একথালা ভাত
একথালা ভাতের সামনে এমন বিবর্ণ বসে থাকা
আর আশপাশে তারিখ বদলে যায়, ঋতু বদলে যায়, বদলে যায় অনুকম্পার মুখ
তুমি কি জানো না, বহুদিন আমরুল পাতায় রোদ লাগেনি?
তেরোশো একানব্বইয়ের বিখ্যাত যাত্রাপালা থেকে উঠে আসা অট্টহাসি
এখনও আঁচলের খুঁটে জমিয়ে রাখছ কেন?
ডায়রিতে জমিয়ে রাখছ বাদামের খোসা, চিটচিটে সিনেমার টিকিট!
ঝিলমাঠের জল শুকিয়ে কোঠাদালান উঠে গেছে
গুটি ভেঙ্গে উড়ে গেছে সব প্রজাপতি
দমকা হাওয়ায় স্কার্ট উড়ে অচেনা উরুতে রোদ পিছলায়,
আমার হাতে এঁটো শুকিয়ে করকর করছে
আমার উত্তর দক্ষিণে আগুনে হাওয়া
আর উপোসের ছায়া পূর্ব পশ্চিম জুড়ে
কতদিন শ্মশানবন্ধুর মতো বসে থাকবে একথালা ভাতের সামনে?

প্রতীক্ষা
বিবর্ণ চিঠিসকল ও মদিরালিপ্ত বিকেলের কোল ঘেঁষে একটা ট্রেন চলে গেছে। বোধহয় গতজন্মের প্ল্যাটফর্ম ছুঁয়ে। তখন পবিত্র অভিমান ও নিষেধের বাতাসে যুবকযুবতীরা মাতাল হয়ে যেতো খুব। সন্ধের আশেপাশে নদী ও নাবিকের গলায় মশা ঢুকে যেতো প্রায়দিন।
পাহাড়ের সানুদেশে কথাটার মধ্যে এক গাম্ভীর্যপূর্ণ হাহাকার আছে – আজকাল মনে হয়। সেসকল জন্মের টিকিটে চৌকাঠ অব্ধি ভ্রমণের সাধ মিটলো না শশকের মতো। তবু এইসব অবেলায় বিবর্ণ চিঠিসকল ও মদিরার পাশে বসে থাকি। যদি ফিরে আসে শ্বাপদের ন্যায় সেই ট্রেন শোণিতের লোভে।

ব্যথা কি বকুলের মতো
ব্যথা কি বকুলের মতো
ইতস্তত আজো?
আমি তো এখনো দেখি
ডাকবাক্সে
বিচ্ছেদের ঘুণপোকা জাগ্রত দেবতার মতো
জলকাচা ওড়নায় ঢেকে রাখা
পুরন্ত বুকে
পুরোনো চিঠির অক্ষর
পিঁপড়ের মতো চেটে চেটে খায় ভাবীকাল
দেখি তাও
ব্যথা কি ডুবন্ত এক নাও!
কেন তবে জলে ডুবে যায় আগুনের ধুকপুক
কেন মনে হয়
ব্যথার অপর নাম–তাহার চিবুক!

মাঝরাতের মনোলগ ১০
দূর থেকে দেখার মধ্যে যে না-দেখা অন্তর্ভুক্ত, তার তরুতলে আগুন জ্বলে। আগুনে কিয়ৎক্ষণ পুড়ে যায় প্রশ্নমালা। না-দেখা আবিষ্কৃত হবার আগেই ফুরিয়ে যায় পলাশের প্রাচুর্য।
ক্যানভাসে ঘন লালের বিপরীতে এক নীল বিন্দুতে স্থিত আছি। গেরস্থালি সুখস্মৃতির বিপ্রতীপ বিষের কন্দর। ভেসে যাবে, ভেসে যাবে ঘৃণার মান্দাস।
না-দেখার ঘরদুয়ার ছেড়ে গেছে বসন্তের পাখপাখালি। খড়কুটো পড়ে আছে ঘুলঘুলি, বারান্দায়। মাঝরাতে খরস্রোতা হাহাকারে ভেসে যাবে নাভিকুণ্ডল। না-দেখার মানচিত্র ছেড়ে।

শিরোনামহীন
পাখি হবে, পাখি হবে, পাখি হবে। কিছু বিকেলের নিয়তিই এই, ফুড়ুৎ করে উড়ে যাওয়া। কুসুমে কীট হয়ে থাকবে কিছু সান্ধ্যভ্রমণ। দোকানে জ্বলে ওঠা হলুদ ডুমের নীচে ডিম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জহুরি দেখে নেবে দুধে কত সর।
নদী হবে, নদী হবে, নদী হবে। সব নারী অলকনন্দা থেকে সাগরের পথে কিছু ঢেউ হারিয়ে ফেলবে। কিছু মাছ ও রোদের ঝিকিমিকি সমেত জল ফেলে রেখে আসবে স্টেশনহীন মফস্বলে। কিছু মানুষ ও নৌকা নিশ্চিত ভাসিয়ে রাখতে পারবে না।
পাথর, পাথর, পাথর। কিছু কিছু পাথর নদীর স্রোতে ক্ষয় হতে হতে হতে কাদা হয়ে থিতিয়ে যাবে। কাদার তাল ছেনে একদিন কেউ একটা মানুষের মুখ বানিয়ে ফেলবে।
মানুষ, মানুষ, মানুষ। মানুষই বানাতে চাইবে। নদী, জল বা পাথর নয়। তাই বিকেল উড়ে যাবে পাখির মতো। আর নদী কেবলই পাথরকে ক্ষয় করে যাবে।

লেখক:
অনুপম দত্ত, কবি এবং গদ্যকার