করোনা ভাইরাস সংক্রমিত রোগ কোভিড-১৯-এর বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় আজ গোটা বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে। এই মহামারির উচ্চ ঝুঁকির তালিকার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ২৫ নম্বরে। ইতিমধ্যেই আক্রান্ত সংখ্যা ২৫০০ ছুঁই ছুঁই। আর মৃত্যুর সংখ্যা সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে ডাবল সেঞ্চুরির পথে।
পৃথিবীর সুস্বাস্থ্যের জন্য করোনার ধাক্কায় মৃত্যুর সংখ্যা ইতিমধ্যেই দাবানলের মত ছাড়িয়েছে। পৃথিবীর ১৯৫ দেশের কেউই ছাড় পায়নি এই সংক্রমণের হাত থেকে। ২৩ লক্ষেরও বেশী মানুষ আক্রান্ত। কিন্তু এর ভয়াবহতা এখানেই শেষ নয়। পৃথিবীর ১২১ দেশে যাতায়াত বন্ধ হয়েছে সংক্রমণ ঠেকাতে। শুধুমাত্র দেশ থেকে দেশান্তরে যাওয়াই নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগও প্রায় বন্ধ এই বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে।
ফল – বিশ্বজুড়ে কয়েক লক্ষ কোটি শ্রমদিবস নষ্ট, উৎপাদন প্রায় স্তব্ধ। এর অর্থ এক কথায় – থমকে দাঁড়িয়ে গেছে বিশ্ব অর্থনীতির। বার্ষিক গতি বা আহ্নিক গতি প্রকৃতির নিয়মে অব্যাহত থাকলেও, মানুষের নিয়মে তৈরী উৎপাদন-পরিষেবার ব্যবস্থা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে সর্বত্র – প্রবল পরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাক লাগানো চীন-কোরিয়া।
এত বৈভব-পরাক্রম -শক্তির আস্ফালন চুপসে গেছে খালি চোখে দেখা যায়না এমন একটি ভাইরাসের আক্রমণে। করোনা পরবর্তী অধ্যায়ও এক কঠিন হিমশীতল সময়। অর্থনীতি চাঙ্গা হতে কত সময় লাগবে – নামীদামি অর্থনীতিবিদরাও হলফ করে বলতে পারছে না।
বাংলাদেশ বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশাল এক ক্ষতির সম্মুখীন। সেটা আমরা পরিবহন খাতে দৃষ্টি দিলেই বুঝাতে পারি। “প্রতিদিন ৫’শ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে বলে দাবি পরিবহন সংশ্লিষ্টদের”। করোনার ভয়াবহতা দেশে যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তা এমন একটি খবর দিয়েই ধারণা করা যায়, “করোনার ভয়ে হয়নি দাফন, নৌকায় ভাসছে অন্তঃসত্ত্বা গার্মেন্টস কর্মীর লাশ”!
এমতাবস্থায় আমরা কেউ ঠিক বলে উঠতে পারছি না যে ভবিষ্যতে কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। তবে অবশ্যই কল্পনা করা যায় যে, হয়তো আর বেশিদিন সময় লাগবে না শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সেই বিখ্যাত চিত্রের ‘দুর্ভিক্ষ’ এর রূপরেখা ফোটে উঠবে দেশে। গল্প উপন্যাস ইতিহাস জ্বলন্ত সাক্ষী যে আমাদের অঞ্চলের লোকেরা ক্ষুধার কষ্ট কি করে সয়ে এসেছে। এই কষ্ট হাজার বছরের পুরানো। তাই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছেন, “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”।
দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মহামারি করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) এর সংক্রমণ ও ব্যাপকভাবে বিস্তারে পুরো দেশ আজ ভয়াবহ অবস্থায়। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় গুলো অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম একটি ভয়ানক চ্যালেঞ্জিং বিষয়।
আমি লেখাটি লেখার সময় বিভিন্ন মহল তথা বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা মাধ্যমে সেখান থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপাত্ত ও মন্তব্যের উপর ভিত্তি করে, শুধু যে সমস্যাই ফুটে উঠেছে এমনটি নয়, সমস্যার সমাধান হিসেবে বেশ কিছু সুপারিশ কতৃপক্ষ তথা সরকারের নিকট তুলে ধরতে চাই। এটাই মূখ্য উদ্দেশ্য।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর সেই বিখ্যাত কবিতা ‘খোকার সাধ’ এর লাইন মনে পড়ে যায়, “হয়নি সকাল- তাই বলে কি সকাল হবে না ক! আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?”
ঢাকা শহরের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আসেন ঢাকা শহরের বাইরে থেকে।
প্রথমত,
বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আসেন একদম মফস্বল শহর ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। এটা আমরা সবাই জানি। আর দেশের এমন একটি মহামারি অবস্থায় মধ্যবিত্ত অনেকেরই আয়ের পথ খোলা নেই। এই যে মধ্যবিত্ত সমাজের যে ধাক্কা। এতে অনেকেই সামর্থ্যের দিক থেকে বড় ধরনের ধাক্কা সামলাচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত,
ঢাকা শহরের বাইরে যারা বর্তমানে অবস্থান করছেন তারা অনেকেই ইন্টারনেট পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। হয়তো যারা জেলা সদর গুলো তে অবস্থান করছেন তারা কিছুটা পাচ্ছেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেকেই বঞ্চিত।
তৃতীয়ত,
অনেকেই হয়তো ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে অনলাইনে বিদ্যমান পাঠ্যক্রম এর উপস্থিত হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারন আর্থিক আয়ের পথ যেখানে বন্ধ। সেক্ষেত্রে খাওয়ার উপযুক্ত চাল বাজারে এখন মোটা চালের কেজি ৩৮ থেকে ৫০ টাকা, যা গত মাসে ৩৫ থেকে ৩৮ টাকার মধ্যে ছিল। এটা এখন আরো একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি প্রায়।
চতুর্থত,
যারা হয়তো ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে পারছেন। তবে দেশের নেটওয়ার্ক সার্ভিস এর সমস্যার কারণে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারছেন না।
এমন আরো অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের।
এই বিষয়ে কথা বলার জন্য, বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান স্যার এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তাঁর মূল্যবান মতামত প্রদান করেন। সেই আলোচনাটি সাক্ষাৎকারের রূপে এখানে তুলে ধরছি।
রঞ্জন: স্যার সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা ও মেধাবী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের অবস্থা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
ড. মিজান: শোনো রঞ্জন, অনলাইনে শিক্ষা তখনই হয় বা করা উচিত যখন প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর সেই সুযোগ আছে, অনলাইন ব্যবহারের এক্সেস আছে। যদি কারো এক্সেস না থাকে। তবে এটি চরম বৈষম্যমূলক একটি ব্যবস্থা যেটা কখনো একটি গনতন্ত্র রাষ্ট্রে বা কোন সভ্য সমাজে গৃহীত হতে পারে না। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সমান সুযোগ, সেই সমান সুযোগের স্থানটি যদি নষ্ট করে ফেলা হয়। তবে সেই ধরনের কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত বলে অন্ততপক্ষে আমার কাছে মনে হয় না। আমার মনে হয় না এটা কোন উওম কার্যক্রম। পড়াশোনা বন্ধ হয়েছে এটা ঠিক। এটা পরবর্তীতে কিভাবে কাঁটিয়ে নিতে পাড়ব এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা জাতি অবশ্যই করতে পারে। কিন্তু যারা দরিদ্র, মধ্যবিত্ত যাদের ল্যাপটপ বা ব্যবহার উপযোগী ডিভাইস নেই, ইন্টারনেট নেই, গ্রামে বসে যারা ইন্টারনেট এক্সেস করতে পারবে না। অনলাইন পাঠদান এ অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তাদেরকে বাদ দিয়ে, শুধুমাত্র যাদের এসমস্ত সুবিধা আছে তাদেরকে নিয়ে ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনা করা, তারা যদি ৫০ শতাংশের বেশিও হয়, এমনকি ৭০ শতাংশের বেশি বা ৮০ শতাংশেও হয় তাহলেও কখনই উচিৎ নয়। কেননা ঐ সমস্ত সুবিধা যাদের নেই তারা যদি ২০ শতাংশও হয় তবুও রাষ্ট্র তাদের উপেক্ষা করতে পারে না, শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের উপেক্ষা করতে পারে না। যখনই তারা শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়েছে তখনই সকল শিক্ষার্থী সমান সুযোগ নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদের। এই কাজটি তাদের করতেই হবে।
রঞ্জন: এই মহামারির প্রকোপে শিক্ষা বিষয়ে সরকারের ভূমিকা বা কি দায়-দায়িত্ব নিতে পারে বলে মনে করছেন?
