নতুন লেখক। অত্যন্ত বলিষ্ঠ কলম। প্রেমেন্দ্র মিত্র আর সজনীকান্ত দাস বলেছিলেন ‘এ পুরুষের কলম’। কিন্তু সব জল্পনা ভুল প্রমাণ করে জানা গেল লেখক এক গৃহবধূ, নাম আশাপূর্ণা গুপ্ত।
১৯০৯ – ২০২০, একশো এগারো বছর পার করলেন আমার আপনার সবার প্রিয় আশাপূর্ণা দেবী। ৮ জানুয়ারী তাঁর জন্ম দিবস পার হলো। ১৯৯৫ এর ১৩ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তিনি প্রথম মহিলা হিসেবে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পান। অথচ অদ্ভুত কথা হল তিনি কোনোদিন স্কুলে পড়েননি। হ্যাঁ এটাই সত্যি। কারণ বাড়ির বারণ ছিল। তাঁর মা সরলাসুন্দরী দেবী কিন্তু স্কুলে পড়া বিদুষী ছিলেন। মা খুব চেষ্টা করেছিলেন তাঁর মেয়েরা স্কুলে পড়ুক। কিন্তু তাঁর শাশুড়ির অনমনীয় জেদের কাছে হার মেনে যান। আশাপূর্ণা দেবীর ঠাকুমা শেষমেশ মত দেননি। তিনি আজীবন আফসোস করেছেন স্কুলের মুখ দেখেননি বলে। এই গল্প শুনে মনে পড়ে যায় আশাপূর্ণার বিখ্যাত ট্রিলজি প্রথম প্রতিশ্রুতির কথা। যেখানে তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ঘরে বাইরে মেয়েদের কঠিন লড়াইয়ের ইতিহাস বলেন অত্যন্ত সহজ অন্তরঙ্গ ভাষাশৈলীতে।
মা সরলাসুন্দরীর ছিল শিক্ষা – দীক্ষা রুচি উদারতা। যা কিনা তিনি মেয়েকে দিয়ে গিয়েছিলেন । পিতা হরেন্দ্রনাথ গুপ্তর ছিল সংগীত ও চারুশিল্পে প্রতিভা। স্বামী কালিদাস গুপ্তের আজীবন সহৃদয়তা তাকে সাহিত্যের পথে সঙ্গ দিয়েছে।
আশাপূর্ণা দেবীর সাথে তাঁর বৌমা নূপুর গুপ্তর অদ্ভুত সুন্দর সম্পর্ক ছিল। প্রতিটি বইয়ের ভূমিকা লেখেন তাঁর বৌমা। তিনি ঘরোয়া আশাপূর্ণাকে তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। নূপুরদেবী বলেছেন – “আমি এত মানুষ দেখেছি, কিন্তু আমার শাশুড়ির মত সমস্ত সংকীর্ণতা ছাপিয়ে উঠতে আর একজনকেও দেখলাম না। মা টানা লিখতে পারতেন না , কেউ না কেউ দেখা করতে আসতো। যেমন একদিন পুরোনো ঝি এসেছে, মা কুড়ি টাকা দিলেন, খানিক গল্পসল্প করে বিদায় দিয়ে আবার লিখতে বসলেন এরকম। “প্রথাগত শিক্ষা ছিল না কোনো, তাহলে এত এত উপন্যাস, গল্পে এত মনোগ্রাহী সব চরিত্র তিনি আঁকলেন কি করে? কি করে লিখলেন, বিকেলে ভোরের ফুলের মতো সামাজিক সম্পর্কের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রবীণ দুই মানুষ মানুষীর কাছে আসার গল্প বা শুক্তি সাগরের কাহিনী, যেখানে নায়িকা সম্পর্কের নাম রাখে ‘ও কিছু নয়’।
নিজের সময়ের থেকে অনেক দূর এগিয়ে ছিলেন আশাপূর্ণা। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন “আমি মনের জানলা খোলা রেখেছিলাম যে’ ….. তাঁর প্রতিটি নারী চরিত্রই স্বতন্ত্র। স্বকীয়তায় উজ্জ্বল।
আগেই বলেছি মায়ের উৎসাহে পড়াশোনা। মায়ের উৎসাহেই ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা পাঠানো। আশাপূর্ণা দেবীর মতে সম্পাদকদের উৎসাহমূলক চিঠিগুলো ‘আরো পাঠাও, আরো লেখোই তাঁর আসল অনুপ্রেরণা। তাঁর তো তখন মাত্র তেরো বছর বয়স। তাই সম্পাদকদের তুমি করে সম্বোধন। শেষজীবনে ডিগ্রির আর পুরস্কারের অভাব হয়নি। সম্মানসূচক ডক্টরেট পেয়েছিলেন, জব্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৩), রবীন্দ্র – ভারতী (১৯৮৭), বর্ধমান (১৯৮৮), বিশ্বভারতী (দেশিকোত্তম ১৯৮৯) এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী স্বর্ণপদক পেলেন ১৯৯৩ সালে। বিখ্যাত উপন্যাস ট্রিলজি — প্রথম প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতা ও বকুলকথা। এর মধ্যে প্রথমটির জন্য তাঁর হাতে জ্ঞানপীঠ উঠে আসে। বাংলা ছাড়াও ইংরেজি ও আরো নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা বই, পেয়েছে বিপুল জনপ্রিয়তা।
লেখক পরিচিতি:
স্বাতী চক্রবর্তী, চলচ্চিত্র নির্মাতা