।। সেবিকা দেবনাথ ।।
৩৮ বছরের জীবনে এই শরীর কত‘আমিও’ বলতে চাই…. অনাকাঙ্খিত স্পর্শ পেয়েছে এর কোন হিসাব নেই। এ তালিকায় পরিচিত মানুষ যেমন আছে তেমনি আছে চলার পথের অচেনা অজানা মানুষ। যৌন নির্যাতনের সংজ্ঞায় যা বলা আছে তা দেখলে কোন নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হননি ‘অনাকাঙ্খিত স্পর্শ’ পাননি তা আমি বিশ্বাস করি না। আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কারও কিছু যাবে আসবে না জানি। কিন্তু আমার বিশ্বাস আমার কাছে অমূল্য।
সাংবাদিকতা করতে এসে এ বিষয়ে যেটুকু জেনেছি/জানছি তাতে ভয়ে আৎকে উঠি প্রতিনিয়ত। ‘আদর’ বলে যাদের স্পর্শকে ছোট বেলায় আমলে নেইনি সেই ‘আদর’ এখন কাটা হয়ে বিধছে। সেগুলো আদৌ আদর ছিলো কি না সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খায় অবিরাম।
ছোট বেলায় খুব দুরন্ত ছিলাম। বন্ধু বা খেলার সাথীর তালিকায় মেয়ের চেয়ে ছেলের সংখ্যাই বেশি ছিলো। পাড়ার দাদু, কাকুর সঙ্গেও আমার দিব্যি আড্ডা জমতো। অল্প দিনেই চায়ের দোকান কিংবা বাড়ির উঠানে তাদের আড্ডার সদস্য হয়ে যেতাম। তখন বয়সটা খুবই কম। গায়ে সব সময় জামা পড়ার অভ্যাসটা আমি রপ্ত করতে পারিনি। কুচি দেয়া ফোলানো হাফপ্যান্ট পড়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াতাম। এ নিয়ে অবশ্য মা’র কম মার খেতে হয়নি আমাকে। খেলতে গিয়ে গায়ে ধুলা বালি মেখে যাবার, গাছে চড়তে গিয়ে জামা ছিড়ে যাবার এবং এজন্য মায়ের বকুনি খাবার ভয়ে জামা খুলে খেলতাম। গায়ে পড়ার কথা মনেই থাকতো না। যাক কথা অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। মূল ঘটনায় আসি। নরসিংদীর যে পাড়ায় আমরা থাকতাম সেখানে এক নামেই আমাকে চিনতো সবাই। বলা যায় জনপ্রিয়ই ছিলাম। এই-ওই উপলক্ষে কিংবা ‘নাই কোন’ উপলক্ষে আশেপাশের বেশ কয়েকটা বাড়িতে আমার নিমন্ত্রণ থাকতো প্রায়ই। কেননা, এ পূজা, ওপূজা, দিবসি (বয়স্ক মানুষের মৃত্যুবার্ষিকী), জন্মদিন, ভাল মন্দ রান্না তো বাদ যেতো না খুব একটা। বাসায় মামা-দাদু-কাকু আসলে আমার প্রথম বায়নাই ছিলো তাদের সঙ্গে আমার ঘুমাতে হবে।
পাশের বাড়ির পুতুল দিদার সঙ্গে আমার খুটখাট লাগলেও বুড়ির সঙ্গে আমার ভাব ভালবাসাও কম ছিলো না। তার চার ছেলে। বড় ছেলে রতন। তাকে কাকুই ডাকতাম। অস্বীকার করবো না দিদার চার ছেলের কাছ থেকেই অম্ভব ¯েœহ পেয়েছি। দিদা বাড়ি না থাকার সুযোগে দুপুরে না ঘুমিয়ে একদিন সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে তার বাড়ির উঠানে খেলছিলাম। হট্টগোলটা একটু বোধ হয় বেশিই হয়ে গিয়েছিলো। ঘর থেকে রতন কাকু বেরিয়ে এলো। ধমক দিয়ে জোর করে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো ঘরে। জোর করে বলেছিলেন ঘুমা। পরে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো ঘুমা। তার হাত ছিলো আমার বুকের ওপর। খেলা বন্ধ করে ঘুমাতে বলেছিলো বলে কাজটা সেই সময় আমার ভাল লাগেনি। আজ ভাল লাগছে না অন্য কথা ভেবে। সত্যিই কি তা আদর ছিলো? নাকি ‘মন্দ আদর’?
প্রতিবেশি দাদু কিংবা কাকুরা যখন দু’হাত দিয়ে পেছন থেকে আমার বুক চেপে ধরতো তখন খিল খিলিয়ে হাসতাম। কে জানে ওই আদর কতটা ‘মন্দ’ ছিলো। কিন্তু একটু যখন বড় হতে লাগলাম তখন এই আদরের প্রতিবাদ করেছি। তখন মা পইপই করে শেখাতেন কেউ ডাকলে হুটহাট করে যেন কারও ফাঁকা বাড়িতে না যাই। কেউ কিছু করলে যেনো তা মাকে বলি। এ কথার মানে বুঝিনি তখন। এখন বুঝি।
অনার্স পড়তে এলাম ঢাকায়। সম্পর্কে দিদা হন তিনি একদিন নিমন্ত্রণ দিলেন তার বাসায়। গেলাম। দুপুরে খেলাম। আড্ডায় এত মশগুল ছিলাম যে কখন যেন ঘড়ির কাটা ৭ টা ছুই ছুই করছিলো। ৮টার মধ্যে হোস্টেলে যেতে পারবো না বিধায় থাকতে হলো সেই বাসায়। আমরা মেয়েরা সবাই এক রুমে আর ছেলেরা অন্য রুমে ঘুমালাম। আমাদের সঙ্গে দিদাও। রাতে ঘুমের মধ্যে টের পেলাম শরীরে কারও হাত। ভয়ে চিৎকার করতে ভুলে গিয়েছিলাম। কুকড়ে গিয়ে ‘ও মা’ বলে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে হাতটা যেন উধাও হয়ে গেলো। কে এই কাজটি করেছিলো তা জানলেও সেদিনও যেমন তা বলতে পারিনি আজও কাউকে বলতে পারিনি।
তখনো আমার হোস্টেলে সিট হয়নি আমি লক্ষ্মীবাজার থাকি। সকাল সাড়ে ৭ টায় ইংরেজি পড়তে যেতাম কলাবাগান স্যারের বাসায়। সদরঘাট থেকে গুলিস্তান এবং গুলিস্তান থেকে কলবাগানের বাসে চড়তে হতো। একদিন গুলিস্তান নেমে কলাবাগানের বাসে উঠবা বলে যাচ্ছি। রাস্তার উল্টো পাশ থেকে এক লোক দৌড়ে এসে কনুই দিয়ে আমার বুকে জোড়ে ধাক্কা দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলেন। রাস্তায় তখন লোকজন খুব ছিলো না। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম রাস্তায়। কাঁদতে কাঁদতে বাসে উঠলাম।
বাসে চড়তে, রাস্তায় চলতে গিয়ে তো এ জীবনে আর কম নিগ্রহ হইনি। সেগুলো আমার মতো অনেক মেয়েই হয়। সর্বশেষ সাংবাদিক এক নেতার কথা বলি। যার সাথে আমার মোটেও আহামরি কোন সখ্যতা ছিলো না। কথা বার্তাও নিয়মিত হতো না। অবিবাহিত ওই নেতা একদিন ফেসবুকের ইনবক্সে জানতে চেয়েছেন আমার ‘সেক্স করতে ইচ্ছা করে কি না’। এছাড়া আরও কিছু মন্তব্য তিনি লিখে আমার কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে আমাকে ব্লক করেছেন। এ ঘটনা জানাজানি হবার পর তিনি প্রচার করলেন তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে। হ্যাক হতেই পারে। কিন্তু পরবর্তীতে আমাকে তার এড়িয়ে চলা আমার অবিশ্বাসকে মজবুত করেছে। বিষয়টি ভুলবুঝাবুঝি উল্লেখ করে তিনি এখন এর ওর কাছে দেন দরবার করে বেড়ান। কিন্তু আমি পারিনি। সেদিনও কাছের সিনিয়র কয়েকজনকে বিষয়টি জানানো এবং নিজে কষ্ট পাওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারিনি। আজও পারিনি। ঈশ্বর মেয়েদের অসীম ধৈর্য্য দিয়েছেন বলেই তারা এত ‘অনাকাঙ্খিত স্পর্শ’ পায়। ইট ছুড়লে ঘুরিয়ে পাটকেল দিতে যানে কত জন? যারা পারে তাদের প্রাপ্তির ঝুলিতে জমা হয় তীর্যক সব মন্তব্য। খারাপ মেয়ের ‘তকমা’। অথচ যারা সমাজকে কুলষিত করছে কদর্য মন্তব্য, স্পর্শ, কর্ম দিয়ে তারা থাকে মধ্য মনি হয়ে। যৌন নিপিড়ক হয়ে তারা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বক্তব্য দেন। বাবা-কাকার বয়সীর সুযোগ নিয়ে পিঠে-মাথায়-গালে হাত বুলিয়ে নিজের বাসনা পূরণ করে নেন অবলীলায়। আমরা সেই অনাকাঙ্খিত স্পর্শকে আদরের মোড়কে মুড়িয়ে রাখি। স্নেহ/ ভালবাসার উপাধি দেই।
লেখক পরিচিতি:
সেবিকা দেবনাথ, সাংবাদিক