আরিফুর রহমানের কবিতা

Comments

তোমার দরজায়

আরেকবার শূন্য হস্তে ফিরে এলাম তোমার দরজায়
—বেহিসেবি সন্ন্যাসী আমি ।
নগর-বন্দর-নদী-পাহাড় ঘুরে এসে
থিতু হলাম তোমার দরজায়
দরজা খুললেই পোষা বিড়ালের মতো
ঢুকে পড়ব তোমার ঘরে।

না, কোন ওম চাই না
কাশ্মীরি উলে বোনা তোমার গোলাপি চাদরের
মসৃণ ওম না হলেও চলবে।
তোমার শরীরের উষ্ণতার যতটুকু
পড়ে থাকে ঘরের আসবাবে, শেলফে, মখমল কার্পেটে
কিংবা জানালার শার্শির কাচে
—ততটুকু উষ্ণতা হলেই ঢের চলে যাবে আমার।

রুম টেম্পারেচারের চেয়ে দু ডিগ্রি কমবেশি হলেও কিছু এসে যায় না।

না, কিচ্ছু ছোঁব না আমি
কোথাও হাত দেব না।
তোমার রং তুলি, তোমার ইজেল,
ওল্ড হল্যান্ডের শুকিয়ে যাওয়া রঙ,
ইজেলে ঝোলানো শেষ না হওয়া দুঃখী মেয়েটা—
কিছুই ছোঁব না।

এখনও কি তোমার ইজেলে বসে ঝিমুচ্ছে
একহারা গড়নের দুঃখী মেয়েটা?
এখনও শেষ করোনি?
একটা দুঃখী মেয়েকে কতদিন এভাবে অপূর্ণ রেখে দেবে বলো?
বুকের আঁচলও শেষ করোনি?
লজ্জা পাচ্ছে মেয়েটা, দ্যাখো।
তুমি যে কি করো!
সবকিছু কেন এত অসম্পূর্ণ রেখে দাও?

কথা দিচ্ছি কাউকে জ্বালাবো না।
আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকা
টেডি নামের তোমার মিথ্যুক বিড়ালটা
ওকেও ভয় দেখাব না, প্রমিজ।
সত্যি বলতে কি আমিই বরং ওকে একটু ভয় পাই,
সেও কি আমাকে ভয় পায়?
হিংসে যে করে—সেটা বেশ বুঝি।
মিথ্যুক কেন বললাম?
কাছে ঘেঁষতেই এমন ভাবে তাকাবে
যেন অবিচল নিশানা করে
আর্টেমিস দাড়িয়ে আছে
এক্ষুণি ছুঁড়ে দেবে ভয়ানক তীর।
—কি অদ্ভুত!
আচ্ছা, আমি একটা বিড়ালকে মারতে যাব কেন?

অনেকক্ষণ হয়ে গেল, দরজা খুলছো না তুমি
ব্যাপার কি বলো তো?
অনেক বিরক্ত আমি।

ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে ঠিকঠাক চলে যাব
আর ফিরবো না।

ইদানীং কি হয়েছে জানো?
প্রতিবারই যখন মনে হয়
এই বুঝি তুমি এলে,
দরজা খুলে বলবে, কি খাবে? চা না কফি?
আমি বলব,  চা-ই দাও—চুমু তো আর দেবে না
ঠিক তখনই সাদা এপ্রোন পড়া এক নারী
তোমার দরজায় এসে দাঁড়ায়
একজোড়া রাগী চোখ (নাকি দুঃখভরা—কে জানে?)
আমার চোখে রেখে বলে, হা করুন।
ভয়ে ভয়ে মুখ খোলামাত্রই
একগাদা তেতো ওষুধ—কি বিশ্রী ব্যাপার!

কেন এমন হয় বলোতো?
তোমার দরজায় এসে বারবার ফিরে যেতে
আমার আর ভালো লাগে না
আমার আর ভালো লাগে না।

কিছুই শিখিনি আমি

কিছুই শিখিনি আমি—
এক জীবনে।

কীভাবে এক রত্তি বীজ থেকে ফলবান বৃক্ষ হয়
কীভাবে এক মুঠো রোদ্দুর শস্যের দানা পুষ্ট করে
কীভাবে ফুল ফোটে, ফল হয়—
কীভাবে জড়া-মৃত্যু কিংবা বার্ধক্য অজানিত দিক হতে আচমকাই হানা দেয়
মানব শরীরে—জানি না কিছুই।

বস্তুত সৃষ্টি কিংবা ধ্বংসের কিছুই জানি না আমি।

আমি জানি না
কীভাবে সংসারসমুদ্র থেকে স্নেহ-মায়া-ভালোবাসা পুঞ্জীভূত মেঘ হয়ে
অক্লেশে ঝরে পড়ে অজানা প্রান্তরে।
অনেক দিনের চেনাজানা কেউ কিভাবে পর হয়—এক নিমিষেই
জানা হয়নি আমার।

আমি জানি না
একটি মারণাস্ত্র কী করে বিদীর্ণ করে সুবৃহৎ জনপদ।
কিছুই জানি না আমি—
মানব-মানবীর প্রেম কিংবা বিরহের রূপ
আমি চিনি না।
আশৈশব মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখা রেলগাড়ি—কীভাবে চলে
বাতাসের অনেক ওপরে ওড়া হাওয়াই জাহাজের দূরবাতি—কীভাবে জ্বলে
—জানা হলো না কোনকিছুই।
এক জীবনে কিছুই জানতে পারিনি।

মানবের অমানবিকতার বহুরুপ
দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত,
আমার আর কিছুই দেখার সময় হয়নি,
আমার আর কিছুই শেখার সময় হয়নি।

একটি কিশোর

একটি কিশোর কেমন করে
নষ্ট হলো, ভ্রষ্ট হলো—কেউ দেখেনি
একটি কিশোর একলা হাটে, একলা চলে
কোথায় ঘুমায়, শীতের রাতে—কেউ দেখেনি

কেউ দেখেনি একটি কিশোর
ক্ষুধা নিয়ে ঘুমুতে যায়
কেউ দেয়নি দু’মুঠো ভাত
হাত রাখেনি ওর মাথায়।

বিষয়-আশয় সবই ছিল
রাক্ষুসে নদ সবই খেল
কেউ দেখেনি একটি কিশোর
কিভাবে তার ঘর হারালো, মা হারালো।

বাবাটি তার কোথায় গেল—কেউ জানে না
সেই যে গেল আর এলো না
একটি কিশোর একলা হাঁটে, খাবার খোঁজে
ক্ষুধার জ্বালায় পা চলে না।

মস্ত শহর, একলা কিশোর
কি খায়-পরে কেউ জানে না
একটি কিশোর পথ হারালো
কোথায় যাবে কেউ জানে না।

রাষ্ট্র নামের একটা কিছু
আছে যে সে তা জানে না
একটি কিশোর যাচ্ছে মরে
রাষ্ট্র যে তার খোঁজ রাখে না।

সবাই যাকে সমাজ বলে
বখে সে গেছে সেই যে কবে!
লোভ-লালসা, দুর্নীতি আর
প্রতারণায় গিয়েছে ডুবে।

একটি কিশোর নষ্ট হলো
খুনির দলে নাম লেখালো
ডুবে যাওয়া সমাজ বলে
—সবই গেল, সবই গেল।

রাষ্ট্র বলে—দুষ্ট এরা
রেখে এসো অনেক দূরে।
একটি কিশোর প্রশ্ন করে
রাষ্ট্র কী ভাই? খায় না পরে?

কবি তুমি চলে যাও

কবি তুমি চলে যাও
এসেছো যে পথে, সে পথে ফিরে যাও
এখানে তোমার ঠাঁই নেই আর
তুমি চলে যাও।
যে চেয়ারে বসে তুমি তুলতে শব্দের ঝড়
এখন সে চেয়ার অন্য কারও দখলে
ঝড়ের বদলে এখন সেখানে শান্তির সুবাতাস
বজ্রনিনাদের মতো প্রতিবাদী স্লোগান ঝরাতো যে কলম
তোমার সে কলম এখন অন্য কারও হাতে
প্রতিবাদী স্লোগানের বদলে সেখানে ঝরে সুরেলা স্তুতিবাক্য।
এখানে এখন আর দুঃখ নেই, কবি
তুমি চলে যাও—অন্য কোথাও।
ত্রাণের গাড়ির পাশে
মুখ ঢেকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবিত্ত—
ওখানে প্রতিবাদের কিছু নেই।
ফুটপাথের নোংরায় খাবার খুঁজে ফেরা
পথশিশুর দল
খাবার খুঁজবেই—হতাশার কিছু নেই।
কবি তুমি প্রতিবাদী,
প্রতিবাদের সময় এটা নয়
তুমি এখন বড্ড অপ্রাসংগিক
তোমার স্থান এটা নয়।
এখন সময় উপভোগের, কবি।
দ্যাখো
        কোথাও কোন দুঃখ নেই,
        কান্না নেই,
        হাহাকার নেই।
ক্ষুধার্তের হাতের শূন্য থালার যে শব্দ তুমি পাও
তা মূলত নর্তকীর নূপুর।
দ্যাখো, আলো ঝলমলে প্রাসাদ—
সিঙ্গেল মল্ট স্কচের সুবাস—এখানে সেখানে
সুখী মানুষের দল হেঁটে যায়
আরব্য রজনীর নর্তকীরা হেটে যায়, দ্যাখো।
এখন সময় সুখের, কবি।
বিপ্লবের, প্রতিবাদী স্লোগানের সময় এটা নয়।
এখানে তোমার ঠাঁই নেই, কবি
তুমি চলে যাও।

নাবিক

এক সমুদ্র হাহাকার বুকে নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছি জাহাজের পাটাতনে 
জলের মসৃণ শরীর বেয়ে চলে যন্ত্রদানব
পুরনো অনেক কথা পড়ে যায় মনে।

দলছুট ডলফিনের লুকোচুরি কিংবা 
রেলিংয়ে বসে থাকা আয়েসী সী-গাল
মনে করিয়ে দেয় যাপিত জীবনের কথা
কী ছিল চাওয়া? কতটা পেয়েছি নাগাল?

সুয়েজের সরু জলরাশি ধরে একটু এগিয়ে 
ভূমধ্য সাগরের নীল জলে পড়তেই মনে পড়ে 
ওইখানে—ওই দূর সাগরের পারে তুমি আছো,
অথচ জানি, এথেন্স এখনও বহু ক্রোশ দূরে।

মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার ঘরে
জ্বলে থাকা সন্ধ্যে-বাতি আমি চিনি। 
মনে হয় তোমার ড্রয়িং রুম কিংবা 
শোবার ঘরের দেয়ালে কী রঙ—আমি জানি।

শরতের আকাশের ঝলমলে তারার মতো
জ্বলে থাকে তোমার শহরের সব আলো
অযুত আলোর ভিড়ে তোমাকে খুঁজি,
বিষণ্ণ সন্ধ্যায় তুমিও কি সন্ধ্যেবাতি জ্বালো?

হেঁটেছি প্রবল বসন্তে এথেন্সের পথে পথে
দেখেছি পাখিদের ঘর বোনার আয়োজন।
লরেলের শুকনো পাতার মতো ঝরে গেছে
স্বপ্নগুলো। রয়ে গেছে বর্ণহীন একটা জীবন।

সাগর, বন্দর কিংবা সীমাহীন নীলাকাশ
— চাইনি কিছুই। চেয়েছি একটা জীবন
সাধারণ। রাতভর গল্প—তুমি আর আমি
— এর বেশি কিছু আর চাইনি তেমন। 

লেখক:
Arifur Rahman_02
আরিফুর রহমান, কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক ও তথ্য-প্রযুক্তি কুশলী

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট