অসাম্প্রদায়িক কবি কায়কোবাদ

Comments

স্বদেশ প্রেম, সত্যনিষ্ঠা আর ইতিহাস এবং ঐতিহ্য প্রীতি ছিল তার কবি প্রতিভার মৌল বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রযুগেই কবি কায়কোবাদ গীতিকবি হিসাবে সাহিত্য ক্ষেত্রে আবির্ভূত হলেও মহাকাব্য রচয়িতা হিসেবে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। মহাকাব্য রচনায় তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্যই তিনি সকলের প্রশংসা ও বিস্ময়দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

‘মহাকবি কায়কোবাদ’ নামে বহুল পরিচিত কায়কোবাদের পিতৃপ্রদত্ত নাম কাজেম আল-কোরায়েশি। ১৮৫৭ সালে, ঐতিহাসিক সিপাহী বিপ্লবের বছর ঢাকার নবাবগঞ্জের আগলা গ্রামে পূর্বপাড়ায়  তাঁর জন্ম। পিতা শাহামতুল্লাহ আল-কোরায়েশি এবং মাতা ছিলেন জোমরাতউন্নেসা ওরফে জরিফুন্নেসা খাতুন। পিতা ছিলেন উকিল, ঢাকা জেলা জজকোর্টে আইন পেশায় ছিলেন যুক্ত। সেই সুবাদে কায়কোবাদের পড়াশোনা ঢাকাতেই হয়েছিল।

কায়কোবাদ ঢাকার পোগোজ স্কুল এবং সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।  সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়াশোনা কালে পিতার মৃত্যু হয়, এর মাত্র এক বছর আগে কায়কোবাদের বয়স যখন এগারো বছর তিনি হন মাতৃহারা। কায়কোবাদ তখন ভর্তি হন ঢাকা মাদরাসায়, যা বর্তমানে নজরুল কলেজে পরিণত হয়, সেখানেই এন্ট্রান্স পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন, কিন্তু পরীক্ষার আগেই পোস্ট-মাস্টারের চাকরি নিয়ে তিনি স্বগ্রাম আগলায় চলে যান। সমগ্র চাকরি জীবনে তিনি এ পদেই বহাল ছিলেন এবং এখান থেকেই অবসর গ্রহণ করেন।

শোনা যায়, কবির পূর্বপ্রজন্ম বাদশাহ শাহজাহানের রাজত্বকালে বাগদাদের কোনো এক অঞ্চল থেকে ভারতে আসেন। তাদের মধ্যে মাহবুব উল্লাহ আল কোরেশী ফরিদপুর জেলার গোড়াইলে বসবাস শুরু করেন। কায়কোবাদ মাহবুব উল্লাহ আল কোরশীর প্রপৌত্র। কবির পিতামহের নাম নেয়ামত উল্লাহ আল কোরেশী।

অতি অল্পবয়স থেকে কায়কোবাদের সাহিত্য-প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। মাত্র তেরো বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্য বিরহবিলাপ প্রকাশিত হয়। পনের বছর বয়সে তিনি রচনা করেন তার দ্বিতীয় কাব্য ‘কুসুম কানন’। কবি জীবনের প্রথম পর্যায়ের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কাব্য ‘অশ্রুমালা’। এরপর তিনি মহাকাব্য রচনায় মনোনিবেশ করেন এবং তার বিপুল আয়তনের মহাকাব্য ‘মহাশ্মশান’ প্রকাশ পায়। তবে ‘মহাশ্মশান’ পর আরো ১০ বছর কায়কোবাদ কাব্যটির নানা আকৃতি ও প্রকৃতিগত পরিবর্তন সাধন করেন।

তাঁর কাব্যগ্রন্থ:

বিরহবিলাপ (১৮৭০)
কুসুম কানন (১৮৭৩)
অশ্রুমালা (১৮৯৫)
মহাশ্মশান (১৯০৪)
শিব-মন্দির (১৯২২)
অমিয়ধারা (১৯২৩)
শ্মশান-ভস্ম (১৯২৪)
মহরম শরীফ (১৯৩২)

কবির মৃত্যুর বহুদিন পরে প্রকাশিত হয়:

প্রেমের ফুল (১৯৭০)
প্রেমের বাণী (১৯৭০)
প্রেম-পারিজাত (১৯৭০)
মন্দাকিনী-ধারা (১৯৭১)
গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ (১৯৭৯)
বাংলা একাডেমী ১৯৯৪-৯৭ সালে ৪ খন্ডে প্রকাশ করে কায়কোবাদ রচনাবলী।

ঊনিশ শতকের যুগস্রষ্টা কবি মাইকেল মধুসূধন দত্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মহাকাব্য রচয়িতা। পরবর্তীকালে তার ধারা অনুসরণ করে যারা মহাকাব্য রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কায়কোবাদ ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রমধর্মী মহাকাব্য রচয়িতা। কায়কোবাদ বাংলার অপর দুই মহাকবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেনের ধারায় মহাকাব্য রচনা করেন। তবে নবীনচন্দ্রই ছিলেন তার প্রধান আদর্শ।

বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি হিংসা, দ্বেষ ও সংকীর্ণতার যে প্রেক্ষিত পেয়েছিলেন, তাকে তিনি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ‘মহাশ্মশান’ রচনার মধ্য দিয়ে সম্প্রীতির এক নবপ্রেক্ষিত নির্মাণে প্রয়াসী ছিলেন। সময়ের বিপরীতে গিয়ে কায়কোবাদ একটি অতুলনীয় সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্নলোক নির্মাণ করেছিলেন। যেখানে হিন্দু মুসলমান একই দেশবাসী এবং একই প্রকৃতির মানবীয় গুণাগুণে বিভূষিত।

কবি কায়কোবাদের কয়েকটি কবিতা পড়ুন এখানে।

গীতিকবিতা রচনাতেই কবি ছিলেন অপেক্ষাকৃত সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত ও অধিকতর সিদ্ধহস্ত। তার শ্রেষ্ঠ গীতিকাব্য ‘অশ্রুমালা’ই তার বড় প্রমাণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও কায়কোবাদের যাবতীয় খ্যাতি এবং পাঠক সমাজের সমস্ত বিমুগ্ধ বিস্ময় তার ‘মহাশ্মশান’ কাব্যকে ঘিরে। কাব্যটিকে তিনি মহাকাব্য বলে দাবি করেছেন। কিন্তু বাস্তব কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কবির দাবি অনুযায়ী কাব্যটি যথার্থ মহাকাব্য না হলেও নানা বৈশিষ্ট্যের কারণে কায়কোবাদের এই মহাকাব্যিক প্রয়াসকে কোন অবস্থাতেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। সে সময়কার প্রেক্ষাপটে এরূপ উদার মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, সত্যনিষ্ঠ এবং বিশাল আয়তনের কাব্য প্রয়াস সত্যি আমাদেরকে যুগপৎ ও মুগ্ধ করে।

তবুও কায়কোবাদের মহাকবি নামের খ্যাতি এই মহাশ্মশান কাব্যের জন্যই। কাব্যটি তিন খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে ঊনত্রিশ সর্গ, দ্বিতীয় খণ্ডে চব্বিশ সর্গ এবং তৃতীয় খণ্ডে সাত সর্গ। মোট ষাট সর্গে প্রায় নয়শ’ পৃষ্ঠার ছিল এই কাব্য। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধযজ্ঞকে রূপায়িত করতে গিয়ে কবি বিশাল কাহিনী, ভয়াবহ সংঘর্ষ, গগনস্পর্শী দম্ভ এবং মর্মভেদী বেদনাকে নানাভাবে চিত্রিত করেছেন।

বিশালতার যে মহিমা রয়েছে তাকেই রূপ দিতে চেয়েছিলেন তিনি এই কাব্যে। ‘মহাশ্মশান’ এককথায় ঐতিহাসিক প্রণয় কাহিনী বা ঐতিহাসিক ট্রাজেডির রূপ পেয়েছে। মানুষের দেহাশ্রিত কামনা বাসনার যে ব্যাপক ও গভীর অভিব্যক্তি সমসাময়িক কালের কথাসাহিত্যে পাওয়া যায় কবির শিল্পী মন নিজের অজ্ঞাতেই তা স্বীকার করে নিয়েছে। এই কাব্যে বীরবৃন্দ পানিপথ যুদ্ধের মহা আয়োজনে ব্যাপৃত। দেশের জন্য ধর্মের জন্য, স্বজাতির জন্য তাদের উৎকন্ঠার শেষ নেই। আসন্ন সংঘাতের ভাবনা তাদের বিচলিত করেছে কিন্তু সবচেয়ে বড় দূর্ঘটনা ঘটেছে তাদের হৃদয়ে। নারীর প্রতি হৃদয় ব্যপৃত তবু কবির সচেতন মন দেশপ্রেম ও স্বজাত্যবোধকে জাগ্রত করার প্রয়াস পেয়েছেন কাব্যটিতে। দেশ ও জাতির সংকটে ইতিহাস শক্তিশালী প্রেরণাদাত্রী হতে পারে তা কবি অনুভব করেছিলেন হৃদয় দিয়ে। তাই দেশ ও জাতির পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে কবি ইতিহাসের দ্বারস্থ হয়েছেন এবং লিখেছেন ‘মহাশ্মশান’। কায়কোবাদ শুধু আত্মপ্রত্যয়ী কবি নন, আত্মসচেতন ও আত্মসন্ধানী কবিও বটে। ‘মহাশ্মশান’ কাব্যের বিষয়বস্তু নির্বাচনে তিনি শুধু স্বাতন্ত্রবাদীতা, মৌলিকত্ব ও অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা নয় এক্ষেত্রে তার সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিক ঔদার্যের পরিচয় মেলে। উনিশ শতক পুনর্জাগরণের যুগ। এই পুনর্জাগরণ বাঙালী হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যেমন একই সময়ে আসেনি তেমনি মানসিকতার দিক থেকেও ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি।

