‘আই অ্যাম আ কমিউনিস্ট, আই বেয়ার ইট ইন মাই নেম’ । সাগর লোহানী

Comments
সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২০ সালের ২৬ আগষ্ট ঢাকার বিক্রমপুরে জন্মগহণ করেন। তাঁর মা ছিলেন সিনিয়ার কেমব্রিজ পাশ করা প্রথম মহিলা স্কুল ইন্সপেকট্রেস সুনীতি দেবী, বাবা জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নবাবী স্টেটের উচ্চপদস্থ চাকুরে। মুন্সিগঞ্জের কাজি পাগলা এ.টি. ইনস্টিটিউট থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ঢাকার পোগোজ স্কুল ও পরে সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ পাস করেন সাম্যময়। স্নাতকে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
Bhanu 07ছেলেবেলা থেকে প্রখর রাজনীতি সচেতন। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। ঢাকায় ‘অনুশীলন সমিতি’র সদস্য ছিলেন। ১৯৪০ সালে ‘আরএসপি’ নামে একটি বামপন্থী দল গঠিত হয়, সেখানে যোগ দেন সাম্যময়। রাইটার্স বিল্ডিং “অলিন্দ যুদ্ধ” এর শহীদ বিনয় ও দীনেশের সহযোদ্ধা ছিলেন সাম্যময়। দীনেশ গুপ্তকে তিনি ঈশ্বরজ্ঞানে গুরু মানতেন। তাই তো জীবনের শেষ সময়েও ওঁদের মৃত্যুদিনে রাইটার্সে গিয়ে ওঁদের ছবির সামনে নতজানু হয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়াতেন। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত তাঁর মননে এক আশ্চর্য প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। দীনেশের মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন,- ‘ভগবান! তোমার লীলা বোঝা ভার! একটা ব্যাপারে তোমার উপরে আমার ভীষণ রাগ- তুমি আত্মার নিজস্ব কোনও শক্তি দিলেনা কেন? দিলে দীনেশ দার আত্মা এখনকার বাকসর্বস্ব, অসত্‍ রাজনীতিওয়ালাদের মুন্ডু ছিঁড়ে ফেলতেন!’
বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের সহযোগী হিসেবে ১৯৪১ সালে পুলিশের রোষে পড়লেন। গোপন বিপ্লবী বই, গোপনে অস্ত্র নিয়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার জন্যে শেষ পর্যন্ত ঢাকা শহর ছেড়ে বন্ধুর গাড়িতে ব্যাকসিটের পাদানিতে শুয়ে সাম্যময় চলে গেলেন কলকাতায়। আয়রন অ্যান্ড স্টিল নামে একটি কোম্পানীতে যোগ দেন এবং বালিগঞ্জের অশ্বিনী দত্ত রোডে তাঁর বোনের কাছে দু’বছর থাকার পর টালিগঞ্জের চারু অ্যাভিন্যুতে বসবাস শুরু করেন।
সেই সময় থেকেই তিনি বিভিন্ন অফিস ও ক্লাবের অনুষ্ঠানে কৌতুক নকশা পরিবেশন করতে শুরু করেন এবং রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সেই জনপ্রিয়তায় তিনি ১৯৪৩ সালে ‘ঢাকার গাড়োয়ান’ নামে একটি কৌতুক নকশার রেকর্ড বের করলেন।

যখন তিনি ঢাকায় ছাত্র, পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর খুব স্নেহ করতেন ক্ষুরধার বুদ্ধিমান সেই কিশোরকে। তাঁর জন্মদিনে বাঘা বাঘা বৈজ্ঞানিক বন্ধুরা যখন বাড়িতে আসতেন, ডাক পড়ত সাম্যময়ের। সে একের পর এক কৌতুক নকশা বলে অমন সব জ্ঞানী-গুণী অধ্যাপকদের আমোদ দিতেন! আমৃত্যু অধ্যাপক বোসের এই স্নেহ অটুট ছিল। ছাত্র যখন নামকরা চিত্রতারকা, তখনও মাঝেমধ্যেই মাস্টারমশাইয়ের স্নেহের ডাক পেতেন, ‘ওরে, মাথা যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল আমার, আয় একটু রস ঢেলে দিয়ে যা!’

কলকাতায়  অভিনয়শিল্পী সাম্যময় প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন ১৯৪৬ সালে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নামে একটি নাটকে চাণক্যের ভূমিকায়। তবে শোনা যায় অভিনয়ে তাঁর হাতে খড়ি হয় ছোটবেলায়, ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালীনই। সেসময় তিনি ‘রণবীর’ নামের একটি নাটকে অভিনয় করেন। কলকাতায় অপেশাদার নাট্যমঞ্চে প্রথম নাটক ‘নতুন ইহুদী’ অভিনয় করেন ১৯৪৮ সালে। পরে ‘বনবীর’ নাটকে দাপুটে অভিনয় করেন তিনি। পেশাগতভাবে প্রথম মঞ্চাভিনয় ১৯৫০ সালে ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ নাটকে। ভানু কোনোদিনই ভাবেননি যে তিনি চলচ্চিত্রে অভিনেতা হবেন। বরং মঞ্চে অভিনয়ের দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল সবচেয়ে বেশি।

এরই মধ্যে ১৯৪৬ সালে সাম্যময় বিয়ে করেন বেতার শিল্পী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বিয়ের তিনদিন পরেই প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান ভানু। ছবির নাম ছিল ‘জাগরণ’। হ্যাঁ, এই সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়ই বাঙালীর প্রিয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

Bhanu 10

জহর রায় ও অজিত চট্টোপাধ্যায়ের সাথে ভানু

চলচ্চিত্রে তাঁর অনুপ্রেরণা ছিলেন ‘চার্লি চ্যাপলিন’। তাঁর টালিগঞ্জের বাড়িতে একটি বড়সড় চার্লি চ্যাপলিনের ছবিও ছিল। প্রায় প্রতিদিনই তিনি গ্রেট ডিক্টেটর’ দেখতেন। কেঁদে ফেলতেন ‘গোল্ড রাশ’ ,’লাইম লাইট’ দেখে।

সমাজতন্ত্রের আদর্শে গভীর বিশ্বাস ছিল, গর্ব করে বলতেন, ‘আমার মায়ের বাবা আমার নাম রেখেছিলেন সাম্যময়… আই অ্যাম আ কমিউনিস্ট, আই বেয়ার ইট ইন মাই নেম।’

সেই চেতনায় শিল্পীদের স্বার্থরক্ষায় সংগঠন তৈরি করেছেন অভিনয়জীবনের মধ্যগগনে থাকার সময়েই। ইন্দ্রপুরী ষ্টুডিওতে যখন ধর্মঘট চলছিল, তখন অন্যান্যদের সঙ্গে তিনি ও অভিনেতা ছবি বিশ্বাস যুক্ত হন ‘সিনে টেকনিশিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’-এর আন্দোলনে। সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির রিলিজ় নিয়ে জটিলতা তৈরি হলে পরিচালকের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দৃঢ়ভাবে।

Bhanu 11

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে সুচিত্রা সেন ও উত্তম কুমার

প্রযোজকদের একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়নো, প্রথমে ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ ও পরে ‘শিল্পী সংসদ’-এর পুরোভাগে থেকে টানা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কারণে একটা সময় বছর পাঁচেক তাঁকে ব্ল্যাক লিস্ট করে দেওয়া হয় চলচ্চিত্র জগতে। কোনও প্রযোজক-পরিচালক সে সময় তাঁকে কাজ দিতেন না। কিন্তু তিনি আপোসের রাস্তায় না হেঁটে ছায়াছবি ছেড়ে জোর দেন জলসা, কৌতুক নকশার রেকর্ড, যাত্রা, বোর্ড থিয়েটারে। তার আগেই চাকরি ছেড়েছেন, তিন সন্তানের পড়াশোনা, সংসার সব কিছু সামলাতে প্রচন্ড পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁকে, শরীর খারাপ হয়েছে, কিন্তু হার মানেননি।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতুক নকশা যত মানুষের কাছে পৌঁছেছে, তার এক শতাংশ মানুষও তাঁর জীবনভর সংগ্রামের কথা জানেন না। সর্বোপরি, চিরকাল আড়ালে থেকে গিয়েছে তাঁর ক্ষুরধার মেধা। তাঁর লেখা প্রবন্ধ পড়লে বা পুরনো সাক্ষাৎকারের পাতা উল্টালে তার সামান্য আঁচ পাওয়া যায় মাত্র।

Bhanu 05

জহর রায়ের সাথে

ভানুর সহশিল্পীদের প্রতি যে অগাধ ভালোবাসা তার প্রকাশ রয়েছে তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনায়। সুশীল চক্রবর্তী নামে এক উঠতি কমেডিয়ান। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতেন। মোটামুটি নামডাক ছিল। শিল্পীমহলে অনেকেই চিনতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কমেডি করতে যেতেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল রেকর্ড বের করার। কিন্তু HMV কোম্পানী ভানু ছাড়া অন্য কাউকে নিয়েই আগ্রহী নয়। বারবার প্রত্যাখ্যাত সুশীলবাবু HMV-অফিস থেকে ফিরে একদিন মরিয়া হয়ে চলে গেলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। দরজা খুলে সুশীলবাবুকে দেখে ভানু প্রশ্ন করলেন, ‘কী হইল? তোমার মুখখানা ওমন শুকনা দেখাইতাসে ক্যান?’

সুশীল বললেন, ‘দাদা আপনাকে ছাড়া HMV কারোর রেকর্ড করতে চায় না। আমার অনেক দিনের আশা আমি একটা রেকর্ড করি।’
ভানু ফোন তুলে HMV-র এক কর্তাকে বললেন, ‘এবার পূজায় আপনাগো ওখান থিকা রেকর্ড করুম না। আপনারা জুনিয়র আর্টিস্টগো লগে দুর্ব্যবহার করেন।’
HMV-র সেই কর্তা তাঁকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন। সব শুনে ভানু বললেন, ‘হেইসব কথা আমি শুনতে রাজি নই। আমার শর্ত যদি আপনারা মানেন, তবেই পূজায় রেকর্ড করুম। নয়তো গুডবাই।’ শেষ পর্যন্ত ভানুর ওই হুমকিতে কাজ হল। কমেডি রেকর্ড বেরোল সুশীল চক্রবর্তীর।

এক শিল্পী রেকর্ড বের করতে নিজে সরে দাঁড়ানোর হুমকি রেকর্ড কম্পানিকে। এটা সে যুগেই সম্ভব ছিল। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষেই সম্ভব ছিল।

Bhanu 12

মুসাফির ছবির প্রিমিয়ারে ভানু বন্ধোপাধ্যায়ের সাথে সুচিত্রা সেন দীলিপ কুমার, এবং সুশীল মজুমদার।

বাংলায় নিজে একাই স্ট্যান্ড আপ কমেডিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যান ভানু। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে বসে একের পর এক স্কিট লিখতেন। তাঁর সঙ্গে কখনও কখনও সে সব কৌতুকাভিনয়ে গলা মিলিয়েছেন কন্যা বাসবী ঘটকও। লেখার পর প্রথমেই বাড়ির সবাইকে শোনাতেন তাঁর নকশা। কন্যা স্মৃতিচারণে বলছেন, ‘‘আমাদের পরিবারে চালু একটা ধারণা ছিল, যে সব কৌতুক নকশা শুনে আমরা খুব একটা খুশি হতাম না, সেগুলোই নাকি দারুণ হিট হত!’’

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এক কৌতুক নাটকে বললেন,

ভানু: আমি ত বাঙাল। আপনে কি?
অন্য চরিত্র: আমি আবার কি? বাঙালী।
ভানু: তাইলে কি খাড়াইল?
অন্য চরিত্র: কি আবার খাড়াইল?
ভানু: কথাডারে ব্যাকরণে ফেলান। আমি হইলাম বাঙাল আর আপনে হইলেন বাঙালী। তার মানে আমি হইলাম পুংলিঙ্গ আর আপনে হইলেন স্ত্রীলিঙ্গ।

জনপ্রিয় এই ব্যাখ্যাটি বঙ্গ জীবনে হাস্যরসের মোড়কে উপস্থাপন করেছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘হালায় তয় যুদ্ধেই যামু না’, ‘মাসীমা মালপো খামু’, ‘টিনের বাক্সে বারো টাকা’, ‘নাগো মিনু আমাগো থার্মোমিটারও নাই, বার্নলও নাই’, ‘দ্রিমু য্রখন ত্রখন স্রব ত্রাইতেই দ্রিমু’… এমন হাজারো সংলাপ বাঙালীর মুখে মুখে ফিরত এক সময়!

Bhanu 01

উত্তম কুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে অনুষ্ঠানের ফাঁকে

সাফল্য করায়ত্ত হওয়ার পরেও অনুশীলনে ফাঁকি দেওয়ার কথা ভাবতেও পারতেন না। রেডিওয় যখন কাজ করা শুরু করেছিলেন, তখন লাইভ টেলিকাস্টের ব্যবস্থা ছিল। মূল অনুষ্ঠানের আগে অন্তত বার চারেক রিহার্সাল দেওয়ার অভ্যেস ছিল তাঁর। লাইভ অনুষ্ঠান যখন উঠে গেল, রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে সব ভুল-ত্রুটি সারিয়ে নেওয়াটা হয়ে গেল অনেক সহজ, তখনও নাকি ওই চারদিনই রিহার্সাল দিতে ছুটতেন! নিজেই স্বীকার করেছেন, রেডিও থেকে প্রাপ্ত টাকায় তাঁর গাড়ির তেল খরচাটুকুও উঠত না, বেশিরভাগ সময়ে সহ অভিনেতারাও কেউ আসতেন না, কিন্তু তিনি ঠিক যেতেন। মঞ্চ ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। কারণ তৎ‍ক্ষণাৎ বোঝা যেত দর্শকের পছন্দ-অপছন্দ।

তাঁর কন্যা বাসবী বলছেন, ‘‘বাবা প্রতিটি অনুষ্ঠান নাটক বা যাত্রার জন্য মঞ্চে ওঠার আগে খুব ছটফট করতেন, টেনশন হত ওঁর। প্রতিবার মঞ্চে উঠতেন প্রথম দিনের অস্থিরতা নিয়ে। নিজেই বলতেন, ‘যেদিন এটুকু থাকবে না, সেদিন শিল্পী হিসেবে আমি শেষ হয়ে যাব!’’’ পি জি উডহাউসের লেখা আর চার্লি চ্যাপলিনের ছবির খুব বড়ো ভক্ত ভানু যখন নাটক বা সিনেমায় অভিনয় করেছেন, তখনও ভরসা রেখেছেন চার্লির বোধের উপরেই। নিজেই লিখেছেন, “আমি বিশ্বাস করি, পরিবেশন ঠিক মতো হলে সাধারণ মানুষ সেটা উপলব্ধি করতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, চার্লি চ্যাপলিনের কোনও ছবিই সাধারণ মানুষের দুর্বোধ্য নয়।” তিনি মনে করতেন সমাজের সমস্যাগুলো তুলে ধরার একটা নৈতিক দায়িত্ব থেকে যায় প্রতিটি শিল্পীর, তিনি তাঁর কৌতুক নকশা বা নাটকের মাধ্যমেও সে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন আজীবন।

Bhanu 13

বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের সাথে

অভিনয় ভানুর শুধু পেশা ছিল না, নেশাও ছিল। খুব সময়ানুবর্তী ভানু বাঙাল হিসেবে গর্বিত ছিলেন। তাই তো ‘আমি ঢাকার ভানু’ বাঙালদের মুখে মুখে শোনা যেত। সারা জীবনে একটি বিষয়ে তাঁর অহঙ্কার ছিল, বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস, কবি মোহিতলাল মজুমদার, কবি জসীমুদ্দিন, ডা. রমেশচন্দ্র মজুমদারদের মতো দিকপাল মাস্টারমশাইদের কাছে পাওয়া স্নেহ-ভালোবাসাই ছিল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সে অহংকারের বিষয়। ঢাকার কনভেন্ট স্কুলে লেখাপড়ার সময় থেকেই সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী ভানু অবলীলায় মেলামেশা করতেন ঢাকার গাড়োয়ানদের সঙ্গে। তাঁদের বিচিত্র রসবোধ তাঁর বিবিধ নকশার খোরাক জোগাত।

