অনু গল্প । নুসরাত সুলতানা

Comments

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ন্যায্য অধিকারের আন্দোলনে গলা কাঁপিয়ে স্লোগান দেয়া দুই কর্মী রুবা আর আতিক। দুজন একসাথে অভিনয় করত মঞ্চনাটকে। রুবার গায়ের রঙ কালো আর আতিক ধবধবে ফর্সা। একসাথে চলতে চলতে রুবার চোখে আতিক দেখেছিল জোড়া শালিকের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে গল্প বলা, দেখেছিল ভাপ-ওঠা গরম ভাত আর ঘিয়ে মাখানো আলু ভর্তা।

প্রিয় বন্ধুকে কি করে না বলা যায় রুবার সেটা জানা ছিল না। আতিকের বাবা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আর মা নার্স। রুবার বাবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হেড মাষ্টার। আতিকের বাবা-মায়ের তেমন মত ছিল না বিয়েতে কিন্তু ছেলের প্রেমের কাছে হেরে যায় মা-বাবা। চট্টগ্রামে বিয়ে দেয়া মেয়ের শ্বশুর বাড়ির কোনো মান-মর্যাদাই রুবার বাবা যৌতুক এবং বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়ে রাখতে পারেন না।

বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় রুবা-আতিক দম্পতির ঘরে দু’টি পুত্র সন্তান জন্ম নিয়েছে। আতিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ‘ল -তে পি এইচ ডি অর্জন করে বড় একটা কর্পোরেট কম্পানির লিগ্যাল এডভাইজার। রুবা একটা ব্যাংকে চাকরি করত। দ্বিতীয় বাচ্চা হওয়ার পর স্বামী -শ্বাশুড়ি’র অনমনীয় দাবী মেনে ছেড়ে দিতে হয়েছে চাকরি।

রুবার দিন কাটে রান্না-বান্না, বাচ্চাদের পড়াশোনা আর আতিকের পছন্দ -অপছন্দের খেয়াল রেখে। আতিক ব্রান্ডের শাড়ি-গহনা কোনোকিছুরই অভাব রাখেনি। আতিক মাঝে মাঝেই বলে তোমার মতো সুখী কে আছে? রুবা একটা নিরুত্তর, নীরব তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। কেবল আতিকের মা যখন যৌতুক নিয়ে খোটা দেয় আর আতিক চুপ করে থাকে রুবার কানে ভেসে ওঠে আতিকের সেই দরাজ কন্ঠস্বর- “রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়.. ” রুবার চোখে ভেসে ওঠে মঞ্চ নাটকের সেই দৃশ্যপট – “জাগো বাহে, কুনঠে সবাই…!”

শায়লা বানু আর শাহীন চৌধুরীর দুই সন্তান। এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে সিমিন আর ছেলে শাহেদ।

শাহীন চৌধুরী ব্যাংকার আর শায়লা বানু বিএফ শাহীন স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। হাসি-আনন্দের বেশ সুখের সংসার তাদের। খুব পরিপাটি থাকেন শায়লা, কথা বলেন কাটা কাটা শব্দে স্পষ্ট উচ্চারণে। শায়লা বানু শাহেদকে নিয়ে খুব উচ্চাশা পোষণ করেন। মেয়ে মানবিক বিভাগ থেকে মাষ্টার্স পাস করলে ভালো ছেলে দেখে তিনি বিয়ে দেবেন এমনই আশা। সিমিন পাঁচ ফিট চার ইঞ্চি লম্বা, ফর্সা আর তনু দেহের অধিকারী। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার সাথে সাথেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য প্রপোজাল আসতে থাকে। শাহীন চৌধুরী মেয়েকে ইংরেজিতে অনার্স এবং এম এ করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানাবেন এমন স্বপ্ন দেখেন। পঞ্চম শ্রেণী থেকেই সিমিনের জন্য বাসায় তিনি ইংরেজি পত্রিকা রাখেন।

সময়ের পরিক্রমায় দেখা যায়- শাহেদ মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আর সিমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক। শাহেদ বিয়ে করে ফরাসী সুন্দরী নুবানকে আর সিমিনের বিয়ে হয় ব্যাংকার জাহিদের সাথে। জাহিদ যেমন মেধাবী তেমনই ভাবুক এবং একরোখা। বারবার সে চাকরি ছেড়ে দেয়। সিমিন আর জাহিদের ঘরে দুই কন্যা সন্তান জন্মেছে। দ্বিতীয় কন্যা জন্মের পরই শাহীন চৌধুরী মারা যান। শায়লা বানুসহ সিমিনের তিন কন্যা। অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়েও তিনজনকেই সিমিন লালনপালন করে পরম মমতায়। বাবার মৃত্যুতে শাহেদ শেষবার এসে গেছে। তাও প্রায় বারো বছর।

একসময় শায়লা বানুর শাড়ি গহনার খুব শখ ছিল। কিনেছেন প্রচুর সোনার গহনা আর জামদানি, বেনারসি শাড়ি। সিমিনের মেয়েরা এখন বেশ বড় হয়েছে। যে বয়সে মেয়েদের শাড়ি -গহনা পরার শখ জাগে ওদের সেই বয়স। শায়লা একরকম বিছানায় পড়ে গেছেন। প্রায় বেডসোর হয়ে গিয়েছে, অনেক সময়ই বিছানায় প্রস্রাব করে দেন। সেসব সিমিন নির্দ্বিধায় সামলায়। সিমিনের মেয়েরা কখনো নানীর শাড়ি-গহনা পরতে চাইলে তিনি বিরক্ত হন। বলেন আমার ছেলের ঘরেও তো নাতি-নাতনী আছে। সিমিন বলে, আম্মা ভাইয়া তো ফোন করেও আপনার খোঁজ নেয় না। খুব বিরক্ত হয়ে চুপ করে থাকেন শায়লা বানু।

এরই মধ্যে শাহেদ টাকার প্রয়োজনে দেশে সম্পদ বিক্রি করতে আসে। শায়লা বানু শাড়ি-গহনা সব মেলে বলে এগুলো সব তোর শাহেদ। চিকচিকে চোখ নিয়ে বলেন, তুই আর দাদু ভাইরাই তো আমার উত্তরাধিকারী। কিছুটা দূরে একজোড়া অবাক চোখ ভাবে কে এই অপরিচিতা নারী? এই কি আমার গর্ভধারিণী, জননী!

আবেশ খুব প্রতিষ্ঠিত একজন মঞ্চ নাটক পরিচালক।

মোহর উদীয়মান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অভিনেত্রী।

মোহরের কথার টোন, জ্ঞানের গভীরতা, গভীর কালো চোখ সবই খুব টানে আবেশকে। কিন্তু মোহর শ্রদ্ধাকে প্রেম অব্দি গড়াতে দিতে চায় না। নাটক পাড়ায় জনরব উঠে যাবে মোহরকে উঠিয়েছে আবেশ। মোহর নিজের মেধা, পরিশ্রম আর সততা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়।

আবেশকে মোহর খুব শ্রদ্ধা করে। মোহরের শ্রদ্ধায়ও আবেশ বেঁচে থাকে। মোহর আর আবেশ এক অদ্ভুত বন্ধুত্বের আলোতে আলোকিত।

এবার সেই বন্ধুত্ব মোহরই রাঙাতে চায় অন্য আলোয়।

একদিন মোহর ভাবত আবেশ অস্থির তাকে পেতে। কিন্তু আজ অবাক বিষ্ময়ে মোহর দেখে আবেশ কেবলই ব্যস্ত পরিবার, ক্যারিয়ার, বন্ধু-বান্ধব সবকিছু নিয়ে। সবচেয়ে গৌণ হচ্ছে মোহর। কোথায় মিইয়ে গেছে আবেশের সেই অস্থিরতা! একদিন মোহর ভাবত- আবেশের জীবনে মোহর এক অনিবার্য অংশ আজ দেখে মোহর কেবল এক বর্ধিতাংশ! হতবিহ্বল মোহর ভাবে- খুব দূরে যেতেই কি মানুষ খুব বেশি কাছে আসে!

লেখক:
Nusrat Sultana01
নুসরাত সুলতানা, গল্পকার

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট