাংলা ঢোলে চাঁটি পড়বে, বাঁশীতে ফুঁক থাকবে, বেহালায় বাজবে ধুন, সেতারে উঠবে ঝঙ্কার-মানুষের মনে যতদিন ক্ষোভ থাকবে রাজপথ যতদিন মিছিলে মুখরিত হবে, ততদিন সংগ্রামের সাথী হয়ে সলিল চৌধুরী আমাদেরই মাঝে থাকবেন।
লেখক: কামাল লোহানী
ভাষা সংগ্রামী, শব্দসৈনিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব