অশ্লীল নজর অসভ্যতা । কাবেরী রায়চৌধুরী

Comments

আমার এক বান্ধবী তার দেশ ছেড়েছে বাধ্য হয়ে। তার নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ করা গেলো না। ঢাকায় থাকাকালীন তাদের সঙ্গে আলাপ। সখ্য। এই দম্পতিকে ওই দেশে থাকাকালেই ব্যতিক্রমী মনে হতো চিন্তাভাবনার দর্শনে। মুসলিম হয়েও সে আমার কাছ থেকে দেবী দুর্গার মূর্তি চেয়ে নিয়েছিল। আমি দেশ থেকে চিরদিনের মত বিদায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি তখন দিয়ে এসেছি দেবী মূর্তি। আমার আনন্দ ও সঙ্কটের দিনে সে আর তার স্বামী আমার পাশে ছিল। সেই বান্ধবীর চুল বয়েজ কাট। কপালে টিপ, জিনস টপ পরার অপরাধে তার মায়ের চিকিৎসা করতে অস্বীকার করে হাসপাতালের নার্সিং কর্মিরা। তাকে হুমকি দেওয়া হয়, এইরকম পোশাক পরলে তারা তার মায়ের নার্সিং করবেনা। তাকে হাসপাতালে আটকে রাখা হয়। তার শ্বশুরবাড়ি যেহেতু আর্মি ব্যাক গ্রাউন্ড তাই সে যাত্রায় সে বড় রকমের ক্ষতির হাত থেকে মুক্তি পায়। এরপর বিভিন্নভাবে তার ওপর আক্রমণ নেমে আসে পথেঘাটে এমনভাবে যেন সেগুলো অনিচ্ছাকৃত অ্যাকসিডেন্ট। তারা দুজনেই স্কলারশিপ নিয়ে দেশ ছেড়েছে ভারাক্রান্ত মনে।

এতগুলো কথা লিখলাম এইজন্য যে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা এইবার revolt করেছে পোশাকের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য একটি পদক্ষেপ এই মুহূর্তে। আমরাও এদেশে মেয়েদের পোশাকের ওপর লাগাম পড়ানোর সম্মুখীন হচ্ছি যা ভয়ঙ্কর।

বেশ কিছু ভিডিও দেখলাম বিদ্রোহী মেয়েদের। একটি চরম দমননীতির বিরুদ্ধে চরমভাবেই আঘাত আনা উচিৎ সেটাই ছাত্রীরা করে দেখিয়েছে। এক ছাত্রী ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরে আন্দোলন করেছে। বিভিন্ন পোশাকে বিভিন্ন জন পথে নেমেছে এই মর্মে নারীর পোশাকের ওপর অসভ্য দমননীতি চলবে না। কিছুদিন আগেই দশ নম্বরে একটি বাসের মধ্যে জিনস টপ পরিহিত এক মেয়েকে বেশকিছু জন ঘিরে অকথ্য গালিগালাজ মারধোর করে, তাদের মধ্যে মেয়েরাও অংশ নিয়েছিল! লজ্জার কথা!  

বারবার মেয়েদের পর্দার আড়ালে ঢুকিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা চলেছে! মেয়েদের লেখাপড়ার বিরোধিতা করেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। ২০২২ এ ও তা অব্যাহত!  

এই প্রসঙ্গে যে মেয়েটি ব্লাউজহীন শাড়ি পরেছে সে নিশ্চয় নিয়মিত এই ড্রেসে ইউনিভার্সিটিতে আসে না? অর্থাৎ এইটি প্রতীকী!  আমি যা ইচ্ছা পরতে পারি সেই স্বাধীনতা দেশের সংবিধান আমাকে দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রকাশ্য চুম্বন করেছিল, I am a slut বলে পথে নেমেছিল! বিশুদ্ধবাদীরা রে রে করে উঠেছিলেন। এইবার নাকি সবাই রাস্তায় চুমু খাবে!  অথচ তারপর আর কিন্তু কেউ কখনো রাস্তায় চুমু খায়নি। ওইটা প্রতিবাদ ছিল। ঠিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটিও সেইভাবে প্রতিবাদ করেছে। আমি বলবো, বেশ করেছে। বেশি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলে বিপ্লব এইভাবেই আসবে।

যত পেছনের দিকে তাকাচ্ছি মনে পড়ছে আগে মহিলাদের ব্রায়ের স্ট্র‍্যাপ দেখা গেলে অন্য মহিলারা ফিসফিস করে তাকে সতর্ক করতো!  যেন কী সাঙ্ঘাতিক অঘটন ঘটে গেছে!  অন্তর্বাসের একটি নিরীহ স্ট্র‍্যাপ যদি আত্মকথা লিখতে পারতো… হায় রে!

ঋতুকালে অসাবধানতায় শাড়িতে পোশাকে রক্তের দাগ লেগে গেলে গেলো সব! অথচ তা শরীর বিজ্ঞানের বিষয়। স্যানিটারি ন্যাপকিন আজও কালো প্লাস্টিকে মুড়ে নিষিদ্ধ বস্তুর মত পাচার করে বিক্রেতা!  আর সদর্পে কন্ডোম কেনে কিশোর!  

ঢাকায় দূতাবাসের সেক্রেটারি আমাকে দেখে বলেছিলেন, কী ভালো যে লাগলো আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে! আপনার পোশাক! স্মার্টনেস! এখানে যেদিকে তাকাই সব মনে হয় ব্যান্ডেজ বাধা!

প্রশ্নটা আসলে দেখার চোখ। পড়াশোনা অন্য সামাজিক কাজকর্ম নিয়ে মানুষ যত ব্যস্ত থাকবে ততোই এইসব অকিঞ্চিৎকর বিষয় নিয়ে কম চিন্তা করার সময় পাবে। বস্তুত সেটাই হয় না তাই অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করে এবং বস্তুত একটি সময়কে পিছিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা।

পোশাক যে যার নিজস্ব রুচি অনুযায়ী পরবে এটাই হওয়া উচিৎ। লজ্জা লাগছে এইরকম একটি বিষয় নিয়ে শব্দ ও সময় নষ্ট করতে হচ্ছে বলে!  

এক ছাত্রী দুর্দান্ত একটি কথা বলেছে, আপনারা তো অন্তর্বাসের ফিতা দেখলেও সিডিউসড হন…!  

বটেই তো! সিডিউসড হওয়ার জন্য বোধহয় তৈরিই থাকে কিছু মানুষ সে বোরখা পরুক আর ব্লাউজহীন শাড়ি! অশ্লীল নজরটাই যে অসভ্যতা তা কি তারা বোঝে?  

সাব্বাশ! বলতে ইচ্ছে করছে বাংলাদেশের নব্য প্রজন্মকে যারা প্রতিবাদে নেমেছে এই অসভ্যতার।

লেখক:
Kaberi Roychoudhury01
কাবেরী রায়চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক

ফিচার ফটো সৌজন্য: দীপু মালাকার

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট