ঢাকার পুরানা পল্টনের দুটি নম্বর, দুটি ঠিকানা, দুটি বাড়ি আমাকে, আমার মতো আরো অনেককে খুব টানতো। ১০ পুরানা পল্টনে ছিল ছাত্র ইউনিয়ন অফিস। আর ২১/১ পুরানা পল্টনে কমিউনিস্ট পার্টির অফিস। কত দিন, কত ঘন্টা যে আমরা অনেকে ওই দুই অফিসে কাটিয়েছি, তার হিসাব নেই। কবিতা লেখা আর প্রেমে পড়া নাকি বাঙালি তরুণদের সহজাত। কবিতা লেখার ব্যর্থ চেষ্টা করেছি । প্রেমেও পড়েছি। তবে কোনো মানবীর নয়, রাজনীতির। নারী প্রেমেও যে কেউ কিউ পড়েন নি তা নয়। তবে তা ছিল একান্ত আপন এবং পোপন। আহা, সেই সব দিনগুলো। সোনা রঙের সেই দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল। ১০ পুরানা পল্টনে ছাত্র ইউনিয়ন অফিস ছিল ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত। সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘জয়ধ্বনি’ অফিসও ছিল। ছাত্রদের একটি নিয়মিত পত্রিকা, যার প্রকাশনার দায়িত্ব ছাত্রদের, জয়ধ্বনি ছাড়া এ দেশে তার দ্বিতীয় নজির নেই। অন্য দেশেও বেশি আছে বলে মনে হয় না।
১৯৭৩ সালে ঢাকা এসে খুব দ্রুত আমি জয়ধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। প্রথমে জয়ধ্বনির সম্পাদক ছিলেন আব্দুল কাইয়ুম মুকুল। পরে সম্পাদক হন অজয় দাশগুপ্ত। ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় নেতাদের কয়েকজনকে নিয়ে একটি সম্পাদকীয় বোর্ড ছিল। এছাড়া চার/পাঁচ জনের একটি টিম জয়ধ্বনি প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সবাই ছাত্র। আমি যাদের পেয়েছি তাদের মধ্যে ছিলেন মনিরুজ্জান লস্কর বাদল, তার ভাই জুয়েল, আকম নূর হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রহমানও আমাদের টিমে ছিলেন। সব মিলিয়ে কি জমজমাট সময় ছিল তখন। ১০ পুরানা পল্টন ছিল আমাদের কাছে নেশার মতো। দিনে এক চক্কর না দিলে পেটের ভাত হজম না হওয়ার অবস্থা।
২১/১ পুরানা পল্টনের কমিউনিস্ট পার্টি অফিসও ছিল আমাদের আর এক বড় আকর্ষণ। আমরা বলতাম, বিপ্লবের লাল দূর্গ। যেখানে বসে মণি সিংহ-আব্দুস সালাম-খোকা রায়-অনিল মুখার্জি-জ্ঞান চক্রবর্তী-অজয় রায়-মোহাম্মদ ফরহাদ-সাইফউদ্দিন মানিকেরা হৃদয়ের উত্তাপ দিয়ে বিপ্লবের বাষ্প তৈরি করে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টায়রত। সে বাষ্পতাপ একবার শরীরে না নিয়ে কি হলে ফেরা যায়? কমিউনিস্ট পার্টি অফিস এখনও ২১/১ নম্বরে থাকলেও আগের অবস্থায় নেই। যেমন আগের অবস্থায় নেই আমি, আমার মতো আরো অনেকে। কমিউনিস্ট পার্টির একতলা হলুদ বাড়িটি এক সময় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রধান ঠিকানায় পরিণত হয়েছিল। এখন মাঝখানে দেওয়াল তুলে দুই দিকে দুই বিরাট ভবন তৈরি হয়েছে। একদিকে কমিউনিস্ট পার্টি, অন্যদিকে সাবেক কমিউনিস্টরা মণি সিংহ ও মোহাম্মদ ফরহাদের নামে ট্রাস্ট গঠন করে দখলিস্বত্ব কায়েম করে আছেন। ঠিকানা আছে অপরিবর্তিত, কেবল যাওয়া-আসা কমেছে পুরনো মানুষদের। নতুনদের আনাগোনাও কি খুব বেড়েছে? জানি না।
ছাত্র ইউনিয়ন অফিসের সঙ্গে লাগোয়া ছিল মরণচাঁদের মিষ্টির দোকান, ওই দোকান এখনও আছে। তখন ছাত্র ইউনিয়ন অফিস থেকে বের হয়ে মরণচাঁদ পার হতে গিয়ে দোকানের ভেতর কাঁচঘেরা আলমারিতে থরেথরে সাজানো বিভিন্ন রকম মিষ্টির থালা দেখে মনে হতো, আহ, সব পদের একটি করে মিষ্টি যদি খেতে পারতাম ! পকেটে হাত দিয়ে মনের ইচ্ছাটা চাপা দিতাম। ছাত্র ইউনিয়ন অফিসের উল্টোদিকে রাস্তার ওপারে ছিল তখনকার খুব নাম করা ফ্ল্যামিঙ্গো রেস্টুরেন্ট। আমাদের কেউ কেউ, বিশেষ করে যাদের মেয়ে বন্ধু ছিলো, তাদের একটু বেশি যাতায়াত ছিলো ফ্ল্যামিঙ্গোতে। নিজের পয়সায় ফ্ল্যামিঙ্গো যাওয়ার সাধ্য আমার ছিলো না। তবে কোনো না কোনো বন্ধুর সৌজন্যে ফ্ল্যামিঙ্গোতে গিয়েছি। বিশেষ করে মনে আছে কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান কমপক্ষে দুদিন আমাকে এবং তানভীরকে ( তানভীর মোকাম্মেল, একুশে পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা ) ফ্ল্যামিঙ্গোতে নিয়ে খাইয়েছিলেন, বেশ কিছু সময় আড্ডায় মেতে ছিলেন। তানভীর ঢাকা কলেজে শওকত ওসমানের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। ছাত্রকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে শিক্ষকের আড্ডা – হ্যা, শওকত ওসমান অমনই ছিলেন।
কমিউনিস্ট পার্টি অফিসের আগেই ছিলো ম্যানডারিন নামের চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। প্রথম দিকে শুধু বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরের দৃশ্য কল্পনা করতাম। আর মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যে, আমারা হলাম মস্কোপন্থি, চাইনিজ খাবারে আমাদের লোভ থাকতে নেই ! চাইনিজ খাওয়া হয়েছিলো প্রথম সম্ভবত বন্ধু মহসিন আলীর কল্যাণে।।
১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যেতে থাকে। ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকান্ড পরিস্থিতি আমূল পাল্টে দেয়। পরে জিয়ার সময় রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু হলেও পুরানা পল্টনে ছাত্র ইউনিয়ন অফিস আর ফিরে পাওয়া যায়নি। তখন ছাত্র ইউনিয়ন অফিস নেওয়া হয়েছিলো হোসোনী দালানে। জিয়া অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টি অফিস পার্টিকে ফেরৎ দিয়েছিলেন।
২১/১-এ আমাদের সময় কেটেছে তুলনামূলক ভাবে বেশি। আমিতো ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসে মোহাম্মদ ফরহাদের সৌজন্যে কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে সপ্তাহ খানেক রাতও কাটিয়েছি। তখন শেখরদা
( শেখর দত্ত) পার্টি অফিসেই থাকতেন। আমি ফরহাদ ভাইয়ের এলাকা থেকে আসায় একটু বাড়তি খাতির পেয়েছিলাম বলে মনে হয়। তখন আমাদের মনে কতো আশা, কতো স্বপ্ন। দেশে বিপ্লব হবে। সমাজতন্ত্র কায়েম হবে। কতো মিছিল। কতো স্লোগান। কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না। ভাত-কাপড়-জমি-কাজ কমিউনিস্ট পার্টির এক আওয়াজ। আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো। মণি সিংহের বজ্রদীপ্ত ঘোষণা – বাংলাদেশ হবে ১৫তম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কতো আয়োজন। কত প্রস্তুতি। কতো সংগঠন। কতো সংগঠক। কতো বন্ধু। কতো চেনা মুখ।
ম. হামিদ, শহীদুল ইসলাম বাদল, কাজী আকরাম হোসেন, অজয় দাশগুপ্ত, রোকেয়া সুলতানা রাকা, নাজনীন সুলতানা নীনা, রাখী দাশপুরকায়স্থ, আভা দত্ত, নিনু আপা, বিধান বিশ্বাস, আকম জাহাঙ্গীর, কামালউদ্দিন আহমেদ, কামরুল আহসান খান, খায়রুল আহসান খান, মৃণাল সরকার, কার্তিক চ্যাটার্জি, সুরেশ দত্ত, সুলতান আহমেদ, আলতাফ আলী হাসু, মনীরুজ্জামান লস্কর বাদল, খন্দকার শওকত জুলিয়াস, শওকাত হোসেন, নিতাই দাস, খন্দকার ফারুক, আনোয়ারুল হক, এম এম আকাশ, আব্দুল আউয়াল, মাহতাবউদ্দিন, তানভীর মোকাম্মেল, নুুরুল ইসলাম, দিলওয়ার হোসেন, নজরুল ইসলাম, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য , রঞ্জন কর্মকার, জীবন সাহা, বিনায়ক সেন, সাজ্জাদ হোসেন, মোস্তফিজুর রহমান বাবুল, তাহেরউল্লাহ, আরিফুল হক কাবুল, মোসলেহউদ্দিন, নাসিরউদ্দোজাসহ আরো কতো নাম স্মৃতির পাতায় ভাসছে। যাদের নাম লেখার মুহূর্তে মনে আসছে না, আমি নিশ্চিত তাদের কথাও মনে পড়বে, পড়ে। আমাদের যারা আরো সিনিয়র কিংবা পদধারী বড় নেতা তাদের নামতো উল্লেখই করলাম না। এক পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টির কতো প্রভাব। আওয়ামী লীগ, বিএনপির মতো বড় দলের নেতারাও এসে ধরনা দিচ্ছেন কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের চালকের আসনে যেন মোহাম্মদ ফরহাদ, কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। আমাদের বুকে কতো বল। কতো ভরসা।
অকস্মাৎ বজ্রপাত হলো। আমরা বিহ্বল হলাম। চিকিৎসার জন্য মস্কো গিয়ে মোহাম্মদ ফরহাদ ফিরে এলেন শব হয়ে। নক্ষত্রের পতন হলো। অসুস্থ হয়ে শয্যাগত কিংবদন্তী কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ। এতো তারা আকাশে। অথচ সব কেমন নিষ্প্রভ মনে হতে লাগলো। কি থেকে কি হয়ে গেল। যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এ দেশসহ দেশে দেশে অসংখ্য মানুষকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করে তুলেছিলো, সেই মহাপরাক্রমশীল রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট নেতারাও মুখ থুবড়ে পড়লেন। আমার মনে হয়, আমাদের নেতার ছিলেন সোভিয়েতঅন্ধ। অন্ধের হাতে ওয়াকিং স্টিক তুলে না দিয়ে সোভিয়েতের ভেঙ্গে পড়ায় তারা বিভ্রমে পড়েন। তার এতো এতো মানুষের আত্মদান, রক্ত, ত্যাগে গড়া পার্টিটা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে দিলেন। ‘ঐতিহাসিক’ আপসরফায় পার্টি অফিসে দেওয়াল তুলে দিলেন। একদিকে আদি কমিউনিস্টরা লাল ঝান্ডা উড়িয়ে জানান দিচ্ছেন, সব শেষ হয়ে যায়নি। মানুষের শোষণ মুক্তির আশা জেগে থাকবেই। লড়াই জারি রহে গা।
অন্যদিকে মণি সিংহ – মোহাম্মদ ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট। প্রবাদপ্রতিম দুই কমিউনিস্টের নাম জড়িয়ে যারা ট্রাস্ট করলেন তারা আর নিজেদের কমিউনিস্ট বলে পরিচয় দেন না।
হায়, এক জীবনে কতো কি দেখছি। কি চেয়ে কি পেলাম ! কাদের হাতে আমরা আমাদের ভাগ্য সঁপে দিয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো হেলায় হারালাম ! এখন আর পুরানা পল্টনের দিকে খুব একটা যাওয়া হয় না। তবে ফেলে আসা দিনগুলোর জন্য মন কেমন করাটা কাটাতে পারি না। যে পার্টি অফিসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিয়েছি, প্রাণখুলে নানা তর্ক-বিতর্কে অংশ নিয়েছি, সেখানে যেতে এখনও মন চায়। কিন্তু এই ভেবে অস্বস্তি বোধ করি, আমি যে আর কমিউনিস্ট নেই! মার্কসবাদকে আমি আর সব রোগের মহৌষধ মনে করি না। যারা মার্কসবাদে আস্থা রেখে বিপ্লবের স্বপ্ন এখনও জাগিয়ে রেখেছেন তাদের কাছে আমি যে আর বন্ধু নই। তারা বিশ্বাসী, তারা মহৎ। আমি বিশ্বাস রাখতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার চিত্ত দুর্বল। আমি বিত্তবৈভবের পিছনে ছুটিনি। সৎ ভাবে জীবনরক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত। আমার চেয়ে অধম আর কে হতে পারে ! বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহু দূর।
পৃথিবীর রং নাকি আবার বদলাবে। আশায় বুক বাঁধি। কিন্তু হতাশার কারণই বেশি ঘটতে দেখি। দুনিয়াব্যাপী ধর্মোন্মাদনার ঝড়ো হাওয়া। থামানোর পথ দেখা যাচ্ছে কি? কান পেতে শোনার চেষ্টা করি কালের ঘন্টাধ্বনি। কাল বহমান। নিরবধি গতিময়। সব কিছু ভেসে যায় – জীবন, যৌবন, ধন, মান। থাকে তবে কি? থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার নাটোরের বনলতা সেন !
পল্টন যদি আমাদের আবার এক করতে পারতো ! আছে কোনো জাদুর কাঠি?
লেখক:
বিভু রঞ্জন সরকার, সাংবাদিক, কলাম লেখক