“কবি আতাউর রহমান পঞ্চাশের দশকের অন্যতম কবিকন্ঠ। শোষণহীন সমাজব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষা ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর কবিতাকে সমকালীন কবিতা থেকে ভিন্নতা প্রদান করেছে।” – সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলাম সম্পাদিত আগস্ট ২০০১ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত বাংলা একাডেমী বাংলা সাহিত্য কোষ, প্রথম খন্ডের স্বরবর্ণ অংশে এমনভাবেই তাঁকে চিত্রিত করা হয়েছে।
কবি আতাউর রহমান পঞ্চাশের দশকের একজন উল্লেখযোগ্য কবি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সামাজিক ইতিহাসে পঞ্চাশের দশক একটি উত্তাল ও উল্লেখযোগ্য সময়। অসাম্প্রদায়িক মনোভাব, দেশপ্রেম, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ তদুপরি সাম্যবাদী চিন্তা আতাউর রহমানের কবিতার মূলসুর। পঞ্চাশের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত নিয়মিত ও নিরন্তর লিখেছেন তিনি।
বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত এই কবির বিষয়ে লেখা হয়েছে কম। প্রচার বিমুখ, নিভৃতচারী কবি হিসেবে তিনি আখ্যায়িত হয়েছেন। পঞ্চাশের দশকের পটভূমি, সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ, নিয়মিত অধ্যয়ন তাঁর মননকে কিভাবে তৈরি করেছিল ও তার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট আতাউর রহমানের কাব্যধারা আলোচনাই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার মুসলিম মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। কবি আতাউর রহমান তাঁদেরই প্রতিনিধি। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আতাউর রহমান রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রত্যক্ষদর্শীই শুধু নন একজন রাজনৈতিক নেতা ও ভাষা আন্দোলনের একজন সৈনিকও বটে। একদিকে সাহিত্যের ছাত্র অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে তাঁর লেখায় প্রকট হয়ে উঠেছে স্বদেশচেতনা। তাঁর লেখায় ছিল ধ্রুপদীধারার স্পর্শ। ধ্রুপদীধারা থেকে তিনি কখনো জনপ্রিয়তার ধারার দিকে সরে আসেননি।
কবি জুলফিকার মতিন ‘আতাউর রহমান: উত্তরাধিকার ও অর্জন’ প্রবন্ধে লিখেছেন-
“বাংলা কবিতার জনপ্রিয়তার একটা মাপকাঠি হলো হার্দ্যবৃত্তি অনুপ্রাণিত কবিরা যতটা স্বতঃস্ফূর্ত বিষয় ও ভাষায় এ কাজটা করতে পারেন, বুদ্ধিবাদী কবিদের দ্বারা তেমনটি হবার নয়। আর এই শেষোক্তধারার কবিরূপে কবি আতাউর রহমানও তা করতে পারেননি। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ও মেধার ব্যবহারে সময়ের সাপেক্ষতা রয়েছে। সেটিও তাঁর কবিতার সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেনি। এর সঙ্গে আরও যেটি যুক্ত তাহলো গদ্য রচনাতেও তাঁর সিদ্ধতা ছিল। নজরুলের একজন তথ্যসন্ধানী বিশ্লেষক রূপে তাঁর খ্যাতির কথাটিও সবার জানা।”
“আতাউর রহমানের গবেষণার প্রধান বিষয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য বিশেষ করে কবিতা। তিনি মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নজরুল সাহিত্য মূল্যায়ন করেছেন। ফলে ভাবাবেগের আতিশয্য ও তথ্য পরিবেশনার চেয়ে তাঁর সাহিত্যেরই বিচার বিশ্লেষণ করেছেন।” শিবনারায়ণ রায়ের ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় পরিমল চক্রবর্তী লিখেছেন, “মুক্তবুদ্ধির – কবি আতাউর রহমান”। খোন্দকার সিরাজুল হক বলেন, “আতাউর রহমান মুক্তবুদ্ধির সাধক ছিলেন। তাই ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এর চিন্তানায়কের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন “জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।” তাই আজীবন তিনি জ্ঞানের সাধনা করেছেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি মার্কসীয় দর্শনের সমর্থক ছিলেন। তিনি জানতেন এ পথ অত্যন্ত বন্ধুর ও কন্ঠকাকীর্ণ হলেও এ পথেই আছে মানবসমাজের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি।”
মুক্তবুদ্ধি, সাম্যবাদী মনোভাব এবং ৫০-র প্রগতিশীল রাজনীতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার অবয়ব। বর্তমান প্রবন্ধে আমি কবির সেই কবি মানসকে আলোচনা করার প্রয়াস পেয়েছি।
বাংলাদেশের কবিতায় পঞ্চাশের দশক একটি গতিময়তা সৃষ্টি করেছিল। আধুনিক বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায় ত্রিশ, চল্লিশের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে পঞ্চাশ তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তৈরি করেছিল। ১৯৪৭ দেশ বিভাগের পর পশ্চিম বাংলা ও পূর্ববাংলার কবিতার পথ বেঁকে যায়। ১৯৪৭ দেশবিভাগে হিন্দু মুসলিম কবিদের আবাসস্থলই শুধু পৃথক করেনি সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ ও তাদের চিন্তাচেতনাকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করেছিল। ত্রিশের দশকের রবীন্দ্রবলয় মুক্ত বাংলা আধুনিক কবিতার ধারায় চল্লিশের দশকে এসে যুক্ত হয় সাম্যবাদী চিন্তা। যা ১৯২০ এর দশকে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় প্রথম দেখা দিয়েছিল। চল্লিশের ধারাবাহিকতায় পঞ্চাশের দশকে এসে বাংলাদেশের কবিদের চেতনায় যুক্ত হলো ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ দেশবিভাগ, ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট এর নির্বাচন, ১৯৬৯ গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়, ১৯৭১ মুক্তি সংগ্রাম প্রভৃতি ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের তৎকালীন সময় অতিবাহিত করেছে। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন ছাড়াও, সাম্যবাদী রাজনীতি (১৯৪৬-৪৭ কৃষক আন্দোলন), ১৯৪৭ দেশবিভাগ, সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি (দাঙ্গা), সদ্যজাত পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্যজনিত কারণে দূরে সরে আসার প্রেক্ষাপট এই পঞ্চাশের দশকেই প্রকট হয়ে উঠেছিল। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ শ্লোগান থেকে সরে এসে মানুষ বলতে শুরু করেছিল ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’। অন্যদিকে ১৯৪৫ এর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৭ এ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি, দুর্ভিক্ষ, কবিদের সামাজিক সচেতনতা জাগ্রত করেছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা সংবেদনশীল সাহিত্যিক, দার্শনিকদের অস্তিত্ববাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। ইউরোপের অস্তিত্ববাদ, বিমূর্ততা, অ্যাবসার্ডিটি বাংলা কবিতাকে প্রভাবিত করেছিল।