১৯৭০-এ সুনীল নাট্য সংস্থা কিনে নিয়ে ‘সুনীল নাট্য কোম্পানী’ প্রতিষ্ঠা করেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৭৪-এ আরও একটি যাত্রা দল গঠন করেন ‘মুক্তমঞ্চ’ নামে। এই দল নিয়েই গ্রামে গঞ্জের মাঠে মাঠে যাত্রা করে বেড়াতেন। ১৯৭৮ পর্যন্ত এই দুটি দল নিয়ে ‘গোপাল ভাঁড়’, ‘বৈকুন্ঠের উইল’, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘ভৈরব মন্ত্র’, ‘শ্রীযুক্ত আলিবাবা’ ইত্যাদি পালায় মাতিয়ে তুলেছিলেন গ্রামবাংলা রাতের পর রাত।

জনপ্রিয়তায় তিনি সমানে সমানে টেক্কা দিতেন উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেনের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তের জলসা বা বিচিত্রানুষ্ঠানের আসরে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত ভানুকে নিয়ে। তাঁকে দেখার জন্য ভিড় জমিয়ে আসত সাধারণ মানুষ।

Bhanu 03

অভিনয়ে সুচিত্রা সেনের সাথে

শুধু সিনেমা নয়, খেলার জগত ছিল তার খুব প্রিয়। খেলা বলতে ফুটবল। ভানু ছিলেন ইস্টবেঙ্গল অন্তপ্রাণ। তাঁর ছেলে গৌতম স্মৃতিচারণে বলছেন, ‘ক্লাইভ রো-তে যখন ‘আয়রন অ্যান্ড স্টিল’-এ চাকরি করত, ইস্টবেঙ্গলের খেলা মানেই অফিস ‘কাট’! মেম্বরশিপ গেটে দাঁড়িয়ে গেটও ম্যানেজ করেছে বাবা। মাঝে মাঝে শচীনদেব বর্মন আর হিমাংশু দত্ত আসতেন মাঠে। শচীনকর্তা বাবার প্রাণ! হাফটাইমে বাবা নিয়ম করে ওঁর হাতে তুলে দিতেন একটা সিগারেট, এক খিলি পান আর এক প্যাকেট চিনে বাদাম।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম দিকের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মাঝে ‘মন্ত্রমুগ্ধ’ (১৯৪৯), ‘বরযাত্রী’ (১৯৫১) এবং ‘পাশের বাড়ি’ (১৯৫২) খুব জনপ্রিয় হয় তবে সিনেমার জগতে ভানুর প্রথম বাণিজ্যিক সফল ছবি নির্মল বসুর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ (১৯৫৩)। এই ছবিটি বাংলা কমেডি সিনেমার ইতিহাসে একটি অন্যতম মাইলস্টোন। এই ছবিতেই বাজি মাত করেন ভানু। এরপরের বছরই মুক্তি পায় ‘ওরা থাকে ওধারে’। ১৯৫৮ সালে ‘ভানু পেল লটারি’এবং ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’। ১৯৫৯-এ মুক্তি পায় ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’, এই ছবিতে ভানু নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করেন, বিপরীতে ছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা। ১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘৮০তে আসিও না’ ছবিটিতেও ভানু নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করেন, এবং এখানেও বিপরীতে ছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পায়, ‘মিস প্রিয়ংবদা’ – যেখানে উনি চরিত্রের প্রয়োজনে মহিলা সেজে অভিনয় করেন। বিপরীতে ছিলেন লিলি চক্রবর্তী। ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’ মুক্তি পায় ১৯৭১ সালে। শেষ ছবি ‘শোরগোল’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৪-তে।

Bhanu 06

জহর রায়ের সাথে চলচ্চিত্রে

সেকালের শীর্ষ প্রতিষ্ঠিত অভিনয় ও চলচ্চিত্র তারকাদের কাছে তিনি ছিলেন অসম্ভব প্রিয়। তাঁর ৪২এ চারু অ্যাভিনিউ বাড়িতে কে না আসতেন! উত্তমকুমার, রবি ঘোষ, অনুপকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ রায়, বিকাশ রায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়সহ আরও কত শিল্পী।

