১৫ অক্টোবর: আমাদের পথ চলার বাঁকে । ক্যাথেরীনা রোজারিও কেয়া

Comments
আমরা তখন খানিক অস্পষ্ট আদর্শে  বিশ্বাস করে প্রচণ্ড আবেগ আশ্রিত হয়ে একটি  সাংস্কৃতিক  সংগঠনের সাথে যুক্ত। নাম স্বরশ্রুতি।  রাউফুন বসুনিয়া  নতুন  বাংলা ছাত্রসমাজের  বুলেটে প্রাণ দিলো ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন   ইউনিভার্সিটি  ল্যাবোরেটারী স্কুলের সামনে, শহীদ মিনারে তখন চলছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের একুশের অনুষ্ঠান। সে সময়টাতেই ঢাকার শহীদ মিনারের অনুষ্ঠান দিয়ে আমাদের  যাত্রা শুরু ।
আমি আমার বড় দু’বোন স্বরশ্রুতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য খৃস্টিনা রোজারীও আর ক্ল্যারা রোজারীওর হাত ধরে সংগঠনের গোড়া থেকে জড়িত আছি। মাত্র কলেজে উঠেছি, বিকেল বেলাতে টিএসসি তে আসি মহড়া দিতে। যা দেখি আনাড়ী মনে, অনভিজ্ঞ চোখে, তাই-ই ভাল লাগে।
স্বরশ্রুতিকে নিছক একটা সাংস্কৃতিক দল না ভেবে,   ভাবতে শুরু করেছিলাম এটা একটা আদর্শগত লড়াই। একটা  মঞ্চ যা কিনা সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা বলবে। লেখার গোড়াতেই বলেছিলাম অস্পষ্ট আদর্শ এই কারণেই যে এতে রাজনৈতিক দলের কোন দলীয় প্রভাব ছিল না। তবে হয়ত  সামাজিক আদর্শ ছিল। আর আদর্শ তো বোধ নির্ভর ।
এ  সময়টা ছিল ঢাকাবাসীর জন্যে খানিকটা দম আটকানো। এর কদিন পরেই মার্চের ১ তারিখে এরশাদের পীড়ননীতি কড়াকড়ি প্রয়োগে মাইক্রোফোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ হল, সড়ক দ্বীপ বা  জনসমক্ষে অনুষ্ঠান করতে বিশেষ  সরকারী  অনুমতির সিদ্ধান্ত আরোপ হোল।  তাই বলে অনুষ্ঠান তো থেমে থাকতে পারে  না, আমরা ভাবলাম পহেলা বৈশাখ আসছে অথচ আমরা অনুষ্ঠান করব না তাও কি হয়। স্বরশ্রুতির আরেক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সাগর লোহানী ছুটলেন অনুমতি আনতে, অনেক চেষ্টা তদবিরে তা পেয়েও গেলাম। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে  আবৃত্তির অনুষ্ঠান করলাম ”জন্মান্তরের মহাকাব্য”। বললাম পহেলা বৈশাখতো শুধু হালখাতা আর পায়েস খাওয়াই নয়। রমনা পার্কের আয়োজনই নয়। এটা মেঠেল গতরের মেহনতি মানুষের রক্ত নির্ঝর বয়ে নিয়ে  আসা রুঢ় বঞ্চনার কাহিনীও বটে। যে কাহিনী  লেখা হয় না। তারা এ’বছরের খোরাকীর ধান দিয়ে গত বছরের দেনা শোধ করেন। সীমিত সুযোগ থাকায় এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা শুধু চেতনাটা জাগানো ছাড়া আর কিছু করতে পারবো না জানতাম।
আমারা সেই যে অস্পস্ট আদর্শ থেকেই মাল্টিন্যাশনালের অনুদান প্রত্যাখান করতাম। মনে পড়ে সেই  অনুষ্ঠানের ব্যাক স্ক্রীন করেছিলাম লাশ ঢাকার চাটাই দিয়ে, স্বল্প আয়ের পিতা যেমন ফুল দিয়ে সাজিয়ে কন্যা বিদায় করেন সোনা দানা যোগাড়ে সামর্থ থাকে না বলে, অনেকটা সেই রকমই,  সে  চাটাইয়ের ওপর  আলপনা করেছিলাম। লাল, নীল কাগজ কেটে সাজিয়েছিলাম তাকে।
সে সময়ে নীলক্ষেত থেকে তূলো কাঠ এর তক্তা কিনে ফ্রেম বানিয়ে তাতে সস্তা পপলিনের কাপড় জড়াতাম উইংস এর জন্যে।  পোস্টার লাগানোর জন্যে লোক ভাড়া করতে পারতাম না। মনে আছে একবার আমি আর বন্যা লোহানী চাংখার পুলের থেকে পোস্টার লাগাতে লাগাতে টিএসসির দিকে আসছি, বগলে পোস্টারের রোলগুলো, এক হাতে বালতিতে ময়দা দিয়ে বানানো আঠা আর অন্য হাতে এক টুকরো কাপড়, আঠা লাগানোর জন্যে। ঢাকা শহরে পোস্টার লাগানোর অলিখিত কিছু নিয়ম আছে, যেমন কিছু রাস্তায় বাঁ দিকে, কিছু রাস্তায় ডান দিকে লাগাতে হয়। বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হয় কোন পোস্টারের ওপর লাগানো হচ্ছে, কোন পোষ্টারের  গুরুত্ব কতটা।  অনেকক্ষণ  ধরেই আমাদের লক্ষ্য করছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্ন্যাক (ডাস) এর সত্তাধীকারী মোঃ জ়সিম,  কবিতা বা অন্য কোন সাস্কৃতিক কর্মকান্ডে যার তেমন কোন পদচারণা ছিল না। সে এসে  বলেছিলেন “সরেন, আমরা করি। মেয়েরা এই কাজ করছে দেখতেও তো খারাপ লাগে!” মেয়েরা পোস্টার লাগাচ্ছে খুব একটা দেখা যেতো না সে সময়ে বলেই হয়তো।
১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর। খবরটা জানলাম টেলিভিশন থেকে । জগন্নাথ হলের ছেলেরা টিভি রুমে   শুকতারা নামের ধারাবাহিক নাটক দেখছিলো, হঠাৎ ছাদ ধ্বসে সঙ্গে সঙ্গে ৩৪ জনের মৃত্যু পরে হাসপাতালে আরো ৫ জনের। ভীষণ অস্বস্তিতে কেটেছে সারা রাত। মনে হচ্ছিল মৃত্যু কেমন ওৎঁ পেতে  বসেছিলো ছিল ওদের সামনে।
কিছু কষ্ট আছে বরফের মতো হৃদয়ের ভেতরে গলে যায় কিছু কষ্ট আছে ভেতরে পাথরের মত চেপে বসে। সেই ছাদের নীচে চাপা পড়া ছেলে গুলোর জন্যে পাথর কষ্ট গেঁথে গিয়েছিল আমাদের বুকে।
পরদিন ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর থমথমে, ততক্ষণে জগন্নাথ হলের সামনে বিশাল লাইন। উৎসুক ছাত্রছাত্রী রাস্তায় নেমে এসেছে রক্ত দেবার জন্যে। কর্তৃপক্ষ জানাতে বাধ্য হচ্ছে যে অত রক্ত ধারণের ক্ষমতা তাদের নেই।
টিএসসি–র  দারোয়ান মান্নান ভাই আমাদের দেখে ছুটে এসে বলেছিলেন “আমি হ্যারিকেন নিয়া গেছি বিছরাইতে আপনাগো কেউ আছে কিনা? এই বুড়ো মানুষটার আবেগ আমাদের চোখে  জল এনেছিল সেদিন, আত্মার আত্মীয়তো এই-ই।  কীই এমন বাধঁন তার আমাদের সাথে, আমরা রোজ রিহার্সেল করি আর তিনি রিহার্সাল ঘরের দরজা খুলতে, বন্ধ করতে করতে  টুকটাক কথা বলতেন এই-ই তো। মনে মনে বলেছিলাম যে ছাত্ররা মারা গেছেন তাদের সাথে হয়ত আমাদের কখনো দেখাও হয়নি কিন্তু কেমন করে বলি ওরা আমাদের কেউ নয়?
সেদিন ঢাকা টেলিভিশন থেকে আমন্ত্রণ এল পরদিনের জন্যে একটা অনুষ্ঠানের। পরদিন সন্ধ্যে বেলা সরাসরি প্রচার করা হবে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে কয়েক পলকের মধ্যে মানুষ কেমন মিলিয়ে যায় বুদবুদের মতন।  সতীর্থ সাগর লোহানীর বাসায় জড়ো হলাম আমরা । স্ক্রীপ্ট তৈরী হচ্ছে, সন্ধ্যে বেলা প্রচারের ব্যবস্থা হয়েছে। অন্যান্য সময়  স্ক্রীপ্ট করার সময়ে যে উদ্দামতা থাকে, তা থমকে গেছে। আমার মা  স্ক্রীপ্টের জন্যে খুঁজে  দিলেন  রবীন্দ্রনাথের একটি  কবিতা – এ যেন জগন্নাথের ঘটনার  সাথে মিলিয়েই লেখা। তবে কি  সব শোকের  চেহারাই এক ? ঘটনাটি ঘটে পুজোর সময়ে আর কবিতায় -তাই ছিল- পুজোর ছুটিতে ছেলে ঘরে ফিরবে, মায়ের সেকি ব্যস্ততা আর আয়োজন, তবু  ছেলের যাওয়া হয় না। জগন্নাথের ছাত্ররা যেমন অপেক্ষা করছিল পরীক্ষা শেষের জন্যে, তারাও প্রস্তুতি নিচ্ছিল পুজোর ছুটিতে বাড়ী যাবার জন্যে। যত্ন করে , প্রাণ উজাড় করে কবিতাটি আবৃত্তি করলেন সৈয়দ  আজিজ।
 স্ক্রীপ্টের নাম দেয়া হলো “কাঁদো বাংলার মানুষ আজিকে কাঁদো” , এই  গানটিও যুক্ত হলো ।  গাইলেন স্বরশ্রুতির সাথে সদ্য যুক্ত হওয়া সদস্য রাজশাহী থেকে আসা গণশিল্পী সংস্থার জাহাঙ্গীর আলম। গাইলেন “ মাগো তোমার সোনার ছেলে ফিরবে না আর ফিরবে না” । এমন আবেগ তাড়িত হয়ে ছিলেন যে শেষে সুরটা ধরে রাখতে পারলেন না, সহশিল্পীরা অবাক, শোধরানো গেলো না কারণ সরাসরি প্রচার হচ্ছিলো অনুষ্ঠানটা । শুনেছি  জাহাঙ্গীর আলম  বেশ কয়েক বছর আগে  পৃথিবীর পাট চুকিয়েছেন ।
পরদিন টিএসসিতে আসার পথে অনেকেই থামিয়েছে, ধন্যবাদ জানিয়েছে, বলেছে আমাদের অনুষ্ঠান তাদের হতবিহ্বল হৃদয় থেকে শোককে মুক্ত করতে সাহায্য করেছে। শুনে চোখ , মন দুইই ভেসেছে আবেগে। অনুষ্ঠানের পর অভিনন্দন জানালে যে আনন্দ হয় , সে দিন তা হয় নি বরং মন খারাপ  হয়েছে ।
এর বছর কয়েক পরের ঘটনা সম্ভবত ১৯৯২। তখনো স্বরশ্রুতি অনুষ্ঠান করছে, অর্ধ শতাধিক মঞ্চায়ন হয়েছে, জাতীয় আবৃত্তি  উৎসবের আয়োজন করছে,  ডাক আসছে বিভিন্ন আয়োজকদের কাছ থেকে। এমনি একটা ডাক এলো বাংলা একাডেমীর কাছ থেকে। যতদূর মনে পড়ে ফেব্রুয়ারী মাস। বিশাল প্যান্ডেল খাটানো হয়েছে। সেদিনের আমাদের স্ক্রীপ্টটা ছিল একটু ভিন্ন ধরনের। আমরা কবিতার মাঝে মাঝে প্রাচীন গ্রিয়টের মত স্মৃতি কথা চাড়িয়ে দিচ্ছিলাম। কবিতার মাঝে মাঝে বলছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশে যারা ক্ষমতার কাছাকাছি আছেন বা ছিনিয়ে নিয়েছেন একাত্তরে তাদের ভূমিকা কি ছিল। বলছিলাম  সংসদ সদস্য সালাউদ্দীন কাদের  চৌধুরী, তার  বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর  নির্দেশে কুন্ডেশ্বরী ঔষাধালয়ের  স্বত্তাধিকারী  বাবু নতুন চন্দ্র সিং এর বুকে পৈশাচিক আনন্দে গেঁথে দিয়েছিল ঘাতক