কিন্তু উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, ঔপনিবেশিক শাসন, পাকিস্তানের নয়া উপনিবেশবাদ, ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ গণঅভ্যূত্থান, ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের অভ্যূদয় বাংলাদেশের কবিদের কাব্যের পটভূমি নির্মাণ করেছে। ৫০’র দশকের কবিরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত পরিবর্তনশীল সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে যোজিত হয়েছেন। কবি আতাউর রহমানও থেমে থাকেননি। ভাষা আন্দোলন পেরিয়ে মুক্তিসংগ্রামের চেতনায় নিজেকে যুক্ত করেছেন।
আতাউর রহমানের মনন সম্পর্কে আমরা জানতে পারি ‘কিছু ধ্বনি’ লিটল ম্যাগাজিনে লেখা তাঁর ‘আত্মকথন’ নামক রচনা থেকে
“সাহিত্য ও রাজনীতি দুটিই আমাকে টেনেছে কৈশোরকাল থেকে। নানা কারণে জটিল কঠিন রাজনীতির পথ চলায় বিরতি পড়েছে অনেক আগে। কিন্তু আজ কালকার দিন এমন যে রাজনীতির চিন্তাভাবনা জীবনের প্রায় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই আমাদের কবিতায় রাজনীতির দর্শন প্রভাব বিস্তার করেছে কোন না কোন ভাবে। সাহিত্যের জন্য যারা সাহিত্য চিন্তা করেন, তাঁদের সঙ্গে আমার মনের মৌলিক পার্থক্য আমি নিজেই বুঝতে পারি। শুধু শিল্পকৌশল আমাকে তৃপ্তি দেয় না। শিল্পের সাথে আমি চেয়েছি সমাজ সচেতনতা-প্রগতিশীল সমাজচেতনা। ধর্ম ও জাতীয়তার গণ্ডি আমার ভালো লাগে না। স্বাধীন চিন্তা, মুক্তবুদ্ধি, মানবতাবাদ আমাকে আকর্ষণ করেছে বরাবর।
সমাজজীবনের সুখ দুঃখের কোরাস গানের সঙ্গে আমার কবিতায় মিশেছে একক নিঃসঙ্গ জীবনের সুখ দুঃখের সুর। প্রেম, প্রেমের স্মৃতি বাল্যজীবনের ফেলে আসা দিন আমাকে নাড়া দিয়েছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য, বিবর্ণতা, আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমি লিখেছি কম তবে লেখার মধ্যে কখনো পূর্ণছেদ আসেনি। বিরাম এসেছে মাঝে মাঝে। সচেতন থেকে সমকালের সঙ্গে পদক্ষেপ মেলাবার চেষ্টা করেছি; তবে সবসময় তা সফল হয়েছে এটা বলতে পারি না।”
২২ এপ্রিল ১৯৯৯, সন্ধ্যায়, কবি আতাউর রহমান সালিম সাবরিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নিজের বেড়ে ওঠা সম্পর্কে বলেন- “আমি ব্যক্তিগতভাবে ত্রিশের কবিতার সঙ্গে পরিচিতি হয়ে উঠি কলেজ জীবনে। তবে নিজের মধ্যে জীবন ও কাব্যবোধ তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন অনুষঙ্গ থেকেই। ধীরে ধীরে বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল, দুর্ভিক্ষের দাহ নিজ চোখে দেখেছি, প্রচুর বই ও পত্রপত্রিকা পড়ার সুযোগে মার্কসীয় রাজনীতি ও রাশিয়া বøকের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকি। তখন ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’ পড়ে মূল্যবোধের ও বিশ্বাসের পালাবদল ঘটতে শুরু করে।”
সমালোচক বিনতা শাহীন বলেন-
“আতাউর রহমান আধুনিক কবি। বিভাগোত্তর সাহিত্যের ধারাকে যারা কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্য থেকে পৃথক করার জন্য ইসলামী লেবেল এঁটে দিতে চেয়েছিলেন আতাউর রহমান তাঁদেরই পরবর্তী কবি। পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে তিনি কাব্যচর্চা শুরু করেন। ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা প্রমুখ কবিগণ যে পথে সাহিত্যকে প্রবাহিত করতে চেয়েছিলেন তিনি সেদিকে গেলেন না, গেলেন আধুনিকতার দিকে। পঞ্চাশের দশকে আধুনিকতা অর্থে মনন ধর্মিতা এবং সমাজ সচেতনতা ছিলো মুখ্য।”
এ প্রসঙ্গে কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ বলেন-
“আমাদের পঞ্চাশের দশকের কবিতায় কেন্দ্রীয় সুরই রাজনৈতিক সামাজিক সচেতনতার। সেদিক থেকে আতাউর রহমান তাঁর সহজীবী কবিদের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে। .. … … … তাঁর কবিতার বিষয় ও ভাবনা বাস্তব জীবন থেকেই আহৃত। তাঁর প্রাথমিক কবিতার রোমান্টিকতা প্রত্যহের পাথরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে লীন হয়েছে। এমন কি ঐ প্রথম পর্যায়েও তিনি বাস্তববোধ থেকে কখনো চ্যুত হননি। প্রথম জীবনে রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষত যুক্ত ছিলেন; উত্তর কালে তা থেকে সরে এলেও তাঁর রাজনৈতিক চেতনা সতত জাগ্রত থেকেছে। সংগ্রামশীল মধ্যবিত্ত জীবন ও জীবিকার মধ্যে থেকে মফস্বলের ¤øানিতার মধ্যে থেকে সাহিত্যের নির্জন নিজস্ব দীপশিখাটিকে তিনি ঝড়ে জলে বাঁচিয়ে রেখেছেন আজ অবধি। সাহিত্য তাঁর আশার প্রদীপ, তাঁর সংগ্রামশীলতার প্রতীক, তাঁর মানবতাবাদের পতাকা।”
১৯৫৬ সালে প্রকাশিত আতাউর রহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দুই ঋতু’ র প্রথম কবিতা হিলি।
বিষের ধোঁয়ার শেষ,
প্রীতির জোয়ারে ভাঙ্গে বিদ্বেষের বাঁধ
তাই আজ উন্মুক্ত অবাধ
এপার ওপার যাওয়া আসা
অক্ষয় অমর বন্ধু, মানুষের
ঐক্য ভালোবাসা।
—————-
দাঙ্গা দ্বন্দ্ব ঘৃণা ঈর্ষা মনে হয় আজ নির্হেতু
বিভক্ত দেশের মাঝে হিলি রচে মিতালির সেতু।
এই কবিতা প্রসঙ্গে কবি জুলফিকার মতিন বলেন- “‘হিলি’ ই আতাউর রহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দুইঋতু’র প্রথম কবিতা। তখন সবেমাত্র দেশভাগ হয়েছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মানুষকে কতটা মোহান্ধ করতে পারে তার নজির রাজনৈতিক ইতিহাসকে দিয়েছে কলঙ্কের নতুন মাত্রা। র্যাডক্লিফ সাহেবের কলম সীমানা একেঁ দিয়ে বলেছে এটা মুসলমানের দেশ ওটা হিন্দুর।
কিন্তু তারপরও অনেক জায়গায় অবস্থানগত তাৎপর্য এমন ছিল না, সেখানে সবাই মিলেমিশে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। হিলির বেলাতেও সেটা ছিল সত্য।”
কবি জুলফিকার মতিন আরও জানাচ্ছেন যে “বিভাগোত্তর বাংলা কবিতার নতুন অর্জন স্পষ্টগোচর হয়ে উঠতে থাকে পঞ্চাশের দশকের প্রথম থেকেই। সন্দেহ নেই ভাষা আন্দোলন ও একুশে ফেব্রুয়ারি’ই ছিল এই নতুন ধারার মাইল ফলক। দেশ-মাটি মানুষ সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি হয়ে ওঠে মুখ্য। আতাউর রহমান কৈশোরোত্তীর্ণ প্রথম যৌবনের দিনগুলোতে দীক্ষা নিয়েছিলেন প্রগতিবাদে-সমাজতন্ত্রে। সংগত কারণেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন সাম্প্রদায়িককতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিপক্ষে। প্রথম কাব্যগ্রন্থেই তাঁর অবস্থান ও স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত। আতাউর রহমানের উত্তরাধিকারটা খুব স্পষ্ট। প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তীকাল থেকে বাংলা কবিতার পালাবদল হতে থাকে। রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে মৌলিকত্ব ঘোষণা করার জন্য তিরিশের কবিরা প্রথমত মাত্রাগত পরিবর্তনের সূচনা করেন। শ্রেণী বৈষম্য, ঔপনিবেশিক শাসন ও সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি সম্পর্কে গণমানুষের সচেতনতা সাধারণভাবে জন্ম দিতে পারে সমাজ বিপ্লবের কবিরাও হতে পারেন সেই বিপ্লবের ধারক ও বাহক। প্রেমেন্দ্র মিত্র, কাজী নজরুল ইসলাম, সুভাষ মুখোপাধ্যায় কিংবা সুকান্ত ভট্টাচার্যের উদাহরণই যথেষ্ট। পরবর্তী সময়ের কবি আতাউর রহমানও এদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। বরং তাঁর কৃতিত্ব বিশেষ মূল্যায়নের দাবী রাখে এজন্যই যে পাকিস্তানী আমলের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রদর্শনের সরাসরি বিপক্ষে তাঁকে অবস্থান নিতে হয়েছিল।”

কবি আতাউর রহমান ১৯২৫ সালের ৮ মে জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম ও ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. আলাউদ্দীন সরদার ও মাতার নাম গোলেজান নেসা। তাঁর পিতা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলেন ও জজের জুরি নির্বাচিত হয়েছিলেন। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে ১৯৯৯ সালের ২৬ জুন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
“আক্কেলপুর আমাদের ইতিহাসে কোন সুপরিচিত স্থান নয় তবে ভূগোলে মনোরম । একটি রেলষ্টেশন। কিছু উওর-পশ্চিমে পাহাড়পুর। পূর্ব পাশে পল্লী নদী তুলসীগঙ্গা প্রবাহিত। নওগাঁ জেলার বদলগাছি এলাকা বরেন্দ্রভূমির অন্তর্গত হয়েও নরম পলল। পলল বক্ষে রচিত চকতাল গ্রাম কবির পিতৃভূমি। গঙ্গা যমুনা লালিত উর্বর শ্যামল কোমল ভূমিতে কবি চোখ মেলেছিলেন। বরেন্দ্র রুক্ষতা কবিকে সংগ্রামী করেছে। নদীর কোমলতা তাঁকে শিল্পী করেছে, পৌন্ড্র সভ্যতার স্মৃতি তাকে ঐতিহ্য সচেতন করেছে।”
তিনি বগুড়ার সোনামুখী হাই স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক, বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে আই,এ, কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ১৯৪৯ সালে বি.এ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন ।
আতাউর রহমান অধ্যাপনা আরম্ভ করেন ১৯৫৩ সালে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও কলেজে, এরপর বগুড়া আজিজুল হক কলেজ (১৯৫৩-৫৭)। ১৯৫৭ তে যোগদান করেন সন্তোষের মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজে। ১৯৫৮ তে যোগদান করেন জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে। ১৯৫৯ সালে যোগদান করেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে (১৯৫৯-১৯৬২), দ্বিতীয়বার ১৯৬২ তে বগুড়া আজিজুল হক কলেজে যোগদান করেন (১৯৬২-১৯৭৩), ১৯৭৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৯১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৯২-৯৩ সালে নজরুল ইনিস্টিটিউটে নজরুল গবেষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৯৭ সালে ঢাকা কমার্স কলেজে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেছিলেন।
১৯৪৪ সালে আতাউর রহমান “All India Students Federation” (নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন)-এ যোগ দেন । ১৯৪৬ সালে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে ছাত্র ফেডারেশনের দিল্লী সম্মেলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৬-৪৭ সালে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৭ এ বঙ্গীয় ছাত্র ফেডারেশনের সহ সভাপতি নির্বাচিত হন। বগুড়া জেলার তদানীন্তন কমিউনিস্ট ছাত্রনেতা ও তরুণ কবি আতাউর রহমান গ্রেফতার এড়ানোর জন্য আত্মগোপন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ভারতে চলে যান। এই আত্মগোপনরত অবস্থায় কলকাতাস্থ সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে অনিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে ১৯৪৯ সালে বি.এ পাশ করেন।
১৯৫০-৫২ সালে আতাউর রহমান যুবলীগের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি বগুড়া জেলা যুবলীগের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের তিনি বগুড়া জেলার আহ্বায়ক ছিলেন। বগুড়া আজিজুল হক কলেজের মাঠে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সভাসমাবেশ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তে তিনি নিজ গ্রাম আক্কেলপুরে ছিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে নিজ এলাকায় হরতাল আহ্বান করেন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে পাকিস্তান সরকার তাঁকে ১২ বছর চাকুরিতে অস্থায়ী অবস্থায় রাখে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি কলকাতায় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অর্থ সংগ্রহ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:
কাব্যগ্রন্থ
দুই ঋতু (১৯৫৬)
একদিন প্রতিদিন (১৯৬৫)
নিষাদ নগরে আছি (১৯৭৭)
ভালবাসা চিরশত্রু (১৯৮১)
ইদানীং রঙ্গমঞ্চ (১৯৯২)
ভালবাসা এবং তারপর (১৯৯৩)
সারাটা জীবন ধরে (১৯৯৪)
নির্বাচিত কবিতা (২০০৬)
গবেষণা ও প্রবন্ধ গ্রন্থ
আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (১৯৬৩)
কবি নজরুল (১৯৬৮)
নজরুল কাব্য সমীক্ষা (১৯৭১)
নজরুল ঔপনিবেশিক সমাজে সংগ্রামী কবি (১৯৯৩)
জীবনী
বেনজীর আহমেদ (১৯৯৪)
নজরুল জীবনে প্রেম ও বিবাহ (১৯৯৭)
নজরুল ইসলাম (২০০৫)
পুরস্কার
বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (কবিতা) (১৯৭০)
নজরুল ইনিস্টিটিউট পুরস্কার (১৯৮৫)
কবিতীর্থ চরুলিয়াস্থ নজরুল স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৩)
বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার
বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার
হিলালী স্মৃতি পুরস্কার
শেরে বাংলা পুরস্কার
কাজী রব স্মৃতি পুরস্কার
জনকন্ঠ প্রতিভা সম্মাননা (১৯৯৮)
করতোয়া সাংস্কৃতিক সংস্থা কর্তৃক সংবর্ধনা
গ্রন্থ পর্যালোচনা প্রসঙ্গে আহমদ রফিক লিখেছেন- “প্রথম সংকলন দুটো (দুই ঋতু ও একদিন প্রতিদিন) ষাটের দশকে প্রকাশিত হলেও মনে রাখা দরকার, গ্রন্থদ্বয়ে অন্তর্গত কবিতাগুলোর প্রধান অংশ পঞ্চাশের দশকের রচনা। যে সময় আমাদের সাংস্কৃতিক পদচারণা এমন এক ক্রান্তিকালে চিহ্নিত যখন সাহিত্যে বিষয়গত প্রসাদ ও সচেতন বলিষ্ঠতার গুণপণা সামাজিক রাজনৈতিক নিয়মেই তীক্ষè হতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সচেতনতার পাঠ। আতাউর রহমানের প্রাসঙ্গিক পর্বের কবিতাগুলোতে সেই চারিত্র যুগধর্মের বৈশিষ্ট্যে নিষিক্ত। চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকের বাংলা কবিতার সার্বিক ধারায় যে সমাজ সচেতনতা ও আন্তর্জাতিকতার বোধ শ্রেণী চেতনার গুণগান নিয়ে বাতাসে ভরা পালের শক্তিমান শুভ্রতায় বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিল, সচেতন কাব্যমানের অধিকারী আতাউর রহমান স্বাভাবিক নিয়মেই সেদিকে চোখ রেখে ছিলেন। তার প্রাথমিক পর্বের কবিতায় এই বহুমাত্রিক চেতনার প্রভাব সুস্পষ্ট। এই চেতনা একদিকে যেমন দাঙ্গা, রাজনৈতিক সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতার ঝাণ্ডা উড়িয়েছে, তেমনি অন্যদিকে শ্রমজীবী কৃষকের স্বপ্নের স্বীকৃতি দিয়েছে যে স্বপ্ন রাজনৈতিক নৈরাজ্যের ফলশ্রুতিতে দেশবিভাগের রক্ত প্রবাহে ভাসমান এবং পরিশেষে বঞ্চনায় মুহ্যমান।”
বিনতা শাহীন লিখেছেন- “দুই ঋতু তেত্রিশটি কবিতার সংকলন। কবিতাগুলোর মধ্যে একটি নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ রয়েছে। যেন একটি চেতনাকে কবি বিচিত্র অনুভূতি দিয়ে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। এই চেতনা কবির সমাজ সচেতনতারই বহিঃপ্রকাশ। মধ্যবিত্ত জীবনের নৈমিত্তিক আশা নিরাশার দ্বন্দ্বেই এর উদ্ভব।