তাঁর ছেলে গৌতম বাবার শেষ জীবনের কঠিন বাঁক ষাটের দশকের শেষে বলেই মনে করেন। তিনি বলছেন, ‘অভিনেতৃ সংঘ’-য় ফাটল ধরল উত্তমকাকু, অনিলকাকুদের (চট্টোপাধ্যায়) বেরিয়ে যাওয়ায়। পাল্টা সমিতি ‘শিল্পী সংসদ’ তৈরি হল। খুব কষ্ট পেয়েছিল বাবা। বাবার প্রথম হার্ট অ্যাটাকটা তখনই।  তবু মাথা নোয়ায়নি। এর ফলেই ব্ল্যাক লিস্টেড হলেন। যে জন্য বহু দিন কাজ পেত না। এ দিকে সংসার চালাতে হবে যে! তখন যাত্রা একমাত্র সম্বল। কোথায় না কোথায় গেছে তখন যাত্রার জন্য! যে লোকটা নরম বিছানা ছা়ড়া ঘুমোতে পারত না, সে কিনা মাটিতে চাটাই পেতে রাত কাটিয়েছে। ভাঙা বাড়িতে রাতে আশ্রয় নিয়েছে। বুকের ওপর পাখা ভেঙে পড়েছে। তবু শক্ত চোয়াল আলগা হতে দেয়নি। ’৭৯ থেকে বাবার শরীরটা খুব ভাঙছিল। বড্ড রোগা হয়ে যাচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ করল।

’৮৩-র ফেব্রুয়ারী। এত অসুস্থ হল যে, সিএমআরআই-এ ভর্তি করতে হল। সে বার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল। কিন্তু মার্চের ৪ তারিখে আবার অসুস্থ। বুকে অসহ্য ব্যথা। এবারও ভর্তি না করে উপায় নেই। তবে বাইরে থেকে দেখে বোঝে কার সাধ্যি! সোজা হেঁটে হেঁটে গাড়িতে উঠল। ভর্তি হল উডল্যান্ড হাসপাতালে। রাতও পেরোল না, চলে গেল বাবা। একটা মাত্র দিনও কেউই কিছু করার সুযোগটুকুও পেল না!

১৯৮৩ সালের ৪ মার্চ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় মাত্র ৬২ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন।

Bhanu 02

জহর রায়ের সাথে

এই পাহাড়সম অভিনয় ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে চলচ্চিত্রে তাঁর সহকর্মীরা কেমন ভাবে মূল্যায়ন করেছেন তা দিয়েই শেষ করি ভানু তর্পণ।

চলচ্চিত্র পরিচালক তপন সিনহা বলছেন, ‘আমার মনে হয় ভানুবাবু কমেডিতে একটা ধারার প্রবর্তন করেছেন। ভাঁড়ামো না করে হাস্যরসের সারবস্তুটিকে সঠিক ও সপ্রতিভভাবে প্রযুক্ত করাই তাঁর লক্ষ্য। তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ এক নতুন স্কুলিং সৃষ্টি করেছেন।’

অভিনেতা বিকাশ রায় বলছেন, ‘ভানু ইজ ইকোয়াল টু কমেডি প্লাস সিরিয়াস! আর আমি ইজ ইকোয়াল টু সিরিয়াস। লজিকের হিসাবে ভানু আমার চেয়ে বড় অভিনেতা। ওকে বলি না বটে কিন্তু আপনাদের কাছে এই শেষ বয়সে কথাটা স্বীকার করে গেলাম।’

অভিনেতা তরুণ কুমার মনে করেন, ‘ভানুদা সুদক্ষ ও ক্ষমতাবান অভিনেতা। তবেই না লেখক তাঁর নামে গল্প লেখেন, ‘ভানু গোয়েন্দা, জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’। এটা একটা জ্বলন্ত প্রমাণ। অনেক কৌতুক অভিনেতা আসবেন, যাবেন। কিন্তু চলচ্চিত্র, নাটক এবং যাত্রার ইতিহাসে ভানুদার নাম মুছে যেতে শতাব্দী পেরিয়ে যাবে। কেননা, ভানুদা, ভানুদাই।’

তথ্য ও ছবি সূত্র: ফেমিনা, আনন্দবাজার, ডেইলি হান্ট ও বাঙালীয়ানা
লেখক: সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা
(২০১৮ সালে ভুলক্রমে বাঙালীয়ানার একটি ফিচারে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম তারিখ ২৭ আগষ্ট উল্লেখ করায় আমরা দুঃখিত। -সম্পাদক)

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.