গ্রামের নাম কর্ণ পাড়া। ১৯৮৯ সাল। শুটিং চলছে একটি কোর্স ফিল্ম “চোরাস্রোত”-এর। ১১ জন শিক্ষার্থী, তারা সবাই ডিরেক্টর, ক্যামেরাম্যান, অভিনয় শিল্পী। এই টিমের শিক্ষাগুরু হিসেবে আছেন স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর কবির ও উপমহাদেশ খ্যাত ক্যামেরা পরিচালক বেবী ইসলাম।
বিকেলের সূর্য যখন ডুবছে তখন পরিচালক আলমগীর কবির বললেন – প্যাক আপ। শুটিংয়ের সব যন্ত্রপাতি প্যাক করা শেষ তখন হঠাৎ ক্যামেরা গুরু বেবী ইসলাম বললেন, ক্যামেরা বসাও, আমি শট নেবো ডুবন্ত সূর্য ও সদ্য ওঠা চাঁদের।
কবির সাহেব বললেন, অসম্ভব, এ ছবি উঠবে না।
বেবি ইসলাম আই পিসে একবার লুকথ্রো করে অ্যাপারচার আর ফোকাস সেট করে বললেন, আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন। বেবী ইসলাম শট নিয়েছে আর সে শটে ছবি ওঠেনি সেটাই হচ্ছে আসল অসম্ভব। যান।…
বাকিটা ইতিহাস। ঐ ছবি উঠেছিল, তা “চোরাস্রোত”-এ সংযুক্তও হয়েছিল এবং আলমগীর কবির বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, বেবী ভাই আপনার হাতে ম্যাজিক আছে।
অথবা তারও আগে, ১৯৭৩-৭৪ সালে, যখন পৃথিবীর সেরা ২০ চলচ্চিত্রকারের একজন ঋত্বিক কুমার ঘটক বাংলাদেশে এসেছিলেন “তিতাস একটি নদীর নাম” ছবির শুটিং করতে তখন তাঁর সঙ্গে ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করেন বেবী ইসলাম। ঋত্বিক ঘটক বেবী ইসলামের ক্যামেরা মেধা দেখে এতোই মুগ্ধ হন যে তিনি তাঁর শেষ ছবি “যুক্তি-তক্কো-গপ্পো”-র জন্য বাংলাদেশ থেকে বেবী ইসলামকে নিয়ে যান। সে সময় টালিগঞ্জের কলাকুশলীরা বেবী ইসলামকে ভিনদেশের নাগরিক এই অজুহাতে কাজ করতে বাধা দেন। কিন্তু ক্ষ্যাপা ঋত্বিক তা শুনবেন কেন! তিনি বললেন, এই টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি জন্ম দিয়েছে বেবী ইসলামকে। ও কাজ করবে। আমি ওকে নিয়ে কাজ করব। দেখি কার ঘাড়ে ক’টা মাথা।
এরপর আর কেউ বিষয়টা নিয়ে জল ঘোলা করেনি বরং পরে অনেকেই এসে বেবী ইসলামের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন।
কথা সত্যি যে বেবী ইসলাম টালিগঞ্জের বিখ্যাত পরিচালক-ক্যামেরাম্যান অজয় করের ৬ নম্বর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন এবং একে একে সব ধাপ অতিক্রম করে তিনি এক সময় টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম সারির ক্যামেরাম্যান হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। কোলকাতা ছাড়াও তিনি বোম্বে ও মাদ্রাজেও কাজ করেছেন।
১৯৮৭ সালে ‘নিমকো’ (জাতীয় গণমাধ্যম ইন্সটিটিউট) একটি বিশেষ কোর্স শুরু করলো। ‘চলচ্চিত্র নির্মাণ ও ক্যামেরা কৌশল’ শীর্ষক সেই কোর্সে আমরা ১৫/১৬ জন অংশ নেয়ার সুযোগ পেলাম। প্রায় এক বছর থিওরিটিক্যাল ক্লাস শেষে যখন হাতে-কলমে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু হলো তখন শাহরিয়ার উল মুল্ক, আসিফুল হুদা, ফিরোজ আহমেদ, সাগর লোহানী, আমিনুর রহমান বাচ্চু, তারেখ মিন্টু, ফিকশন ইসলাম, শ্যামল ভাদুড়ী, মাসুদুর রহমান, সুকল্প গুপ্ত পুলক টিকে ছিলাম। হাসানুল হক মাঝ পথে কোর্স ছেড়ে গেছিল।