১৯৫৬ সনে আতাউর রহমানের কাব্যগ্রন্থ ‘দুইঋতু’ প্রকাশিত হয়। এ সময় তিনি বেশীর ভাগই মুগ্ধতায় অবসন্ন। ফলে রোমান্টিকতাই এই কাব্যগ্রন্থে প্রধান হয়ে উঠেছে। বিষণœতা যদিও দেখা দিয়েছে তাও রোমান্টিকতাকেই ঘিরে। ফলে এ গ্রন্থে বাক প্রতিমাগুলোতে এই দুই বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয়। সম্পূর্ণ গ্রন্থটিতে যে বাক প্রতিমাগুলো উল্লেখযোগ্য তা নিম্নরূপ-
“মরা প্রেম মাথা তোলে ছাই চাপা আগুনের মত।”
(অন্যঋতু)
ভাবের দিক থেকে এখানে রোমান্টিকতাই প্রধান। আর চিত্রকল্প হয়েছে অসাধারণ। ‘ছাইচাপা আগুন’ পাঠক মাত্রেই অজানা নয়, বিগত প্রেমের এই মাথা তোলার চিত্রটিকে কবি প্রাণের সঞ্চার করেছেন। যেন এক বিষণ্ণ নায়িকা তার অসুস্থ মাথা ধীরে ধীরে উত্তোলিত করছে ঠাণ্ডা চাপা দেয়া অগ্নির মতো।
“ঘুম থেকে জেগে দেখি
কুয়াশা কাফন মোড়া ভোর”
(দূরযায়িনীকে)
কাফন শব্দটির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চেতনায় একটি মৃতের ছবি ভেসে ওঠা স্বাভাবিক। এই ভয়ঙ্কর ছবিটির সঙ্গে কবি ভোরের কুয়াশার দৃশ্যটির তুলনা করছেন। মাত্র একটি লাইনের বাকপ্রতিমা থেকেই কবির অন্তর্লোক পর্যন্ত উদঘাটন করা যেতে পারে। এমন ভয়ংকর বিদায়ী দৃশ্যের অবতারণা কবি করলেন কেন? তাঁর অন্তরে কোন বিষণ্ণতার সুর বেজেছিলো? অথচ একে বিদায়ী দৃশ্য বলেও শেষ করা যায় না। ভোর শব্দটির মাঝে একটি সৃষ্টিরও যেন প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত।”
কবি আতাউর রহমানের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘একদিন প্রতিদিন’ সম্পর্কে সমালোচক বিনতা শাহীন লিখেছেন- “আতাউর রহমানের পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘একদিন প্রতিদিন’ এ মাত্র তিনটি চিত্রকল্প পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু তিনটি চিত্রকল্পই প্রখর, তীক্ষ্ণ এবং উদ্ধত।
কী অদ্ভুত লাগে এ দেশের
শীতের বিকাল
মসৃণ রোদ মাঠে শুয়ে যেন শান্ত বিড়াল।
(শীতের বিকাল)
রোদকে যখন বিড়ালের মাঝে প্রতীকায়িত করেছেন কবি, তখনই চিত্রটি সজীব, সচল হয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। এরূপ অন্য একটি কবিতায় নগরকে সাপের চিত্রে চিত্রায়িত করে কবি চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন-
রাত্রি শেষে এ নগর ছোটে
ক্ষুধিত সাপের মত
খাদ্যের সন্ধানে।
(ইশারা)
এখানে মুখ্য চিত্র হলো ক্ষুধা ও সাপ। নগরটা কেবল সাপের মতোই ছুটছে না, ছুটছে একটি ক্ষুধার্ত সাপের মত।
এ গ্রন্থের তৃতীয় চিত্রকল্পটি হলো-
মাঠের মাজা জড়িয়ে নদী হাঁটে
ঘাটে ঘাটে নৌকা সখার মত
পার করে দেয় গাঙ্গ-খাল-খাড়ী
(পূর্ববাংলা)
মাঠের মাজা জড়িয়ে নদী হাঁটে বাক্যটি এখানে চিত্রকল্প হিসেবে লক্ষ করার মতো।”
শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা তাঁর মূল্যায়নে বলেন- “একদিনই ঘুরে ঘুরে প্রতিদিন আত্মপ্রকাশ করছে অর্থাৎ একটি পুনরাবর্তিত দিনের ইতিবৃত্তই সারাজীবনের ইতিবৃত্ত এমনি একটি ব্যঞ্জনা গ্রন্থের নামকরণের মধ্যে রয়ে গেলেও বস্তুত গ্রন্থখানি কেবলি কোন এক বৈচিত্র্যহীন জীবনের একঘেঁয়েমীর চিত্রই শুধু নয়। বিচিত্র জীবনকে নানা কর্মক্ষেত্রে কবি এখানে উপলব্ধি করেছেন। …. জীবনকে বিচিত্র কর্মক্ষেত্রে উপলব্ধির সজ্ঞান চেষ্টা কাব্যখানিকে একটি বিশিষ্টতা দান করেছে। আর জীবনের সচল প্রবাহের সঙ্গে থেকে কোথাও ছিন্ন হয়নি বলেই কবি এই কাব্যে তাঁর সমস্ত ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও এক প্রকারের সার্থকতা অর্জন করেছেন।
… যুগটা কবিতা রচনার জন্য ফুলশয্যা হয়ে নেই। এমন একটা যুগে ব্যঙ্গবিদ্রুপ প্রবণতা অনেকটা জীবিত থাকার মতোই শিল্পীর মধ্যে জন্ম নেয়। আতাউর রহমানের মধ্যে ব্যঙ্গ কতো সাবলীলভাবে কাব্যরূপ প্রাপ্ত হয়েছে ‘একদিন প্রতিদিন’ থেকে যে কথা উদাহরণ উদ্ধৃতি করে দেখানো যেতে পারে।
বেশ আছি বেশ আছি দশটা পাঁচটার ঘানি টেনে,
বেশ আছি রোগী আর মক্কেলের মঙ্গল চিন্তায়
বেশ আছি পলিটিক্সে দ্বন্দ্বে মেতে নীতি বেচে কেনে,
বেশ আছি বেশ আছি রেস্তোরায় ক্লাবে থিয়েটারে
পড়শীর কুৎসা আর নিজ স্তুতি বাহাদুরী দিয়ে
বেশ আছি জুয়াড়ীর আড্ডায় বাজারে
মাংসাশী প্রেমালাপে নারী কলংকের গান গেয়ে।
(বেশ আছি)
মাত্র আট চরণের এই কবিতাটিতে হালকা বিদ্রুপের অন্তরালে এ যুগের একটি মূক কান্না জমাট বেঁধে রইলো কোন আগামী দিনের হৃদয়ের প্রতীক্ষায় যে হৃদয় হবে মানবতার মঙ্গল মুক্তির তৎপরতায় চিরক্লান্তিহীন। বস্তুত ‘একদিন প্রতিদিন’কে এমনি মূক কান্নার ইতিহাস মনে হয়েছে আমার। … জীবনের এমনি সহজ স্বভাবটিকে চেনার মধ্যেই “একদিন প্রতিদিন”এর কবির কৃতিত্ব।”
গবেষক শান্তনু কায়সার লিখেছেন- “‘নিষাদ নগরে আছি’ (প্রকাশ কাল ১৯৭৭) আতাউর রহমানের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। “এতে মোট ৫৬টি কবিতা আছে। তার মধ্যে প্রায় অর্ধেক সনেট। মিতভাষী এই সব কবিতার শরীর জুড়ে ছন্দ ও আঙ্গিক নির্মাণের সারল্য ও লাবণ্য। শুদ্ধতার জন্য নিবেদিত এই কবির কন্ঠে নীলকন্ঠের জ্বালা। হেমলক অথবা ধুতুরার প্রসঙ্গ তাই বারবারই তাঁর কবিতায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঘুরে ফিরে এসেছে। … ১৯৬১ থেকে ’৭৬ এই দীর্ঘ সময়ের ফসল তোলা হয়েছে “নিষাদ নগরের” সত্তর পৃষ্ঠায়। … নিষাদ নগরের প্রথম কবিতা ‘উত্তর যৌবন’ একটি সনেট। সেক্সপীরীয় রীতির কটি সনেট বাদে এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত সনেটগুলোতে আতাউর রহমান পেত্রার্কীয় রীতির মৌল কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রাখলেও ছন্দ প্রক্রিয়াকে তাঁর সুবিধেমত নতুনভাবে নির্মাণ করে নিয়েছেন।
পেত্রার্ক-র সনেট অষ্টক যেখানে কখখক, কখখক। আতাউর রহমান সেখানে তাকে সাজিয়েছেন এভাবে কখকখ, গঘগঘ। অবশ্যি তারও ব্যতিক্রম খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর দুটি সনেটে: ‘অন্তর্গত’ (কখখক, গঘঘগ) ও ‘অধিকারী নেপথ্যের’ (কখকখ, খগখগ)। পেত্রার্ক, শেক্সপীয়র, ফারসী রীতির সনেট ও চৌদ্দ পংক্তির বদলে ষোল পংক্তির সনেট রচনার নানা প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা নিরীক্ষাকে আতাউর রহমান তাঁর রচনার অংশ করে নিয়েছেন। পেত্রার্ক ও শেক্সপীরীয় রীতির মিশ্রণে এক নতুন রীতির সৃষ্টি করেছেন।”
নূর মোহাম্মদ লিখেছেন- “মাতৃভূমির প্রতি সুগভীর মমত্ববোধ আকর্ষণ ও ভালোবাসার চরম অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন, নিষাদ নগরে আছি কাব্যে। যুদ্ধের সময়। দেশের বাইরে থাকাকালীন কবি মায়ের কথা ভেবেছেন-
ঘন বর্ষা, ঝড়ে ঝড়ে বিপর্যস্ত বাংলার আকাশ
ঘর ভাঙে, ভাঙে সেতু, হাট ঘাট ভেঙে পড়ে
উল্টা পাল্টা ঝড়ের ধাক্কায়
আকাশ উন্মাদ হয়ে গর্জে রাত্রিদিন
ঘন ঘন বাজ পড়ে অদূরে সুদূরে।
এমন দুর্যোগে কেউ বাইরে কি থাকে?
