একটি পাতার ছাই
নিঃসঙ্গতা এক গহ্বর, জড়িয়ে আছে মাকড়জালে!
অজস্র আঁশ জড়ো করে মাকড়দল হাওয়া
গুহার কণ্ঠনালি চেপে ধরে কবেকার শুকনো জাল, স্বাক্ষর;-ছেঁড়া!
আঁশের সমাবেশ, পাকিয়ে ওঠে গোপনে রশি
মালা জড়িয়ে ধরে আছে আমাদের প্রত্যেকের এক গলা!
মুখভর্তি ধোঁয়া! দূর শীতচুলার বমি
নাকি নির্জন ধুলাদের ওড়াউড়ি
গোপনে বরফের জ্বলে ওঠা ফুসফুস
শাদা আত্মার গান
দিনের বাসি পোশাক ফেলে সাপিনি বুঝি
মাতাল জ্যোৎস্নায় চিকচিকে রাতের পোশাকে চলে গেছে,
সাপের খোঁজে-
যাক, ফাঁসুড়ে ফুসফুসে চিৎপাত
সাপিনির জ্বলন্ত ফসিলচিতা
ফোঁপরা জালে ঝুলে থাকা শুকনো মাকড়
আদতে সময়
মরা রক্তমাংসের ঘড়ি-স্তব্ধতার চাঁই
তাতে সকল সম্পর্ক পুড়ে
একটি পাতার ওপর ওড়ে ছাই

পাথর
দুপুরে ছুড়ে ফেলা হলো তাকে
ধাক্কা দিয়ে, আকাশের চূড়া থেকে
চোখে আগুনের পর্বত
উঠন্ত আঙুল
তার নিচে শুয়ে থাকে সে, একদম পাথর…
ভোররাতে গুঞ্জন, ছুটোছুটি, চাপা ফিসফাস…
তারপর আকাশের প্রহর, একদম জল, চুপচাপ বরফ
আবার কথা। একদম চুপ। একদম পাথর
আবার মেঘ। একদম জল। একদম পাথর
যেন সত্যি সে পাথরের নিচে, লাশ… লাশ…
মুখ থেকে মুখে আবারও গলিয়ে পাথর
অবিরাম লাশ বুনে যায় লাশ
বাড়ির নামায়-দোঁআশ যত্নে, প্রেমে
পাথর থেকে নুড়ি কুটে মরে তার কিষানি

জ্বর
বিদ্যুৎধমকে আঘাত করো খুব, এবং মধুর চাকের মতো মেঘ যাক ফেটে
বৃষ্টি হচ্ছে প্রবল-ওই অশ্রু
রুমাল ছাড়িয়ে ন্যাতানো কাঁথার ভাঁজে ভাঁজে
ঢুকে পড়ে
ঘর মোছা ন্যাকড়া চিবিয়ে এদিকে যতই নামাও, ওদিকে
মেঝেয় গড়ানো জল ততই ঢুকে পড়ে!
চোখ থেকে চোখে…
আকাশের পিছল ঢাল বেয়ে গড়িয়ে মাটির তলায়…
তীব্র আঘাতে মেঘ থেকে নেমে এসে কস
সারারাত, বালতি কাত হয়ে দৌড়ে চলে ঘুমে ঘুমে
পোড়া স্বপ্নে
অশ্রু জমে যেখানে সারাদিন পাথার
তুলার ভেতর ঢুকে পড়া এক প্রবল বর্ষণ, বন্যা গড়িয়ে গোরস্তান-
ওই সারাৎসারে
মৃতের পোড়া চোখও তাকিয়ে রয় যেখানে ফাটা কবরের মতো
যখন বিদ্যুৎধমকে ফেটে যায় বীজ, এবং তুলার স্তূপ জমে ওঠে মেঘে মেঘে

ফাঁসিমঞ্চ, নিজের জন্য
মঞ্চ সাজানো শেষ
তারপর আমার বিবাহ, নিজেকে-ঝুলে প’ড়ে নিজেরই ফাঁসভূষণে
সহিংস্র, বিষাক্ত, নীচ
এবং সেই সঙ্গে ঘৃণিত, ময়লাটে এই চেহারা নিজের আয়নায়
কুঁচকে যাওয়া মুখের মানচিত্র
এবং একটি বাঁকা হাসি
গহ্বরে ঢোকা চোখ-আগুনের ভেতর জীবন্ত
মুখে অবিরাম বিদ্যুৎঝলক, বিবিধ ফন্দি-ফিকিরের
সব মিলে বিশেষ এক কিম্ভূত জোব্বা পরিহিত অদ্ভুত দূত
ক্রমে ছেয়ে ফেলে শীতলতা, কোনো সমাধির
যেন এক শব, ভেতরে পুঁজ, পচা গন্ধ
নিষ্ঠুর অদম্য পশুদেহ থেকে ঝুরঝুর ক্রিমি-কীটের দল ঝ’রে পড়ে
সব যেন এই শরীরমাটি থেকে গজানো, নিজেরই স্বভাবের অঙ্গপ্রতঙ্গ
ভুতুড়ে এক কাণ্ডের ভেতর নরক থেকে বিতাড়িত শয়তান
ফাঁসিকাঠে যে নিজেই নিজের জল্লাদ
কী আর করা, গলায় দড়ি দিই, নরকের জন্য
তারপর, স্বপ্নের ভেতর ফাঁসিমঞ্চ থেকে নেমে আসি এ আমি মৃত
গলায় জড়ানো নিজেরই ভূষণফাঁস, কবরের নিবিড় বাসরশয্যায়-

বন্দুকের দোকান
মাটির অতল থেকে আকাশের চূড়া অবধি চ’লে যাওয়া
আমাদের মস্তিষ্কের সাত আসমান
ঘুমের ভেতর পৃথিবীটা হ’য়ে ওঠে বন্দুকের দোকান
স্বপ্নের ভেতর বিদ্ধ হওয়া সবুজ রক্ত-বন
বিস্রস্তের হরিণ রাত্রির গায়ে গলিয়ে দেয় টকটকে তাজা লাল অশ্রু
জ্যোৎস্নাময় বেদনাকাতর মুখ লুকাই আমরা কোথায়
বনের আঁচলের তলায়
দূরে গাছ থেকে ঝরে শুঁটকি পাতা, পেছনে বুদ্বুদ তার সমুদ্র…
ফালি ফালি হৃৎপিণ্ডের আকাশময় লাল নক্ষত্রে নক্ষত্রে
ঘুমের ভেতর পৃথিবীটা হ’য়ে ওঠে বন্দুকের বাজার
ওহো, তারায় তারায় গুলির বারুদে ভেজে চলো খই
শেষ লাল ধুন্দভিগণ… !
হৃৎপিণ্ডের অতল ছিদ্রপথ দিয়ে গলিয়ে যায় রাত
তারপর, মাটিতে মেনি মাছের মতো লেপ্টে থাকা জিহ্বাটা আমাদের
মেঘে গিয়ে ঠেকে-

লেখক:
আজাদ আলাউদ্দিন, কবি, প্রাবন্ধিক, গীতিকার