কায়কোবাদের কবি মানস সর্বদাই সংকটের গভীরে পৌঁছানোর মত প্রজ্ঞা ও সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কার্যকর ছিল। একজন মুসলিম হয়েও সর্বপরি তিনি ছিলেন বাঙালী, তাঁর দৃষ্টিতে বাঙালী জাতির ঐতিহ্য মানে হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য। দেশকে শৃঙ্খলামুক্ত করতে হলে হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত জাগরণ ও প্রয়াস প্রয়োজন, একারণে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি কামনা তার কবি-মানসের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর মুলে রয়েছে কবির সুন্দর, উদার ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং গভীর দেশপ্রেম।

কায়কোবাদের ইতিহাস চেতনা এই বৈশিষ্ট্যে তাৎপর্যমন্ডিত। জাতীয় জীবনের বিপর্যয় থেকে জাতিকে রক্ষার তাগিদে কবি ‘মহাশ্মশান’ রচনা করতে গিয়ে এমন এক ঐতিহাসিক ঘটনাকে বেছে নিলেন যে ইতিহাসে হিন্দু মুসলমান উভয় জাতিই বীরত্বে, দেশপ্রেমে, আত্মত্যাগে ও সাহসিকতায় অনন্য। কাব্যের মধ্যেও কবি উভয় জাতিকেই সমান গুরুত্বে ও মর্যাদায় এঁকেছেন। পরিণতিতে জয়-পরাজয় আছে বটে, কিন্তু তা কবির কাছে প্রাধান্য পায়নি। কারণ কবি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন একটি জাতির স্বত্তা, অস্তিত্ব নির্মিত হয়েছে প্রধান যে দুটি সম্প্রদায়কে নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে উভয়ই প্রায় বিধ্বস্ত ও নিঃশেষ হয়ে গেছে। কাজেই সাময়িক জয় পরাজয় সূচিত হলেও,সামগ্রিকভাবে জাতিটির ধ্বংশস্তূপ রচিত হয়েছে এই ‘মহাশ্মশানে’। যে কারণে অচিরেই দেশ পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ হয়েছে।

এ বাস্তব সত্য অনুধাবন করেছিলেন বলেই কবি ইতিহাসকে আশ্রয় করে কাব্য রচনা করেছিলেন জাতির পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে জাতিকে আহবান করেন কবি, তবে এই আহবান শুধু তার স্বজাতির জন্য নয় বরং তিনি চেয়েছেন সমগ্র বাঙালী জাতির পুনর্জাগরণ।এখানেই কবির চিন্তাধারার স্বাতস্ত্র্য, গভীর উপলব্ধির প্রকাশ। যা সত্যিই তাঁর যুগ তাঁর শিক্ষার প্রেক্ষিতে অসামান্য অতুলনীয় ও বিস্ময়কর। তাঁর ইতিহাসচেতনা অনেক বেশি প্রাগ্রসর, প্রখর দূরদর্শিতায় উজ্জ্বল, যা সমকালের হিন্দু মুসলমান কেউই উপলব্ধি করতে পারেনি।

তিনি তাঁর এ কাব্যে যে আবেগে মুসলমানদের মনোবেদনা বর্ণনা করেছেন, সেই নিষ্ঠায় তিনি হিন্দুদের মনোবেদনাও বর্ণনা করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, হিন্দুদের দুর্বল করে অঙ্কন করলে শক্তিমান মুসলমানের কোন গৌরব নেই। কেননা, শৃগালের সঙ্গে যুদ্ধে সিংহের কোনো গৌরব নেই।

মুখ্যত গীতিকবিতায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার গীতিকবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ ও আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ পেয়েছে। কায়কোবাদের কাব্যসাধনার মূল উদ্দেশ্য ছিল পশ্চাৎপদ বাঙালী মুসলমান সম্প্রদায়কে তার ঐতিহ্য ও ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন এবং উদ্বুদ্ধ করা। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী, যার প্রকাশ ঘটেছে তার বিভিন্ন রচনায়। তিনি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। ১৯৩২ সালে কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের মূল অধিবেশনে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলা কাব্য সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য নিখিল ভারত সাহিত্য সঙ্ঘ তাকে কাব্যভূষণ, বিদ্যাভূষণ ও সাহিত্যরত্ন (১৯২৫) উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৫১ সালের ২১ জুলাই ৯৪ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। আজিমপুর কবরস্থানে তিনি চিরশয্যায় শায়িত।

এই দীর্ঘ জীবনে তাঁর সাহিত্য দর্শনে খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায়নি। বিশ শতকের পরিবর্তিত পরিবেশে অবস্থান করেও তিনি ছিলেন ঊনিশ শতকীয় সাহিত্যাদর্শ ও সাহিত্য রীতির অনুসারী। অনন্য সৃজন-সৃষ্টির জন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনন্তকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন কবি কায়কোবাদ।

বাঙালীয়ানা/এসএল

কবি কায়কোবাদের কয়েকটি কবিতা পড়ুন এখানে।

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.