ভাবছেন মা আমার শঙ্কিত দুরু দুর বুকে।
(মা)
“আবার কখনও তৃপ্তিহীন যৌবনের ক্ষুধায় কবি একান্তরূপে লীন হয়ে আছেন আজীবন লালিত মাতৃভাষার সৌকুমার্যের মধ্যে। কবি তাঁর জননী জন্মভূমিরই এক অবিসংবাদিত উত্তরাধিকারী।
ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। কবির রাজনৈতিক জীবনের ‘আমার প্রথম প্রেম’।
একুশে ফেব্রুয়ারী তুমি রক্তিম পঙ্কজ সুরভিত
প্রথম প্রেমের মতো উৎসব অশ্রুজাল মেশা
প্রথম স্পর্শের মত উন্মাদক রক্তে স্বাক্ষরিত
প্রেমিকের ক্ষুধাতুর নয়নের দুরন্ত অন্বেষা।
আমার প্রথম প্রেম প্রথম প্রেমের পাঠ তুমি
তাই আমি অহঙ্কারে তোর ওষ্ঠ প্রকাশ্যেই চুমি।
(আমার প্রথম, ভালোবাসা চিরশত্রু)
একুশে ফেব্রুয়ারিকে তিনি ‘মুক্তি সংগ্রামের প্রথম দীক্ষার দিন’ রূপে চিহ্নিত করেছেন।
একুশে ফেব্রুয়ারী মানে
নির্মম শীতের অন্তকাল,
একুশে ফেব্রুয়ারী মানে
প্রথম ফসল ঋতু বন্ধ্যা মাঠে মাঠে,
একুশে ফেব্রুয়ারী মানে
সিনাইয়ে সাক্ষাৎ যেন দিব্য আগুনের,
একুশে ফেব্রুয়ারী মানে
অভিশাপ মুক্তি এই বঙ্গ-অহল্যার
মুক্তি সংগ্রামের প্রথম দীক্ষার দিন-একুশে ফেব্রুয়ারী।
(একুশে ফেব্রুয়ারী, ভালোবাসা এবং তারপর)”
খোন্দকার সিরাজুল হক লিখেছেন- “১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে স্বাধিকার আন্দোলনের শুরু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তারই পরিণতি। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা কবির সমগ্র সত্তাকে দীর্ঘ আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে “নিষাদ নগরে আছি”, “এখন অরণ্যে আমি”, “মা”, “নিষাদ নগর মুক্ত” প্রভৃতি কবিতায়।
“সোজা পথে ব্যর্থ হলে বাধ্য হয়ে চলে যাবে বাঁয়ে
সেই পথে পড়ে কিন্তু ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ ক্ষুধিত সাগর
পারাপার সেইখানে সুকঠিন সেতুতে বা নায়ে
বিশ্বাসের দৃপ্ত ইচ্ছা এ পথের একান্ত নির্ভর।
ডানের পথিক কিন্তু চিরদিন চলে নিরাপদে
অক্ষত শরীরে পৌঁছে সিংহাসনে বারাঙ্গনালোকে,
অথচ বামের যাত্রী প্রতিঘাত পায় প্রতি পদে
বঙ্কিম বন্ধুর পথে রৌদ্রকে মাথায় নিয়ে ধোঁকে।”
(ডান বামের ইতিবৃত্ত, নিষাদনগরে আছি)
কবি ভালোবাসাকে মানবজীবনের সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে সূক্ষ্ম অনুভূতি বলে মনে করেন। তাই ভালোবাসা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে রুদ্ধ কারাগারের দরজা খুলে যায়-
ভালোবাসা একটি সহজ সরল শব্দ
অথচ কী বিস্ময় উচ্চারণ
কী বিস্ময়কর আবিষ্কার
(ভালোবাসা, ভালোবাসা এবং তারপর)
ভালোবাসা এই মহিমাময় রূপের কথা জেনেও কবি ভালোবাসাকে অভিমান ভরে চিরশত্রু বলে আখ্যায়িত করতে চান। কারণ তিনি মনে করেন বিরহ প্রেমিকের হৃদয়ে চিরন্তন ক্ষত রেখে যায়।
চিরশশ্রু ভালোবাসা তোকে আর দেবো না প্রশ্রয়
ঘৃণায় তাড়াব তোকে অন্তরের শেষসীমা থেকে।
কেননা জীবনে তুই ছড়াস বেদনা ক্ষতি ক্ষয়।
(ভালোবাসা চিরশত্রু তিন)”
কবি জুলফিকার মতিন বলেছেন- “বাংলা কবিতার চিরন্তন প্রেম ও আতাউর রহমানের কাব্যবিষয় বিযুক্ত ছিল না। কিন্তু-
একদার প্রিয়তমা কালচক্রে ঘরণী – পরের
প্রত্যাশায় কাছে যাই – নেই মুখে ধ্বনি সৌজন্যের।
(স্মৃতির ভাড়ারে, ভালোবাসা এবং তারপর)
ব্যক্তিগত অচরিতার্থতা থাকলেও আতাউর রহমানের কবিতায় সমষ্টিবদ্ধ জীবনের জন্য আশাবাদই প্রধান। শোষণ নির্যাতন রক্তপাতের ভেতর দিয়ে মানুষের যে অভিযাত্রা ইতিহাসের পথ বেয়ে প্রতিকূলতাকে উড়িয়ে দিয়ে যে মানুষ অজেয় সেই মানুষের কথা রয়েছে তাঁর কবিতায়। উপমা রূপক চিত্রকল্পের খুব সাহস না নিয়েও পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সমকালীন উপাদান তিনি ব্যবহার করেছেন অক্লেশে।”
খোন্দকার সিরাজুল হক বলেন- “স্বাভাবিক নিয়মে প্রেমের সঙ্গে প্রকৃতিও এসেছে তাঁর কবিতায়। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে প্রকৃতি যে বৈচিত্র্যময় রূপে বাংলাদেশে উপস্থিত হয় তা কবির দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত সন্ধ্যার কবিতা শীতের বিকেল প্রভৃতি শিরোনামে প্রকৃতি বিষয়ক কয়েকটি কবিতা তিনি রচনা করেছেন। আতাউর রহমানের কবিতায় একটি বড় অংশ জুড়ে আছে আত্মা-জিজ্ঞাসা।”
কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু বলেন- “কবি আতাউর রহমানের কবিতাকে চেনা যায় দৃষ্টিকোণের সামঞ্জস্যে ও ধারাবাহিকতায়। জীবন বাস্তবতা তাঁর কবিতার মৌলস্পন্দন। জীবন সংলগ্নতা শিল্প সৌকর্যে উন্মুখ হয়েছে।
জীবনের অভিজ্ঞতায় দার্শনিক-জিজ্ঞাসা কখনো কখনো তাঁর কবিতায় আমরা লক্ষ করি। তিনি লিখেছেন:
‘মানুষ পথের নয়
নয় সে তো অবিনাশী স্মারক প্রতীক
ঝড় বা বন্যায় তাকে ছুঁবে নাকো
এমন কি হতে পারে
এমন কি হতে পারে মানুষের বিনাশ ঘটবে না?’
(প্রিয় ব্রত, সারাটা জীবন ধরে)
সংগ্রামী মানুষের জীবনও তাদের মহিমা উচ্চকিত হয়েছে তাঁর কবিতায় :
‘তারা চলে
মরুদ্যান আর নদীর সন্ধানে
অনুর্বর জড়ধর্মী মৃত্তিকায়
আশাবাদী শ্রমশীল হাত ওঠে আর নামে।’
(হাত, সারাটা জীবন ধরে)”
নূর মোহাম্মদ লিখেছেন- “আতাউর রহমান আধুনিক কবি। কিন্তু তাঁর কাব্যে উদ্ভট কল্পনা কিংবা অকাট্য পান্ডিত্বের স্পর্শ নেই। আছে অকৃত্রিম হৃদয়শীলতা ও মানব করুণা। মানবতা ও আন্তরিকতার সজল স্পর্শে আতাউর রহমানের কবিতা আর্দ্র ও সিক্ত।”
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন- “আতাউর রহমান অনেক সনেট লিখেছেন- হয়তো তাঁর প্রজন্মের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। হয়তো এতেই তিনি সবচেয়ে স্বচ্ছন্দবোধ করেছেন। গদ্যছন্দের চেয়ে পদ্যছন্দে যে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য বেশি, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সক্রিয় বামপন্থী হিসেবে এককালে উচ্চকন্ঠ কবিতা লেখায় যে আগ্রহ তিনি বোধ করতেন, বক্তব্যের স্পষ্টতা প্রত্যক্ষতার মধ্যে তার পরিচয় আছে। যে বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ তা এই যে বাংলা কবিতার পরিবর্তনশীলতার মধ্যে বাস করেও নিজেকে পরিবর্তিত করার চেষ্টা তেমন করেননি তিনি। হয়তো স্বাভাবিকভাবে যে ভাব ও প্রকরণ তাঁর উৎসারিত হয়েছে, তা নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন।”
লেখক গবেষক আহমাদ মাযহার লিখেছেন “আতাউর রহমানের প্রেমের কবিতাও বিশেষত্বপূর্ণ। সে কারণে তাঁর প্রেমের কবিতা মনোযোগী বিশ্লেষণ দাবী করে। … আঙ্গিকের দিকে থেকে তিনি সংহতিপন্থী বলেই হয়তো খুব দীর্ঘ কবিতা তাঁর নেই; সনেট লিখেছেন প্রচুর সংখ্যায়। তাঁর সনেট বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে শান্তনু কায়সার কিছুটা আলোচনা করেছেন; আরো মনোযোগী বিশ্লেষণ হতে পারে। আধুনিক সনেটের যেখানে সূচনা ঘটেছিল মাইকেলের হাতে তা আজ বিচিত্র বিসর্পিল পথে এগিয়ে চলেছে। তিরিশি কবিদের মধ্যে সুবীন্দ্রনাথ দত্ত সনেটে যে মন্ত্রধ্বনিময়তার পথে গিয়েছিলেন আতাউর রহমান সে পথে যাননি। তিনি গেছেন সহজ সরল আরেক তিরিশি অজিত দত্তের সনেট প্রকল্পনার পথে। আতাউর রহমানের কবি সত্তা গড়ে উঠেছে রাজনীতি ও প্রেমের মিশেলে। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলতে পারেন:
স্বদেশের শত শত বৎসরের সমৃদ্ধ শব্দের মরাই
আমার বুকের মধ্যে রাত্রিদিন
সংখ্যাহীন আশার বুদ্বুদ
আমার হৃদয়ে ফোটে সংগোপন প্রেমের গোলাপ
লাল নীল স্বপনের
(জন্মভূমি জননীর আমি, নিষাদ নগরে আছি)”
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, কবিকন্ঠ পত্রিকায় লিখেছিলেন
“এক ধরনের কবিতা আছে…. মহৎ কবিতার গভীর পরিকল্পনা এদের মধ্যে অনুপস্থিত, সচেতন যত্নে ও চেষ্টায় গতানুগতিক কবিতার পরিচিত পথ থেকে সরে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ নতুন ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ঝলকে ওঠার আলৌকিক আলো নেই এদের রূপবিভাসে, এক অর্থে সাধারণ ও ভেদাভেদহীন এরা, শব্দে উপমায় ছন্দের সমকালের ১০টা বৈশিষ্ট্যহীন প্রথাগত এক ঘেঁয়ে কবিতার সঙ্গে পার্থক্যরহিত, তবু সে কবিতা পাঠ করার সময় এমন একটা নিবিড় আন্তরিকতার সজীব হাত আমাদের কাঁধের ওপর এসে হাত রাখে যার ফলে সেই কবিতা এক মুহূর্তে আমাদের উন্নাসিকতা বিভ্রান্ত গ্রহণ ক্ষমতায় চিরচেনা অতিথির মতো গৃহীত হয়ে যায়। আমাদের নিবিড় মন রসিয়ে ওঠে এক মধুর অনির্বচনীয়তার হার্দ্যতায়। আতাউর রহমানের কবিতা পড়ার পর এই ধরনের একটা একান্ত কোমল অনুভূতিময়তা আমাদের আঙুল ছুঁয়ে যায়, আমরা একটা সহজ, অনায়াস সজীবতাকে অনুভব করি আমাদের কমনীয় চেতনার সরণিতে। এছাড়া আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তিনি চিহিৃত করেছিলেন, তাহলো: ভান নেই তাঁর কবিতায়, সচেষ্ট প্রয়াসে সাধারণ, বৈশিষ্ট্যহীন ও নিঃশেষিত বিষয়কে চাতুর্যের বৈদ্যুতিক উজ্জ্বলতা দেওয়ার সচেতন হঠকারিতা নেই তাঁর চরিত্রে, অকারণ ধূর্ততায় কবিতাকে চমক ও চটকের উজ্জ্বল সংকলনে পরিণত করার প্রচলিত ও ত্বকসর্বস্ব রীতির তিনি বিরোধী।”
পঞ্চাশের দশকের কবি আতাউর রহমান তাঁর সময়ের কবিদের তুলনায় সনেট লিখেছেন বেশি। গ্রিক পুরাণ, ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনী থেকে তিনি উপমা, রূপক গ্রহণ করেছেন। আমাদের চারপাশের প্রাকৃতিক জীবন থেকে তুলে এনেছেন চিত্রকল্প। আত্মকেন্দ্রিক জীবনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির চেয়ে সামষ্টিক জীবনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি তাঁর কবিতায় গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। নিম্ন শ্রেণীর মানুষের সুখ দুঃখ তাঁর কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে শ্রেণীহীন সমাজের চিন্তা, সমাজ পরিবর্তনের চিন্তা তাঁর লেখায় মুখ্য হয়ে উঠেছে। তবে তা শ্লোগানধর্মী নয়, শৈল্পিক ও কাব্যিক গুণে গুণান্বিত।
একজন শিল্পী, সাহিত্যিক তাঁর সময়ের সন্তান। সময়ের গর্ভে তাঁর শিল্প সৃষ্টি হয়। তথাপি তিনি সময়ের থেকে এগিয়ে, প্রগতিশীল চিন্তক। তাঁর সময়ের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে তাঁকে কল্পনা করা যায় না। যেমন ঔপনিবেশিক শাসনকে বাদ দিয়ে কবি নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকে কল্পনা করা যায় না তেমনি পঞ্চাশের দশকের প্রেক্ষাপটকে বাদ দিয়ে কবি আতাউর রহমানের কবিতাকে কল্পনা করা যায় না। কবি আতাউর রহমানের সময়, বিশ্বাস, জীবনাচরণ ও কবিতা অবিচ্ছেদ্য।
অন্যদিকে কবি তাঁর ঐতিহ্যকে অস্বীকার করেননি। তেমনটিই বলেছেন সমালোচক খোন্দকার সিরাজুল হক, “আতাউর রহমান ঐতিহ্য সমর্পিত কবি। দীর্ঘ চার দশকের কবি জীবনে তিনি বারবার স্মরণ করেছেন আমাদের ঐতিহ্যের ধারক বাহক ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গকে। হাজী মোহাম্মদ মহসীন, রামমোহন রায়, রবীন্দ্র্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, সূর্যসেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রমুখ সাহিত্যিক, সমাজসংস্কারক, বিপ্লবীকে।”
জীবনানন্দ দাশের মতো প্রতিদিনের জীবনে ক্লান্ত ছিলেন কবি আতাউর রহমান। নগর জীবনের ছুটে চলা তাঁকে ক্লান্ত করেছে। তিনি মুক্তি খুঁজেছেন প্রকৃতির কাছে, নদীর কাছে, পাখির কাছে এবং প্রিয় মানুষের কাছে। প্রিয়জনের দুর্বোধ্য আচরণ কবিকে ব্যথিত করেছে। নিরন্তর শান্তি সন্ধান করেছেন কবি, তাঁর কবিতায় প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হয়েছে সেই আর্তি। নাগরিক জীবনে কবি নিঃসঙ্গতা অনুভব করেছেন। চারপাশের মানুষের মুখোশধারী চেহারা কখনো তাদের কাছে আসা, কখনো তাদের দূরে চলে যাওয়া কবিকে আহত করেছে। ‘ঈর্ষাবিদ্ধ প্রতিযোগিতা’কে ঘৃণা করেছেন তিনি। তোষামোদের সংস্কৃতির মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। মানব চরিত্রের বিভিন্ন দিক তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। ‘পুরস্কার’ সংস্কৃতি, ‘গোষ্ঠীবাদ’ কে ব্যঙ্গ করেছেন তিনি। সাহিত্যে প্রতিষ্ঠার জন্য তোষামোদ করেননি তিনি। কালের বিচারের উপর সাহিত্য নির্ভরশীল বলে তিনি বিশ্বাস করতেন এবং তিনি তেমনটিই বলেছেন-
“নিজেকে প্রকাশ ও প্রচারের ইচ্ছে স্বাভাবিক। কিন্তু এই প্রচারে আত্মম্ভরিতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতা আমার চোখে পড়ে। বড় খারাপ লাগে। তাই নিজের লেখা নিয়ে ঢাক ঢোল পেটানোর ইচ্ছে আমার প্রায়ই হয় না। এই কথাটি প্রকাশ পেয়েছে ‘ব্যক্তিগত’ নামে (নিষাদ নগরে আছি) কবিতায়। আমি জানি, প্রচারের জোর গোষ্ঠী প্রীতির কল্যাণে উচ্চপদের ভারে অনেক সাধারণ কবি সাহিত্যিক বড় আসন লাভ করেন সমাজে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও জানি ভালো লেখার মূল্য কালের খাতায় একদিন স্থান পাবেই।” (চিঠি)
প্রতিদিনের জীবনসংগ্রাম কবিকে প্রতিনিয়ত ক্লান্ত করেছে। অসুস্থ রাজনীতি কবিকে বিচ্ছিন্ন করেছে মানুষের কাছ থেকে। কবিমন চেয়েছে শান্তি, বিশ্রাম, আনন্দ। তেমনটি জোটেনি ভাগ্যে। কখনো কখনো নিজেকে ‘অভিশপ্ত সিসিফাসের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন।
“তবুও আমার কাজ প্রতিদিন হাঁটা
তবুও আমার কাজ প্রতিদিন চলা
প্রতিদিন পানীয় গৃহ আহার্য সন্ধান।”
(সিসিফাস, সারাটা জীবন ধরে)
সিসিফাস কবিতায় মানুষের জীবিকার সন্ধানকে কবি সিসিফাসের সংগ্রামের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমরা জানি, অভিশপ্ত গ্রিক দেবতা সিসিফাস শাস্তি পেয়েছিলেন পাহাড়ে পাথর গড়িয়ে পাহাড়ের উপরে উঠানোর কিন্তু পাথর গড়িয়ে পুনরায় নিচে নেমে আসে সারাদিনের পরিশ্রম শেষে সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতেন সিসিফাস। প্রতিদিনের কঠোর পরিশ্রম শেষে পরিশ্রান্ত মানুষ চায় ছায়া, চায় বিশ্রাম।
‘যায় সে নদীর খোঁজে বৃক্ষের ছায়ার স্পর্শ পেতে
যায় সে প্রান্তরে বনে প্রতিদিন দানার সন্ধানে
কখনো তা ভাগ্যে জোটে, কখনো জোটে না।’
(সিসিফাস)
হাজার বছরের প্রাচীন ভারতীয় সমাজের বর্ণপ্রথার (caste system) মাধ্যমে উচুঁ বর্ণের হিন্দু সমাজ নিম্নবর্ণের হিন্দুদের শোষণ করেছে। পায়ের নিচে দাবিয়ে রেখেছে। তারই এক প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ‘একলব্য’।
একলব্য তথাকথিত নিম্নবর্ণের বীর যোদ্ধা তাকে স্বীকৃতি দেয়নি অভিজাত শ্রেণি। একলব্য এখানে প্রতীক, নিম্নবর্ণের বা অনভিজাতশ্রেণীর সৃষ্টিশীল মানুষের। যারা অভিজাত শ্রেণির তৈরি কাঁটাতারের বেড়াজালে রক্তাক্ত হয়েও স্বীকৃতি পায় না। অভিজাততন্ত্র তাদের স্বীকৃতি দেয় না। একলব্যের প্রতিবাদ এই অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে, একলব্যের এই প্রতিবাদী কবিতা বর্তমান সময়েও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
‘আমরা অনার্য তাই প্রত্যাখ্যাত পূজা অধিকারে
শ্রদ্ধায় পাবো না ছুঁতে ওই পদ
-অযোগ্য দয়ার
পাবো না শ্রমের মূল্য – তোমাদের উজ্জ্বল কাতারে
দাঁড়াতে দেবে না স্থান – ছিল এটা
কল্পনা বার।
অতপর তোমাদের – অভিজাত বেদীর উপরে
অনার্য এ ভক্ত দ্রোহী থুতু ছোঁড় আজ ঘৃনাভরে।
(একলব্যের ঘোষণা, সারাটা জীবন ধরে)
‘সারাটা জীবন ধরে সরব নীরব প্রতিবাদ
কোমল কঠিন প্রতিঘাত
অহিংসা সহিংসা প্রতিরোধ
চেঙ্গিস হালাকুর মুখোমুখি
ডানে বামে ছুটোছুটি
সারাটা জীবন ধরে সারাটা জীবন’
(সারাটা জীবন ধরে)
মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যে নিরন্তর চেষ্টা তার প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়েছে সারাটা জীবন ধরে কবিতায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির আশা আকাঙ্খা পূরণের চেষ্টা মতাদর্শগত বিরোধ, নিরাপত্তা, শান্তির আশায় ছুটোছুটি, স্বপ্ন ও আশাভঙ্গ, দার্শনিকদের মতবাদে উজ্জীবিত হওয়া, নতুন স্বপ্নে আশায় বুক বাঁধা। টানাপোড়েনের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সারাটা জীবন অতিবাহিত হয়।
‘সারাটা জীবন ধরে দেশ থেকে দেশে
গৃহ থেকে গৃহান্তরে
স্বপ্ন থেকে স্বপ্নান্তরে
প্রবেশ প্রস্থান উত্তরণ
বারবার অন্বেষণ নিরাপদ সুনিকেতন।’
(সারাটা জীবন ধরে)
নিজ গ্রাম, জন্মস্থান তাকে বারবার ডেকেছে। কখনো নগর জীবনের চাকচিক্যে কবি গ্রামকে ভোলেননি। প্রিয় গ্রামে বারবার খুঁজেছেন শৈশব কৈশোরের শান্তি। কিন্তু না, বদলে গেছে সব, মাতৃহারা গ্রামে নিজেকে আগন্তুক মনে হয়েছে তাঁর।
‘কে যেন করছে তাড়া ফিরে যেতে জন্মের ভিটায়
বহুদিন ধরে তাই অনাত্মীয় রাজপথ ছেড়ে
স্মৃতির সড়ক ধরে ফিরে আসি আদি ঠিকানায়
অভ্যর্থনা দিল সেথা বন্ধুগণ কৃষ্ণবস্ত্র নেড়ে।’
[জন্মের ভিটায় (এক), সারাটা জীবন ধরে]
কবি আতাউর রহমান এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন ১৯৯১ সালে তাঁর নিজ গ্রাম আক্কেলপুরে। বহুদিন পর শৈশব, কৈশোর, যৌবনের নানা স্মৃতি খুঁজছেন মনে মনে, মায়ের মুখ দেখার তীব্র পিপাসা তিনি অনুভব করছেন, ভাইয়ের কন্ঠস্বরও যেন শুনতে পাচ্ছেন, কিন্তু না সেভাবে আর কিছুই পাওয়া গেল না। প্রিয় গ্রাম যেন তাকে অভর্থনা জানালো ‘কৃষ্ণবস্ত্র’ নেড়ে।
‘জনান্তিকে বলে কেউ – লোকটাকে মনে হয় চেনা,
কৌতুহলী হয়ে কেউ অচেনার মতো কাছে আসে
সঙ্কোচে বাড়ায় হাত আরে এটা আতাউর না-
বয়স বেড়েছে খুব– ব’লে মৃদু সকৌতুক হাসে।’
[জন্মের ভিটায় (দুই)]
জন্মের ভিটায় এসে কবি যে শান্তি পাবেন ভেবেছিলেন তা আর হলোনা ‘অতৃপ্তি দহন’ তাঁকে তাড়া করে ফিরলো।
অন্যদিকে কবির রোমান্টিক মন শান্তির জন্য প্রিয়জনকে খুঁজেছে প্রিয়তমার কাছে কখনো পেয়েছেন পরম শান্তি কখনো বিষাক্ত ছোবল। তিনি ফুলের মাঝে দেখেছেন সাপের উপস্থিতি, কণ্টক। কখনো সুগন্ধী ফুলের বদলে পেয়েছেন ধুতরার বিষ।
‘গোলাপই দিয়েছি হাতে জানি না কেমন করে তারা
হয়ে গেল ধুতরা ফুল– জানি নাতো জানি না কি ক’রে
——————————————–
গোলাপেই দিয়েছি হাতে– সোনালী প্রত্যয়ে বেঁধে মন
জানি না কি করে পেলো নাগিনীর স্বভাব এমন।
(শীতল ঝর্ণার নামে, সারাটা জীবন ধরে)
‘কখনো কখনো অচেনা হয়ে যায় প্রিয় চেনা মুখ।
প্রিয় মানুষকে চেনার কাজ বহুদিনে হলো না সফল
তোমার চারদিকে যেন সর্বদাই আধাঁর দেওয়াল
——————————————–
‘যতই হাসির দীপ্তি মুখে-চোখে ছড়াক ,,,
অপরিচয়ের মেঘ সরে না সরে না সত্তা থেকে
উচ্চকন্ঠ উচ্চারণ শব্দরাজি দুর্বোধ্য জটিল
তোমাকে চেনার কাজ সরল অঙ্কের মতো মেলানো কঠিন।’
(মেলানো কঠিন, সারাটা জীবন ধরে)
কবি মানস গড়ে ওঠে তাঁর উপলব্ধি, সংবেদন আর দার্শনিক চিন্তা থেকে। কবির অনুভূতি, কাব্যশৈলী সমৃদ্ধ হয়ে উঠে নিয়মিত অধ্যয়ন থেকে। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ ছাড়াও কবি আতাউর রহমান আগ্রহী ছিলেন দর্শনশাস্ত্রে এবং ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিষয়ে। প্রাচীন ও আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন মার্কস, স্টুয়ার্ট মিল, রাসেলের দার্শনিক চিন্তা কবির অধ্যয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, ধর্ম নিয়েও তিনি গভীর অনুসন্ধান করেছেন। মুখোশধারী ধার্মিকদের চরিত্র তার কবিতায় এসেছে। তিনি বলেছেন, “ধর্ম নিরপেক্ষ চেতনা অর্জন করার জন্য যে শিক্ষা ও মনন প্রয়োজন অনগ্রসর সমাজে তাঁর অভাব থাকে। ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য তারা ধর্মের দ্বারস্থ হয়।” (আত্মজীবনী, দিনের সব তারাই আছে রাতের আলোর গভীরে, শৈলী)
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি দুটি উল্লেখযোগ্য কবিতা রচনা করেছেন। একটি হলো মুক্তিযুদ্ধের বিজয় গৌরব যেন হারিয়ে না যায় তাই তিনি লিখেছেন ‘এই উৎসবের ফুল’
‘এই উৎসব ফুল সহজে ফোটেনি মূলে তার
অনেক শ্রমের স্বেদ, অনেক ক্ষুধার লোনা জল
দুর্যোগ আঘাত সয়ে ঢালিয়াছে শুভ্র পূত সার
স্নিগ্ধ করেছে তাকে প্রেমদগ্ধ চোখের কাজল।
—————————————
‘ফুল ফোটালেই কি রক্তস্রোত থেমে যাবে শ্রদ্ধা বেদনায়?
ফুলের প্রভুদেরও অস্ত্র হাতে জাগাতে হয় অতন্দ্র অটল
না হলে পায় না রক্ষা রক্তের অর্জিত ফুল হায়নার ক্ষুধা গ্রাস থেকে।’
(বাংলাদেশের কবিতা ১৯৯৯)
কবিরা শান্তিকামী। শান্তির দূত। শান্তির বার্তা নিয়ে আসে তাঁদের এক একটি কবিতা। জীবন সায়াহ্নে অসুস্থ অবস্থায় কবি শান্তি খুঁজেছেন, প্রিয় মানুষের কাছে চেয়েছেন শান্তি আর ঘুম। জীবনের হিসাব নিকাশ তবু চলছে, ঢেউয়ের মতো সময় চলে যাচ্ছে, অন্ধ অন্বেষণে প্রশান্তি খুঁজেছেন কবি।
‘অন্ধকার শূন্য পথে মন চলে তোমার উদ্দেশ্যে
—————————————
‘তোমাতে সে নীড় খোঁজে – খোঁজে স্থিতি প্রশান্তি বিরাম
পৃথিবীর ক্লান্তি ক্ষতি তোমার সামীপ্য পেয়ে ফুল
হয়ে ফুেট,- রূপগন্ধে প্রাণ হয় হৃদ অভিরাম
বিবর্ণ কুটিরে পড়ে চন্দ্রালোকে আনন্দ- ব্যাকুল।
সংসার সংকীর্ণ রূঢ় – প্রতিদিন দায়িত্বের ভার
কশাঘাতে দীর্ণ করে হৃদয়ের সবুজ কুসুম
তুমি কাছে এলে ভুলি সেই ব্যথা দুর্বহ বোঝার
বিক্ষত শরীরে মনে নামে আর্শীবাদ ঘুম।
দিন শেষ হয় তবু বণিক মনের বেচাকেনা
হয় নাকো শেষ চলে টানাপোড় ক্ষতির লাভের
সুরভি ছড়ায় তবু তোমার শরীর হাসনাহেনা
দিবসের দাহ শেষে তুমি আমি যাত্রী বাতাসের।
(যেমন তোমাকে পাই, বাংলাদেশের কবিতা ২০০০)
বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে কবি আতাউর রহমান একটি উল্লেখযোগ্য নাম। লেখক, গবেষক অধ্যাপক মুস্তাফা নূর উল ইসলাম বলেন- “কবি অভিধাটি যেন তাঁর মূল নামেরই অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল। আমাদের কাছে শুধু আতাউর রহমান নন, যবে থেকে চেনা জানা তদবধি গোটাগুটি তিনি কবি আতাউর রহমান। অন্যথায় যথাযথ চিনে নেয়া দুষ্কর। আবার ভুল যেন না বুঝি। ‘কবি’ চিহ্নিত এই মানুষটি জনপ্রচলিত সাধারণার্থে কিন্তু কদাপি নন আকাশচারী ভাবলোক বাসিন্দা। বরঞ্চ ‘সত্যম’ ‘সুন্দরম’ সততই তাঁর কাছে বাস্তবতার মর্ত্য ভুবন, প্রকৃতি এবং শ্রমজীবী মানুষ। বলবার অপেক্ষা রাখে না। অতএব কলমকে হাতিয়ার বানিয়ে বাহন করে নিয়ে ছিলেন প্রধানতই কবিতা আঙ্গিক।”
“তাঁর কবিতায় গণমানুষের সংগ্রাম ও সাম্যবাদের চেতনা বারবার প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যেও সমালোচক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের রচনা ঐ একই চেতনা থেকে বারবার তাঁর আলোচনার বিষয় হয়েছে। কবিতার মত মননশীল রচনাতেও তাঁর পরিচ্ছন্ন চিন্তা ও মার্জিত রুচির পরিচয় আছে।”
‘সারাটা জীবন ধরে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে তিনি জীবন সম্পর্কে দার্শনিক তত্ত্বে উপনীত হয়েছেন। পরিণত জীবনের কবিতাগুলোতে আবেগ সংহত হয়ে এসেছে, বুদ্ধি আর উপলব্ধি কবিতাকে মননশীল রূপ দান করেছে। এই প্রবন্ধে কবি আতাউর রহমানের কাব্যজগতকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছি। তবুও তাঁর অনেক কবিতা, লেখা হয়তো অগোচরে রয়েছে। একজন কবির কাব্য সমালোচনার সীমাবদ্ধতা হয়তো রয়েই গেল। অনাবিষ্কৃত আতাউর রহমানকে আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা চলতেই থাকবে।
নিয়মিত কাব্যচর্চা ক্রমশ তাঁকে পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে। কৈশোর থেকে তিনি ভালোবেসেছেন, সাহিত্যচর্চা সংস্কৃতিচর্চা ও রাজনীতি। এগুলো তিনি আরোপ করেনি, এগুলো তাঁর দেহের রক্তে প্রবহমান ছিল, এগুলোই তাঁর জীবন, তাঁর সত্ত্বা।
কথা সাহিত্যিক রাহাত খান তাঁকে বলেছেন মানবতাবাদী কবি। “কবি আতাউর রহমান প্রথম যৌবনে তাঁর বারো চৌদ্দ বছরের বড়ো রনেশ দাশগুপ্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। নিজে তিনি একথা আমাকে বলেছেন। ভাবতেন রনেশ দাশগুপ্তের মতো নির্লোভ নিরহঙ্কারী এবং সত্যনিষ্ঠ হবেন। আতাউর রহমান জীবনের ধারায় হয়তো রণেশ দাশগুপ্তের মত হতে পারেননি, তবে একজন প্রতিভাবান বন্ধুবৎসল এবং মানবতাবাদী কবি হতে পেরেছিলেন ঠিকই।
লেখক:
ড. শবনম নাহিদ স্বাতী, কবিকন্যা, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা কমার্স কলেজ
বাঙালীয়ানা/এসএল