শিক্ষক হিসেবে আমরা পেয়েছিলাম চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর কবির (কোর্স ডিজাইনার), বেবী ইসলাম, শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, চিত্রগ্রাহক গোলাম মুস্তাফা ও আনোয়ার হোসেনসহ আরও কিছু গুনীজনকে যাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে শীর্ষে অবস্থান করেন। আমাদের কোর্সের পরিচালক ছিলেন সৈয়দ সিদ্দিকুর রহমান। খুবই আন্তরিকতা ও ধৈর্যের সঙ্গে তাঁরা আমাদের চলচ্চিত্রের নানা বিষয়ে পাঠদান করতেন। আমরাও সশ্রদ্ধ চিত্তে তা গ্রহণ করতাম। গুরু-শিষ্যর মধ্যে একটা সৌহার্দপূর্ণ আবহ বিরাজ করত সব সময়। কিন্তু একমাত্র বেবী ভাই ছাড়া আর কারো সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। কারণ বেবী ভাইয়ের মধ্যে আমরা পেয়েছিলাম পিতৃসুলভ স্নেহ ও প্রশ্রয়।
ক্ষিধে পেয়েছে? চল বেবী ভাইয়ের বাড়ি। আড্ডা দেওয়ার জায়গা নেই? চল বেবী ভাইয়ের বাড়ি। বেবী ভাই ছাদ পার্টি করবেন, এই তোরা চলে আয়। এমনই ছিলেন বেবী ভাই। তাঁর লালমাটিয়ার বাড়ির দরজা খুলতো সকাল ৬টায় আর বন্ধ হতো রাত ১২টায়। এর মধ্যে যার যখন ইচ্ছে হচ্ছে, আসছে যাচ্ছে, খাচ্ছে শুচেছ.. এক কথায় বেবী ভাইয়ের বাড়িটা ছিল একটা পান্থশালা। একবার দুপুরে সবাই খাবার টেবিলে খেতে বসেছে, একজন অপরিচিত ভদ্রলোকও বসে খাচ্ছেন। বেবী ভাই ভাবছেন, উনি হয়তো তন্দ্রা বৌদির আত্মীয়। তন্দ্রা বৌদি ভাবছেন, বেবী ভাইয়ের আত্মীয়। একসময় ভদ্রলোক খেয়েদেয়ে চলে গেলেন। বৌদি জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ গো উনি তোমার কোন আত্মীয়? চিনতে পারলাম না তো। বেবী ভাই তো অবাক। সেকি? আমি তো ভাবছি উনি তোমার আত্মীয়।…
চলচ্চিত্রে বেবী ভাইয়ের অনেক অবদান। তার জন্যে স্বীকৃতিও পেয়েছেন কমবেশি কিন্তু আরও কয়েকটা কাজ করে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেই স্বপ্নগুলো তিনি পূরণ করে যেতে পারেননি। যেমন তিনি বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক করতে চেয়েছিলেন৷ বিশাল একটা চিত্রনাট্যও করেছিলেন। পারমিশনের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাব জমাও দিয়েছিলেন৷ কিন্তু সেই প্রজেক্ট আলোর মুখ দেখেনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুসলমানির গল্প’ও করতে চেয়েছিলেন, স্ক্রিপ্ট করিয়েছিলেন, ফাইনান্সারের অভাবে বাদ পড়ে গেছে সেই স্বপ্ন যেমন বাদ পড়ে গেছে একটি নদী, তিনজন ভিন্ন ভিন্ন বয়সী পুরুষ ও এক রহস্যময়ী নারীর গল্প। এটারও স্ক্রিপ্ট করা ছিল। আমাকে প্রায় প্রতিদিনই যেতে হতো এই স্ক্রিপ্টগুলো এডিটিংয়ের জন্য। আমি তখন বেবী ভাইয়ের অন্তর্দহন নিজের চোখে দেখেছি। তাঁর মত মেধাবী সৃষ্টিশীল মানুষ দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কর্মহীন হয়ে বসে আছেন। সত্যি ভাবা যায় না।
শেষে অল্প কিছু টাকা আমরা যোগাড় করলাম একটা বিজ্ঞাপন চিত্র বানিয়ে। আমি তিন চরিত্রের একটা নাটক লিখলাম, যা পুরোটাই ইনডোর ভিত্তিক গল্প। নাটকের নাম ‘মায়াকুঞ্জ’। বেবী ভাই শুটিং করলেন নিজের বাড়িতেই। শুটিংয়ের কাজে এক তলা থেকে চার তলা পর্যন্ত তিনি এমনভাবে ওঠানামা করতেন যেন ১০ বছরের বালক, মনের আনন্দে ছুটে বেড়াচ্ছে। আমি মনে মনে তাঁর নাম দিয়েছিলাম শিশু ভোলানাথ।
আজও মনে আছে ডলি জহুর আপা নাটকের শেষ সংলাপ বলছেন, তৌকির আহমেদ ও বিপাশা হায়াত শুনছেন। ডলি আপা সংলাপ বলেছেন আর তাঁর দু-চোখ বেয়ে নেমেছে জলের ধারা। ক্যামেরার সামনে কাঁদছেন ডলি জহুর আর মনিটরের সামনে বসে কাঁদছেন বেবী ভাই। ডলি আপার ডায়লগ শেষ হয়ে গেছে, অনেক কষ্টে অ্যাকশন ধরে রেখেছেন তিনি কিন্তু ‘কাট’ বলছেন না ডিরেক্টর বেবী ইসলাম। কারণ তিনি নিজের কান্না থামাতে পারছেন না। এমনই আবেগঘন মানুষ ছিলেন আমাদের বেবী ভাই।
কিছুদিন যাবত আমাদের সাংস্কৃতিক বুদ্ধিজীবী মহলে গেল গেল রব উঠেছে। আমাদের সিনেমা.. গেল গেল গেল। আমাদের টিভি.. গেল গেল গেল। আমাদের নাটক.. গেল গেল গেল..। সবাই কিন্তু কারণটা জানেন, মায়াকান্না কাঁদবেন তবু আসল কথাটা বলবেন না, ঝেড়ে তো কাশবেনই না।
যারা একটু বয়োবৃদ্ধ, সরকারি ভাষায় সিনিয়র সিটিজেন তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে প্রিন্সেসদের কথা। ১৯৭৮ সালের দিকে হুট করে যাত্রাপালায় ঢুকে পড়েছিল কিছু দেহ সর্বস্ব প্রিন্সেস ও ডানাকাটা পরীর দল। এক বছরের মধ্যে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে যাত্রা আর কেউ দেখতে চায় না, চায় শুধু প্রিন্সেসদের ডান্স। ব্যাস বছর দশেকের মধ্যে যাত্রা পালা শেষ।
ঐ একই সময়ে চলচ্চিত্রেও নতুন নতুন বিনিয়োগকারী ঢুকে পড়ে এবং প্রিন্সেস টাইপের কিছু নর্তকী আস্তে আস্তে বাজার দখল করতে থাকে। একই সঙ্গে শুরু হয় জ্ঞানী গুনী মানুষদের ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র জগত থেকে বের করে দেয়ার মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন। তার ফলশ্রুতিতে আমরা এম এ সামাদ, বেবী ইসলামসহ অনেক কৃতি মানুষকে বেকার হয়ে যেতে দেখি। এবং চলচ্চিত্রের অগস্ত্য যাত্রা সেখান থেকেই শুরু। আজও চলছে ঐ একই খেলা। বয়স্কদের হটাও নতুন ব্লাড সার্কুলেট করো। ফল কি? ফল হচ্ছে, ১২০০ সিনেমা হল বন্ধ, দেশের টিভি কেউ দেখে না, বিনোদনহীনতার প্রেক্ষিতে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয় ও হানাহানি।
বেবী ভাইয়ের কাছে আমি পেয়েছি গুরুর শিক্ষা ও পিতার স্নেহ। বলতে দ্বিধা নেই লালমাটিয়ার বাড়িটা বিক্রি করে হয়তো একটু মনোকষ্টে ছিলেন। মুখে বলতেন না কিছুই। মৃত্যুর আগে নিজ গ্রামে মায়ের নামে হসপিটাল করে গেছেন। এও তো কম কথা নয়। তবু আমার মনে পড়ে শেষ দেখার কথা। অসুস্থ বেবী ভাই মুখে হাসি টেনে বলেছিলেন, চিন্তা করো না, আমি আর একটু উঠে বসি, আবার পার্টি হবে, সব বন্ধুদের আসতে বলো।
কয়েকদিন পর আমরা বন্ধুরা আপনার কাছে এসেছিলাম বেবী ভাই, আপনাকে শেষ বিদায় জানাতে।
২৪শে মে, ২০১০-এর এই দিনে বেবী ভাই চলে গেছেন মহাপ্রস্থানের পথে। আজ আমি আমার এক স্বপ্নের কথা বলতে চাই আমার সেই সব বন্ধুদের কাছে, যারা বেবী ভাইয়ের স্নেহধন্য শিষ্য ছিল। বিশেষ করে সাগর লোহানী, আমিনুর রহমান বাচ্চু, তারেখ মিন্টু, ফিকশন ইসলাম, পুলক গুপ্তসহ অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আচ্ছা আমরা কি পারি না, সকলে মিলে বেবী ভাইয়ের একটা বায়োপিক বানাতে। গুরুর প্রতি সম্মান জানানোর এর চেয়ে বড় আর কোন শ্রদ্ধাঞ্জলি হতে পারে কি? একটু ভেবে দেখো বন্ধুরা।
আমি খুব সামান্য মানুষ। আমার জীবনের একটাই গৌরব, আমি বেবী ইসলামের শিষ্য। আপনি যেখানেই থাকুন যে ফর্মেই থাকুন, ভালো থাকুন।
লেখক:
শ্যামল ভাদুড়ী, নাট্যকার ও পরিচালক