বুলেট, কিভাবে শর্ষীনার পীর, যে কিনা স্বাধীন দেশে  সমাজ সেবায় আর শিক্ষা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছিল তার  নির্দেশে  আটঘর কুড়িয়ানার ধান ক্ষেতে লুকিয়ে থাকা মহিলাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মাদ্রাসার ছাত্ররা। কীভাবে পাকিস্তানীদের হাতে নির্যাতিত বোধ শক্তি হারানো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক উপেক্ষিত হন তার তথাকথিত  প্রগতিশীল সহকর্মীদের দ্বারা। আরো বলছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক কীভাবে  বাঙ্গালী নারীদের ওপর অত্যাচারকে জায়েজ করছিলেন মুতা বিবাহ বলে।
হঠাৎ মঞ্চ থেকে লক্ষ্য করলাম, বাংলা একাডেমীর কিছু কর্মকর্তা উঠে দাঁড়িয়েছেন, হাত নেড়ে থামতে বলছেন, বলছেন মঞ্চ থেকে আমাদের নেমে যেতে। অন্য দর্শকরা কিন্তু মন দিয়ে শুনছেন।  লক্ষ্য করলাম সহজেই চিহ্নিত করা যায় এমন কিছু মানুষ এগিয়ে আসছে মঞ্চের দিকে, এভাবেই অঘটন ঘটে।  দেখলাম  মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র কমান্ডের কিছু পরিচীত মুখ আমাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিতে এগিয়ে এলো। শিরদাড়াঁ বেয়ে নেমে আসা ভয়কে সঙ্গী করে আমরা আবৃত্তি করে যাচ্ছি। এ অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে আমাদের আরো হয়েছিল।
মুল প্রসঙ্গে ফিরে আসি।  স্ক্রীপ্টের  শেষ  কবিতাটা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নীরঞ্জণ অধিকারীর  লেখা একটি কবিতা, কবিতায় কবি বলছিলেন একজন রবীনের কথা। যে কিনা সেই যে ১৯৮৫–র ১৫ অক্টোবরের জগন্নাথ হলের  ধ্বসে  যাওয়া ছাদের নীচ থেকে  পিষ্ট দেহ নিয়ে  দৈবক্রমে বেঁচে  গিয়েছিল। রবীন অন্ধকার ভবিষ্যতের হাত থেকে বাঁচতে আত্মহননের পথ  খুজঁছিলো। কবিতাটি কেমন করে কবে আমার মধ্যে  গেঁথে বসেছিল জানি না। মন উজাড় করে আবৃত্তি করলাম। সেটাই ছিল  স্ক্রীপ্টের শেষ কবিতা। মজার কথা হলো এই অনুষ্ঠান এরপর বাংলা একাডেমীর একজন পরিচালক দেশের অন্যতম প্রধান কবি বলেছিলেন ”প্রতিবছর এই  অনুষ্ঠানের জন্যে আমরা কিছু টাকা পাই বাজেটে, এরপর থেকে ওটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, শিল্পী নির্বাচনের যে  স্বাধীনতা পেতাম  ওটা আর পাবো না  বোধ হয়, না করলেই পারতে আজ এই স্ক্রীপ্টটা, না বললেই পারতে এতো পুরোন সব কথা।
মেলা ভাঙ্গা কষ্ট নিয়ে  অনুষ্ঠান শেষে  হাততালি  আর  চোখ ধাঁধানো  আলো থেকে সরে আসছি। মঞ্চ থেকে নামার জন্যে যাত্রার মঞ্চের মত কাঠের একটা তক্তা রাখা হয়েছে, খুব সাবধানে পাশে বাঁধা বাঁশটায় হাত রেখে পা ফেলছি, সামনে দেখি অপরিচিত একটা মুখ। জিজ্ঞেস করল  ‘ আপনার কবিতায় যে রবীনের কথা বললেন, চেনেন কি তাকে? মাথা নেড়ে বললাম “না”। বললো “এই আমি”। যতদূর মনে পড়ে পরনে গাঢ় নীল শার্ট, চোখে চশমা আর একটা হাত গলা থেকে দড়ি দিয়ে বুকের উপর ঝোলানো । এটা আমার ভ্রম বা স্মৃতির প্রতারণাও হতে পারে। ভালো করে কিছু  বোঝার আগেই বাংলা একাডেমীর ধূলো আর জনারণ্যে হারিয়ে গেল সে।
আমি ছোট বেলা থেকেই বাস্তবতা বিবর্জিত একটা মানুষ। মনে আছে তখন আমি হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়ে শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। কোন এক ছুটিতে সব শিক্ষকরা ট্রেনে করে ঢাকা ফিরছি। একজ়ন্  সহকর্মী জানালার  শার্শীর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন “কখনো সাদা মোষ দেখেছেন?” আমি বললাম “না”  দেখলাম দূরে জলার ধার ঘেঁষে সাদা রঙের মোষ বসা। বাসায় এসেই বাবাকে বললাম, ‘বাবা আজ় নতুন জিনিস দেখেছি’। বাবা বললেন ‘ গরমের দিনে মোষ কাদা জলে গা ডুবিয়ে বসে থাকে। পাড়ে উঠলে ওই কাদা শুকিয়ে ওদের সাদা দেখায়, তোমার সহকর্মী তোমার সাথে রসিকতা করেছে’। একবার মনে আছে আমার একজন সহকর্মীকে  নিয়ে শাহপরানের মাজারের কাছে কোন একটা অফিসে কি যেনো কাজে গেছি। কাজটা  তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়ায় সহকর্মীকে বলেছিলাম, চলো এতটা পথ যখন এলামই, খুঁজে দেখি বিশেষ দ্রষ্টব্য কিছু আছে কিনা ধারে কাছে। কাছেই ২২/২৩ বছরের একটি ছেলেকে দেখে বললাম ”এখানে বিশেষ  দ্রষ্টব্য কিছু আছে? কোনো দর্শনীয় স্থান?
ছেলেটি বলল, ’আছে’। টানা পনেরো কুড়ি মিনিট হাঁটিয়ে একটা আটচালা টিনের ঘরের সামনে এনে বলেছিলো “দেখেন আমাদের বাসা, আমার কাছে তো এটাই দর্শনীয় স্থান” এরকম  বহু রসিকতার, ফাঁকির সম্মুক্ষীণ হয়েছি, এখনও হই।
জানিনা আমার সেদিনের রবীন এমন কোন ফাঁকি, এমন কোন রসিকতা ছিলো কিনা। কিন্তু ১৫ অক্টোবর এলেই মনে হয় বাংলা একাডেমীর মঞ্চে কবিতার রূপক চরিত্রের চোখের সামনে এসে দাঁড়ানো, যার বাস্তব অস্তিত্ব আছে বলে কখনোই ভাবিনি, মনে হয় ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে দিয়ে  জগন্নাথের দিকে যাবার পথ, কার্তিক ঠান্ডার সন্ধ্যে, বেলে জোৎস্না, বাউরী বাতাস তার  সাথে অদ্ভুত সুন্দর কিন্তু দম আটকানো এলাচ এলাচ একটা ফুলের গন্ধ। পরে জেনেছি  ওটা নাকি ছাতিম ফুলের গন্ধ, দেখতে মোটেও  আকর্ষনীয় নয়।  এতো গুলো বছর পরেও আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে, স্মৃতিকে গ্রাস করে ১৫ অক্টোবর।
বেঁচে যাওয়া ছাত্রদের বলাবাহুল্য পুনর্বাসন হয়নি কখনোই। ১৫ অক্টোবর এলেই এখনো ভাবি সেই রবীন শারীরিক মৃতুর হাত থেকে বেঁচে গেলেও – পিষ্ট দেহ, পিষ্ট মন নিয়ে পেরেছে কি জীবনের অনুদারতা থেকে  বাঁচতে?
লেখক পরিচিতি:
Catherina Rozario
ক্যাথেরীনা রোজারিও কেয়া
প্রাক্তন শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় সরকারী কর্মকর্তা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.