বিশ্ব গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসে বিস্ময় ‘অপারেশন জ্যাকপট’

Comments

মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অভ্যন্তরীণ সব নৌচলাচল, বন্দর ও উপকূলীয় এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল ১০ নম্বর সেক্টর যা ছিল মূল নৌবাহিনী নিয়ে গঠিত। এ সেক্টরের কোনো নির্দিষ্ট সেক্টর কমান্ডার ছিল না। অপারেশন চলাকালে সেক্টরের কমান্ডারদের সহযোগিতায় নৌ-গেরিলাদের কাজ করতে হত। তবে এসব গেরিলা সরাসরি মুজিবনগর সদর দপ্তরের অধীনে কাজ করত। প্রথমত মার্চের শুরুর দিকে পাকিস্তানি সাবমেরিন পিএনএস ম্যাংরো ফ্রান্সের তুলন সাবমেরিন ডকইয়ার্ডে যায় পাকিস্তানি সাবমেরিনারদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। সেই ৪১ জন সাবমেরিনারদের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালী এবং এদের মাঝে ৯জন আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে ২৫ মার্চ কালোরাতের গণহত্যার খবর শুনে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন এবং সাবমেরিন ত্যাগ করেন। পরে একপজন লন্ডন চলে গেলে আটজন ৩০ মার্চ বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেন এবং ৯ এপ্রিল ১৯৭১ তারা ভারতের দিল্লিতে এসে পৌঁছান। এরা হলেন গাজী মো. রহমতউল্লাহ (বীরপ্রতিক), সৈয়দ মো. মোশাররফ হোসেন, আমানউল্লাহ শেখ(বীরবিক্রম), বদিউল আলম (বীরউত্তম), আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী (বীরউত্তম), মো. আহসানউল্লাহ (বীরপ্রতীক), আবদুর রকিব মিয়া (বীরবিক্রম) (শহীদ), আবদুর রহমান(বীরবিক্রম)।

পরে এই আটজনের সঙ্গে আরও কয়েকজনকে যুক্ত করে মোট ২০ জনের গেরিলা দল গঠন করে তাদেরকে ভারতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাদের দেশে কর্নেল ওসমানীর কাছে পাঠানো হয়। তিনি তাঁদের নিয়ে নৌ–কমান্ডো বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন এবং ওসমানীর সিদ্ধান্তে নৌ-কমান্ডো সেক্টর খোলার পর বাছাই করা গেরিলাদের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক পলাশীর স্মৃতিসৌধের পাশে ভাগীরথী নদীর তীরে ১৩ মে একটি গোপন প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। এই প্রশিক্ষণ শিবিরের সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় সি২পি (C2P)। এখানে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঐ আটজনসহ অন্যান্য সেক্টরের বিভিন্ন শিবির থেকে সর্বমোট ৫১৫ জন বাছাই করা যোদ্ধা সংগ্রহ করে গঠিত হয় বাংলাদেশের নৌ-কমান্ডোদের ওই প্রশিক্ষণ ক্যাম্প।

প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্মকর্তা কমান্ডার এম এন সামন্ত এবং প্রশিক্ষণ পরিচালক ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লে. কমান্ডার জি এম মার্টিস। আরও ২০ জন ভারতীয় প্রশিক্ষক এবং পাকিস্তান নৌবাহিনী থেকে যোগ দেয়া ৮জন বাঙালী সাবমেরিনার। প্রশিক্ষণের দুটো অংশ ছিল। সবাইকে প্রয়োজনীয় স্থলযুদ্ধ যেমন গ্রেনেড নিক্ষেপ, বিস্ফোরকের ব্যবহার, স্টেনগান রিভলবার চালনা, আন-আর্মড কমব্যাট (খালি হাতে যুদ্ধ) ইত্যাদি শিখতে হতো। আর জলযুদ্ধের প্রশিক্ষণের মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধরনের সাঁতার যেমন—বুকে ৫-৬ কেজি ওজনের পাথর বেঁধে সাঁতার, চিৎ সাঁতার, কোনোমতে পানির ওপরে নাক ভাসিয়ে টানা দীর্ঘ সময় সাঁতার, পানিতে সাঁতরে ও ডুব সাঁতার দিয়ে লিমপেট মাইন ব্যবহার, স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার, জাহাজের কেবল ভাঙা ইত্যাদি কঠিন সব প্রশিক্ষণ দেওয়া হত তীব্র খরস্রোতা ভাগীরথী নদীতে। শীত-বর্ষায় টানা ৪৮ ঘণ্টা পানিতে থাকার অভ্যাস করতে হয় সব যোদ্ধাকে।

প্রশিক্ষণ শুরুর আগেই বাছাই করা যোদ্ধাদের বলে দেওয়া হয়, এটি একটি সুইসাইডাল অপারেশন বা আত্মঘাতী অভিযান হবে। তাই অপারেশনের সময় যেকোনো মূল্যে অভিযান সফল করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে তাদের প্রাণ দিতে হতে পারে। তাই প্রশিক্ষণের শুরুতেই প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে ছবিসহ একটি সম্মতিসূচক ফরমে স্বাক্ষর নেওয়া হতো। ফরমে লেখা থাকত, ‘আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু ঘটলে কেউ দায়ী থাকবে না।’

১২ জুলাই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর সাথে ভাগিরথী তীরের হরিণা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।

টানা প্রায় তিন মাস প্রশিক্ষণের পর আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা সাজানো হতে থাকে। একই সঙ্গে একই সময়ে দুই সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মংলা এবং দুই নদীবন্দর নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর এবং দাউদকান্দি ফেরিঘাটে আক্রমণ চালানোর জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম ব্যাচকে মোট ৫টি দলে ভাগ করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর আক্রমণে আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৬০ জনের দল, মংলা আক্রমণে মো. আহসানউল্লাহর নেতৃত্বে ৬০জনের আরেকটি দল, বদিউল আলমের নেতৃত্বে ২০জনের দল চাঁদপুর, আবেদুর রহমানের নেতৃত্বে ২০জনের দল নারায়ণগঞ্জ এবং আরও ৯জনের একটি দলকে শাজাহান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে দাউদকান্দি ফেরিঘাট আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত করা হয়। এ আক্রমণের নাম দেওয়া হয় “অপারেশন জ্যাকপট”।

দলনেতাদের শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল আক্রমণের নির্দেশনা সংক্রান্ত বিশেষ গোপনীয় সাংকেতিক পদ্ধতি যা দলের অন্যান্য সদস্যের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। কমান্ডারদের বলা হয়েছিল, দুটি বাংলা গানকে সতর্ক সংকেত হিসেবে ব্যবহার করা হবে। গান দুটি প্রচার করা হবে কলকাতা আকাশবাণীর পক্ষ থেকে পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানে সকাল ৬টা থেকে ৬:৩০ মিনিট অথবা রাত ১০:৩০ মিনিট থেকে রাত ১১টায়। প্রথম সংকেত ছিল পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান’, যার অর্থ হল ‘আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হও, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দ্বিতীয় গান বাজানো হবে’। আর দ্বিতীয় গান আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’ বাজানো হলে ‘আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগ কর’।  অর্থাৎ সুস্পষ্ট নির্দেশ ‘আক্রমণ করো’।

প্রত্যেক নৌ-কমান্ডোকে একটি করে লিমপেট মাইন, ছুরি, এক জোড়া সাঁতারের ফিন আর কিছু শুকনো খাবার দেওয়া হলো। প্রতি ৩জনের জন্য একটি করে স্টেনগান ও কমান্ডারদের দেওয়া হয় একটি করে ট্রানজিস্টর। অপারেশনের দিন ধার্য করা হল ১৯৭১ সালের ১৪/১৫ আগস্ট।

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের নৌকমান্ডারদের ৫টি দল অভিযান পরিচালনার জন্য পলাশির হরিণা ক্যাম্প থেকে তাদের যাত্রা শুরু ক’রে আগষ্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী পৌঁছে যায় স্ব স্ব এলাকা চট্টগ্রাম, মোংলা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও দাউদকান্দিতে। সে এক লোমহর্ষক যুদ্ধাভিযান।