ড. মিজান: এমন একটা পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাচ্ছে। এটা যে খুবই বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে বিষয়টি এমন মনে হচ্ছে না। আমার যেটা মনে হচ্ছে, যখন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলে। সেই পুরো শিক্ষা বছরটা কিন্তু আমরা নষ্ট করেছি। তা কিন্তু দেশ স্বাধীনের পরবর্তীতে পরীক্ষা গ্রহণ, কম নম্বরে পরীক্ষা, বিষয় কমিয়ে দিয়ে সাথে বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে রাষ্ট্র কিন্তু সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সুতরাং, এগুলো যে পুষিয়ে নেয়া যায় না তা নয়। এমন ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে, যেনো কেউ যেন মনে না করে তাকে বা তাদের কে বাদ দিয়ে, তাদের কে পরিত্যাগ করে রাষ্ট্র একটা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এটা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। সেই বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।
চূড়ান্তভাবে কিন্তু সব কিছুই সরকারি হোক বা বেসরকারি, সব ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থাই সরকারের অধীনে। বিশ্ববিদ্যালয় তো আর সরকারের অনুমতি ছাড়া কোন কাজ করতে পারে না। আর কোন ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমও পরিচালনা করতে পারে না। সরকারের কোন নির্দেশনা অমান্য করে তো তারা চলতে পারে না। সুতরাং, এখানে সরকারের সিদ্ধান্তের অবশ্যই একটা গুরুত্ব আছে। যেহেতু সব ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের তদারকি করার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সেহেতু ইউজিসি’র এইসব বিষয়ে খুব গভীর ভাবে পর্যালোচনা করা দরকার। আমরা মনে করি ইউজিসি‘র সিদ্ধান্তের ভিতরে সরকারের একটা চিন্তা চেতনার প্রতিফলন ঘটে। যদি ইউজিসি বলে, কোন বিশ্ববিদ্যালয় এই মূহুর্তে অনলাইন পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। তবে হোক সেটা সরকারি কিংবা বেসরকারি। তারা যদি ইউজিসি‘র সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাহলে সেটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধ আচরণ হবে, তারা একটি অপরাধ করছে বলে সেটা গণ্য হবে।
রঞ্জন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ভাতা প্রসঙ্গে আপনার কি মতামত?
ড. মিজান: শোনো আমি বলি, বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলো প্রধানতই পরিণত হয়ে গেছে ব্যবসায়ীক ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে। একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকে অলাভজনক। আমাদের দেশে যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালক বা ডিরেক্টর আছেন, তারা নানা কৌশলে বিশাল অঙ্কের টাকা পকেটে পুড়ে নেন। এইভাবেই তারা অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করেছেন এবং এভাবেই ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। এই যে লাভজনক, এত বছর ধরে লাভ করে আসছেন। একটা বছর না হয় তারা লাভ না করুক, এই এত বছরের লাভের একটা অংশ না হয় তারা ফিরিয়ে দিক। সুতরাং, শুধু যে ধনীর মাথায় তেল দিয়ে চলতে হবে এটা অন্তত বন্ধ হোক।
করোনা ভাইরাস অনন্ত একটা জিনিস দেখিয়ে দিয়েছে যে কত বৈষম্যপূর্ন অবস্থা আমাদের। আমাদের বাংলাদেশের মত অবস্থায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা (চিকিৎসা সেবা) এখন মৌলিক অধিকার হওয়া উচিত। অনন্ত এই উপলব্ধি তো সবার মাথায় এখন আশার কথা। অনেক হয়েছে, আমাদের এখন সবকিছু বিধিসম্মত করতে হবে। অনন্ত স্বাস্থ্যখাতটাকে রাষ্ট্র খাতে নিতে হবে। এখানে ব্যাক্তি মালিকাধীন বেসরকারি হাসপাতালের মালিকরা হাসপাতাল করে ইচ্ছে মত বন্ধ রাখবে, ইচ্ছে মত খোলা রাখবে। ইচ্ছে হলে আমি যাবো, যাবো না। এই রোগীর চিকিৎসা দিবো, এই রোগীর চিকিৎসা দিবো না। একটা রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাত এইভাবে পরিচালিত হতে পারে না। এবারও যদি এটা আমরা বুঝে না থাকি, তাহলে যে কবে আর বুঝবো আমরা!
রঞ্জন: স্যার আপনি কি মনে করছেন, এই মুহূর্তে কোনটা বেশি প্রয়োজন! খাদ্য নাকি শিক্ষা?
ড. মিজান: শোনো, আমি তোমাকে আগেই বলেছি, এখনো বলছি শিক্ষাটা কে আমি এখন মূখ্য সমস্যা মনে করি না। এখন মূখ্য হচ্ছে যে আমাদের সবাই এর টিকে থাকা, বেঁচে থাকা এবং করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্ত হওয়া, করোনাকে বিতাড়িত করা ও জয়ী হওয়া। করোনামুক্ত যদি হতে পারি তাহলে এই যে সময় বা শিক্ষার যে সময় নষ্ট হবে সেটা পুষিয়ে নেওয়া অসম্ভব কিছু নয়; এটা সম্ভব।
কিন্তু সময় আমি নষ্ট করবো না, ক্লাস আমি নিবোই। যারা দরিদ্র, যাদের ইন্টারনেট এক্সেস নেই, ডিভাইস ব্যবহারের সুবিধা নেই। তাদের বাদ দিয়েই, আমরা মেজরিটি দিয়েই হবে। একটা ক্লাসের ভিতরে ৫০ জনের ভিতরে ১০ জন বা ৫ জন ছাত্র-ছাত্রী দরিদ্র হতে পারে। আগে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কে সুবিধা করে দিক, তাদের কে দিক একটা করে ল্যাপটপ বা কোন ডিভাইস, তাদের কে দিক ইন্টারনেটর সুবিধা। যে আমরা বহন করছি সব। তোমরা ক্লাস করো। হ্যাঁ, তখন হতে পারে। সবার ক্ষেত্রে সুবিধা যদি বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চিত করতে পারে। তাহলে অবশ্যই সম্ভব।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কি পাড়বে সবাইকে একটা করে ল্যাপটপ বা কোন ডিভাইস দিয়ে ইন্টারনেটর সুবিধা দিতে? না, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ক্ষমতা নেই। এখানে অধিকাংশ মেধাবী শিক্ষার্থীই নিম্ন বা মধ্যবিত্ত। যেহেতু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই সকলকে সে সুযোগ করে দিতে পারবে না সেহেতু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই বলছে না যে তারা অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যা পারে না, সেটা শুধু মাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে অর্থের দাপটে বা যাদের অর্থ আছে, যাদের বিত্ত আছে তারা শুধু মাত্র এই সুযোগ সুবিধা পাবে তা হয় না।
তবে আমার বিশ্বাস ইউজিসি‘র যিনি বর্তমান চেয়ারম্যান তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সারাটা জীবন কাটিয়েছেন। উনি অন্ততপক্ষে বুঝবেন যে শিক্ষা ব্যবস্থার ভিতরে এই ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ তিনি করতে পারেন না। তাঁর হাত দিয়ে এমন বৈষম্যমূলক আচরণ হতে পারে না বলে আমার বিশ্বাস।
রঞ্জন: একটি অভিযোগ উঠেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) নির্দেশনা অমান্য করে অনলাইনে পরীক্ষা ও খাতা মূল্যায়নের, নতুন সেমিস্টার শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছে বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিষয়টি কিভাবে দেখছেন আপনি?
ড. মিজান: এই সিদ্ধান্ত গুলো কিভাবে নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ তা আমি জানি না। সেটা ইউজিসি নিষেধ করে নাই এই কারণে নাকি আমি বলতে পারবো না। যদি ইউজিসি নিষেধ করে থাকে। তাহলে কোন অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষা হতে পারে না। যদি হয়ে থাকে সেটা ইউজিসি‘র নির্দেশনা অমান্য করে হচ্ছে এবং সেটা একটা অপরাধ করছে তারা। ইউজিসি নিশ্চিত এই বিষয়ে পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যদি সত্যি এমন কার্যক্রম পরিচালনা হয় ইউজিসি‘র নির্দেশনা অমান্য করে। তবে আমি এখনই বলে দিতে পারি যে অনলাইন ভিত্তিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা হবে সেগুলো বাতিল ঘোষণা করবে ইউজিসি। এইসব গ্রহণযোগ্য হবে না।
রঞ্জন: আচ্ছা স্যার অনলাইনে পাঠদান এর মধ্যে যে শিক্ষার্থীদের উপস্থিত মেজরিটি ও মাইনরিটির একটা প্রশ্ন থাকে। এই বিষয়ে কি মতামত?