চট্টগ্রাম বন্দর আক্রমণ

চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশন পরিচালিত হয় ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে অর্থাৎ ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে। হরিনা ক্যাম্প থেকে আসা ৬০ জনের দলকে ২০ জন করে শাহ আলম, মাজহারউল্লাহ ও আব্দুর রশীদের দায়িত্বে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন পথ ধরে শহরে প্রবেশ করার কথা। দুটি দল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহা সড়কের সমিতির হাট থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পথে শহরের বিভিন্ন আশ্রয়স্থলে অবস্থান নেয়। অপর দলটি শুভপুর ব্রিজ থেকে সাম্পান যোগে যাত্রা করে। ১৩ আগস্ট প্রথম গানের সংকেত পাওয়ার পর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরে চরলক্ষ্যায় তাদের বেইস ক্যাম্পে পৌঁছায়। কিন্তু আব্দুর রশীদের নেতৃত্বে তৃতীয় দলটি সীতাকুণ্ডে আটকা পড়ায় এই দলের ‘অপারেশন জ্যাকপট”-এ অংশ নেয়া সম্ভব হয়নি।

১৫ আগস্ট তারা ট্রানজিস্টরে চূড়ান্ত সংকেত পেয়ে অপারেশনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ৩১ জন কমান্ডো ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে অপারেশনের জন্য যাত্রা করে। রাত ১টার দিকে জোয়ার-ভাটার সন্ধিক্ষণে তারা বেশ দ্রুত নিজ নিজ বাছাই করা টার্গেট জাহাজের গায়ে মাইন লাগিয়ে সাঁতার কেটে সরে পড়ে।

রাত ১টা ৪০ মিনিটে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। তারপর একে একে সব মাইন বিস্ফোরিত হয়। এ সফল অপারেশনে তিনটি বড় অস্ত্রবাহী জাহাজসহ ১০টি জাহাজ ও বার্জ ধ্বংস হয়। বড় জাহাজগুলো হলো (১) ভি হরমুজ – ৯৯১০ টন অস্ত্র ও গোলা–বারুদবাহী এটি ১৪ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে এসে  ১৩ নম্বর জেটিতে নোঙর করা ছিল (২) এম ভি আল-আব্বাস – ১০ হাজার ৪১৮ টন সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে ৯ আগস্ট ১২ নম্বর জেটিতে অবস্থান নিয়েছিল। (৩) ওরিয়েন্ট বার্জ নম্বর ৬ – ৬ হাজার ২৭৬ টন অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে ফিস হারবার জেটির সামনে অবস্থান করছিল।

এ অপারেশনে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডোদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, সকলেই নিরাপদে হরিণা ক্যাম্পে ফিরে যান।

মংলা বন্দর আক্রমণ

ভারতের কানিং মাতলার বন্দর থেকে মংলা অপারেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে সুন্দর বনের গভীর জঙ্গল পাড়ি দিয়ে কমান্ডো দলটি ১৩ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টায় মংলা বন্দরে পৌঁছায়। মো. আহসানউল্লাহ ৬০জনের কমান্ডো দলটিকে ৫টি উপদলে ভাগ করেন শেখ মহসীন আলী, খলিলুর রহমান, মুজিবর রহমান, ইমাম বারী ও হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে।

১৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৭টায় রেডিও মারফত অ্যাকশন গান বাজার পর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে জোয়ার-ভাটার কথা চিন্তা করে সন্ধ্যার পর কমান্ডোরা মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে পথ ভুল করবার কারণে সুতারখালি হয়ে বন্দরের অপর পা্রে বানিয়া শান্তা গ্রামে এসে পৌঁছতে রাত ২টো বেজে যায়। ইতিমধ্যে অপারেশনের নকশা মাফিক বাংলাদেশের সব নদী ও সমুদ্র বন্দরে অপারেশন শেষ। এ অপারেশন শুধু জীবনের ঝুঁকিই ছিল না বরং ১৬ আগস্টের ভোরের এই অপারেশন ছিল সরাসরি একটি সুইসাইড অ্যাকশান। সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে কমান্ডোরা যখন নদীতে নামতে প্রস্তুত তখন বন্দর মসজিদ থেকে ফজরের আজান শুরু হয়ে গেছে। অর্থাৎ ভোর প্রায় সাড়ে চারটায় মংলায় অপারেশন শুরু হয়।

দলনেতা আহসানউল্লাহ ৪৮জন নৌকমান্ডোকে কাছাকাছি অবস্থানরত ৬টি জাহাজ ধ্বংসের নির্দেশ দিয়ে নিজেও নদীতে নেমে পড়েন। নৌকমান্ডোরা ৬টি বিদেশি জাহাজে সফলতার সাথে মাইন লাগিয়ে বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে স্থান ত্যাগ করে। ভোর সাড়ে ছয়টা থেকে নৌ কমান্ডোদের লাগানো মাইন বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হতে শুরু করে।

৩০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তান বিমানবাহিনীর চারটি বিমান মোংলা বন্দরের ওপরে ঘুরতে দেখা যায়। আক্রান্ত সোমালীয় জাহাজ এস এস লাইটনিং, একটি মার্কিন ও দুটি চীনা, একটি জাপানি ও একটি পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস কিম্বা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হয় এবং ৩০ হাজার টন গোলা-বারুদ, যুদ্ধ সরঞ্জাম ও খাদ্যসামগ্রী নষ্ট হয়।

এ অপারেশনে অংশ নেয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডোদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি তবে বিভিন্ন পথে এবং সময়ে ভারতে ফেরার পথে মংলা অভিযানে অংশগ্রহণকারী ৬ নৌকমান্ডো সাতক্ষীরার বুধহাটায় শত্রুপক্ষের অ্যামবুশে পড়েন এবং গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাবার পর ১৮ আগস্ট রাতে ধরা পড়ে যান। তন্মধ্যে ২জন নিহত হন এবং অপর ৪ যোদ্ধা বিভিন্ন আর্মী ও রাজাকার ক্যাম্পে বীভৎস নির্যাতনের এক পর্যায়ে যশোর সেনানিবাস থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পালিয়ে যান এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতে প্রবেশ করেন।

চাঁদপুর নদীবন্দর আক্রমণ

চাঁদপুর নদী বন্দর অপারেশনের লক্ষ্যে ২০জন নৌকমান্ডোর দলটি বদিউল আলমের নেতৃত্বে ১০ আগস্টে আগরতলা হয়ে বক্সনগর সীমান্ত পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১৩ আগস্ট চাঁদপুরের আশেপাশের রঘুনাথপুর, দক্ষিণ বলিয়া ও এখলাসপুর গ্রামের কয়েকটি এবং শহরের একটি বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করে নৌকমান্ডোরা।

প্রথম সংকেত হিসেবে গান শোনার পরে বন্দর রেকি করে দলনেতা ৬টি স্টিমার ও ছোট-বড় জলযানকে টার্গেট নির্ধারণ করে দলের ১৮ জনকে ৩জন করে মোট ৬টি উপদলে বিভক্ত করে শাহজাহান কবির, ফজলুল কবির ও মমিনউল্লাহ পাটওয়ারীকে উপনেতার দায়িত্ব দেন। ২জনকে অপারেশন শেষে স্থান ত্যাগের জন্যে নির্দিষ্ট স্থানে নৌকা নিয়ে অবস্থানের নির্দেশ দেন।

দ্বিতীয় সংকেত সঙ্গীত শোনার পর ভরাবর্ষার মেঘনা আর ডাকাতিয়ায় অপেক্ষাকৃত শান্ত জোয়ার-ভাটা সন্ধিক্ষণ বিবেচনায় রেখে অপারেশন সময় ১৫ তারিখ মধ্যরাতে স্থির করা হয়।

দলনেতা বদিউল আলমসহ কমান্ডোদের ৬টি দল ৬টি নৌযানে মাইন স্থাপনের লক্ষ্যে নদীতে নামেন এবং জলের নীচে টার্গেটের শরীরের শ্যাওলা পরিস্কার করে মাইন স্থাপন সম্পন্ন করেন। কিন্তু জল থেকে মাথা তুলে তারা দেখলেন তাদের ফেরার পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তানি সৈন্য বোঝাই রকেট সার্ভিসের জাহাজ গাজী। গাজীর উজ্জ্বল আলোয় হানাদারদের চোখ এড়িয়ে সাঁতরে নদী পার হওয়া অসম্ভব। এমন অবস্থায় কচুরিপানা মুখের উপরে ধরে শরীর সম্পুর্ণ ডুবিয়ে চিত সাঁতারে ‘Do or Die’ পরিস্থিতির মধ্যে কমান্ডোরা নিরাপদ স্থানে সরে যেতে সমর্থ হন।

সেই মুহুর্তে মাইন বিস্ফোরণের আওয়াজে চারিদিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ২টি স্টিমার, গমবাহী একটি বার্জ, লঞ্চঘাট, পন্টুনসহ আশেপাশে থাকা ছোট বড় আরও অনেকগুলো নৌযান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

অপারেশনে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডোদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, সকলেই নিরাপদে হরিণা ক্যাম্পে ফিরে যান।

নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর আক্রমণ

নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর আক্রমণে উদ্দেশ্যে আবেদুর রহমানের নেতৃত্বে ২০জনের দলটি আগরতলা থেকে কসবা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আগস্টের ১১ তারিখে এই নৌকমান্ডোরা নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানায় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ীতে আশ্রয় নেন। এখান থেকেই দলনেতা রেকি করে ৪টি নৌযানকে টার্গেট করেন।

৩জন করে ৪টি উপদলে বিভক্ত করে ৪টি  টার্গেট নির্দিষ্ট করে দেন আবেদুর রহমান। অপেক্ষায় থাকেন চূড়ান্ত নির্দেশের। ১৫ তারিখ রেডিওতে দ্বিতীয় সংকেত সঙ্গীত শুনবার পরে প্রস্তুতি নেন সন্ধ্যায় রওয়ানা হবার।

১৫ আগস্ট সন্ধ্যার পর বেরিয়ে পড়েন নৌকমান্ডোরা। গ্রামের মাঝ দিয়ে হেঁটে নদী তীরের রাজাকারকে নিরস্ত্র করে সাঁতরে টার্গেটের কাছে যখন পৌঁছোন তখন রাত সাড়ে ১২টা অর্থাৎ ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহর। টার্গেটে পৌঁছে প্রথম ডুবে জলের তলায় টার্গেটের গায়ের শ্যাওলা পরিস্কার করেন তারা। দ্বিতীয় ডুবে মাইন স্থাপন করে মাইনের রাবারের ক্যাপ খুলে মাইনের সেফটি পিন সরিয়ে নেন। মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে সেই স্থান ত্যাগ করে সরে যান নিরাপদ দূরত্বে।

মাইন বিস্ফোরণে নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে অবস্থানরত ৪টি নৌযান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় ও আশেপাশে থাকা বেশ কয়েকটি ছোটবড় নৌযান ক্ষতিগ্রস্থ হয়। নারায়ণগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে এ অপারেশনে কমান্ডোরা বিশেষ সাহসিকতার পরিচয় দান করেন।

এ অপারেশনে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডোদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, সকলেই নিরাপদে হরিণা ক্যাম্পে ফিরে যান।

দাউদকান্দি ফেরীঘাট আক্রমণ

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফেরিঘাট দাউদকান্দি। দাউদকান্দি ফেরীঘাট আক্রমণের লক্ষ্যে শাহজাহান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ৯ জনের একটি নৌকমান্ডো দল ১১-১২ তারিখে কুমিল্লার কংশনগরের পূর্বদিকের সীমান্ত পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে দাউদকান্দির বন্ধরামপুরের পীর সাহেব আল্লামা শাহ কামালের বাড়ীর অন্দর মহলে আশ্রয় নেন। ১৩ তারিখে প্রথম সঙ্গীত সংকেত পাবার পর ১৪ তারিখে দলনেতা ফেরীঘাট রেকি করেন।

১৫ আগস্ট সকালে দ্বিতীয় সঙ্গীত সংকেত পাবার পর সন্ধ্যার পরে অপারেশনে বের হবার সিদ্ধান্ত নেন দলনেতা। রওয়ানা হবার পর বৃষ্টিপাত, ঝড়োবাতাস এবং পথের গাইড অসুস্থ হয়ে পরায় তারা বাধ্য হন বন্ধরামপুরে ফিরে আসতে। সেদিনের অপারেশন স্থগিত করা হয়।

পরদিন ১৬ তারিখ সন্ধ্যায় আবার যাত্রা শুরু করে নৌকমান্ডোরা বন্ধরামপুর থেকে ৫ মাইল দূরের দাউদকান্দি ঘাটের উদ্দেশ্যে। ঘাট থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে ধানক্ষেতের নৌকা রেখে কোসা নৌকায় ঘাটের আরও কাছে পৌঁছোন যখন তখন রাত ১টা অর্থাৎ ১৭ আগস্ট প্রথম প্রহরকাল।

৩জন করে দুদলকে ঘাটের অদূরে নোঙ্গর করে রাখা দুটি ফেরিতে লাগাবার জন্যে ৬টি মাইনসহ পাঠিয়ে দিয়ে নিজে অপর আরেকজন কমান্ডোকে নিয়ে ঘাটের পন্টুনের দিকে অগ্রসর হন শাহজাহান সিদ্দিকী। নির্দেশিত নিয়মে মাইন স্থাপন করে সকলেই সাঁতরে যখন নৌকোয় ফিরে আসেন তখন রাত ২:৪৫ মিনিটে বিকট শব্দে মাইনগুলো বিস্ফোরিত হয় এবং দুটি ফেরী, পন্টুন, লঞ্চঘাট ও জ্বালানী তেলের বৃহদাকৃতির ড্রামগুলো তেলসহ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়।

নৌকমান্ডোরা বন্ধরামপুর গ্রামের আশ্রয়ে পৌঁছে দেখেন পীর সাহেব তাদের জন্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন, এদের সুস্থ প্রত্যাবর্তনে তিনি সকলকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। ১৯ আগস্ট সকালে ৯ বীর নিরাপদে আগরতলায় প্রবেশ করেন।

সমাপ্ত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আরেক ঐতিহাসিক অপারেশন “অপারেশন জ্যাকপট”। একশনগুলোতে ২৬টি জাহাজ ধ্বংস হয় এবং আরও অসংখ্য নৌযান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হতাহত হয় অগণিত পাকিস্তানি সৈন্য, রাজাকার ও পুলিশ।

অপারেশন শেষে ফেরার পথে সাতক্ষীরার বুধহাটায় হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে দুজন নৌকমান্ডো আফতাবউদ্দিন ও সিরাজুল ইসলামের শাহাদাৎবরণ ও ৪জন নৌকমান্ডোর বন্দিত্ব ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের আর কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে বন্দরগুলির পাশ্ববর্তি গ্রামগুলোতে পরবর্তি কয়েকদিনে পাকিস্তানি হানাদারদের হামলায় অজস্র গ্রামবাসী শহীদ হন। নৌকমান্ডোদের আশ্রয় দেবার অপরাধে একটি বাড়ীর ১২ বছরের কিশোরও শহীদ হন হানাদারদের হাতে।

তবুও বিশ্বের গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ অসামান্য সফল এক অপারেশন। একই সময়ে ৫টি বন্দরে এমন সুষ্ঠু ও সমন্বিত সফল আক্রমণ পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে আর একটি নজীরও পাওয়া যায় না।

বাঙালীয়ানা/এসএল

অগ্নিঝরা একাত্তরের দিনগুলো, পড়ুন –

আগস্ট ১৯৭১

জুলাই ১৯৭১

জুন ১৯৭১

মে ১৯৭১

এপ্রিল ১৯৭১

মার্চ ১৯৭১

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.