ড. মিজান: এখানে মেজরিটি ও মাইনরিটি প্রশ্ন নয়। যখন মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন আসে তখন কিন্তু মেজরিটি ও মাইনরিটি নিয়ে কথা নয়। একজনও যদি থাকে যে তার উপর এটা বৈষম্যমূলক প্রভাব পড়বে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা সকলের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য হতে হবে। তাহলেই এটি গ্রহণযোগ্যতা পাবে শুধু মাত্র, নয়তো বা নয়।
ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে অনলাইন ক্লাস করার সুযোগ বা সুবিধা অনেকেরই নেই। তার কারণ যেমন একদিকে অর্থ সংকট, অপরদিকে তেমনি ইন্টারনেট সংযোগের বা সার্ভিস ব্যবস্থা নানাবিধ সমস্যা। এইসব প্রেক্ষাপট সবই গভীর ভাবে বিবেচনার মত বিষয়।
‘ইউজিসি’ নতুন শিক্ষার্থীদের ভর্তি নেওয়া ও অনলাইন পাঠদান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে ভবিষ্যত নির্দেশনা অবশ্যই ইউজিসি‘র বিবেচনার উপর সব নির্ভর করছে। কিন্তু তার মানে এই নয়, অন্য সময়ের যেমন প্রতিনিয়ত ক্লাস, পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন কতৃপক্ষ। সেই নিয়মে এখন অনলাইনের সহযোগিতায় এটা চালিয়ে নেবে। যদি এমন হয় তবে প্রশ্ন থেকেই যায় এই পাঠদান কতটুকু যৌক্তিক। সুতরাং, যদি তারা এই কার্যক্রম শুধুমাত্র টাকা আদায় করার উদ্দেশ্যে শুরু করেন। তবে বিষয়টি অবশ্যই সঠিক বা মানবিক হবে না।
কতৃপক্ষের অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে, মধ্যবিত্তদের মধ্যে দুই শ্রেণীর শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। সেই ক্ষেত্রে যাদের অসুবিধা তাদেরকে ভিন্ন ভাবে বিবেচনা করতে হবে। যারা অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তির টাকায় বা নিজে টিউশনি করে পড়ালেখা করেন। হয়তো দেশের এমন একটি মহামারি অবস্থায় মধ্যবিত্ত অনেকেই আয়ের পথ বন্ধ, টিউশনি করে উপার্জন ও করা যাচ্ছে না। সুতরাং, এদের প্রত্যেকের অবস্থা গভীর বিবেচনা করতে হবে।
এই মহামারি যদি ৬ মাস/ ১বছর পর্যন্ত চলে! সেই দিকে লক্ষ রেখে শিক্ষার তেমন যদি ক্ষতি না হয় ইউজিসি’র পরামর্শ ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু উদ্দেশ্য যেনো কোনভাবেই অর্থ গ্রহণের উপায়ে রূপান্তরিত না হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউ এইচ ও) যে ভাবে নির্দেশনা দিচ্ছেন তাতে আন্দাজ করা যাচ্ছে মে মাস পর্যন্ত লকডাউন ধারাবাহিক ভাবে বাড়তে পারে। এর মাঝে শিক্ষার্থীরা ফিরে আসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে বা বেতন দেবে এমন চিন্তা না করে সকলের জন্যে সমঅধিকারের ভিত্তিতে অনলাইন পাঠদান কিভাবে যাওয়া যায় সে বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করা উচিৎ। অনলাইন শিক্ষাগ্রহণে সকলের সমঅধিকার নিশ্চিত করুন।
লেখক:
রঞ্জন সরকার, শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, আইন ও মানবাধিকার বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি)