১
যেখানে নিষিদ্ধ হয়ে যাও তুমি
সেখান থেকে শুরু হয় গোপন-চরের রাত্রি
সেইখানে বেলা নাই
সবই অ-বেলা সবই রোজ রাইতে পাঁজরের বেদনার মতো সত্য।
যেখানে মরে যায় দেহ
সেইখান থেকেই হয়তো শুরু হয় ভালোবাসা
ঘৃণার দুনিয়া ছাড়বার পর দেহ,
জীবিতের বুকে ভর করে দেহহীনের তরে অনশ্বর প্রেম।
জীবনভর যে পুরুষ মিথ্যা বলে গেছে
মিথ্যা বলে চলে গেছে বেশ্যার ঘরে
আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়ায়ে মিথ্যা বলতে কেমন লাগে
স্বভাব-মিথ্যুকের, জানো তুমি!
সেইমতো জীবন আমাদের
নিজের সত্যভাষণ শোনা যায় ছাড়বার পরে
তোমারে সে ছাড়বার পরে
কিবা আমারে তুমি ছাড়বার পরে
হয়তো বা তুমি তারে ছাইড়া যাইবার পরে
তুমি আমি সে অ-দেহ সত্য লয়ে বড় আপন হয়ে কাছাকাছি আসি
আরো বেশি জীবন পেয়ে
মৃতের আত্মাগুলা জীবিত হয়ে উঠি
অনন্ত বেদনার ঘায়ে ঘায়ে আরো বেশি নিকটে আসি…

২
ভালোবাসতে পারি না
সিনার বাম দিকে ঘায়ের মতো লেপ্টে গেছে…
বান্ডলব্রাঞ্চ ব্লক, ঠিক তার উল্টাপাশে এখন ক্যান্সার।
সাপের মতো চলতে থাকা গাঁয়ের রাস্তার শেষে আমিও গেছিলাম
গাছ ও ছায়া মায়ায় ভরছিল
যদিও তোমার ঘরে রোদের তাপ খর
তুমি বলছিলা, সত্য-মিথ্যা জানি না।
বরষার বৃষ্টির দিনগুলা রাতের চাঁদগুলা
আসমানের নম্রতাগুলা তোমার না, আমার পায়ের কাছে ঝরে পড়ছে কতবার!
আর তা টোকাইতে টোকাইতে আমি
অনেক বেশি সম্পদশালী, বহু আগেই
তাই তোমারে জানি, আসমানের কাছে।
তোমার নির্ধনিয়ার গল্প যত বলছ
আমার একা ততই শক্তিশালী হইছে
তুমি যত শুন্য আমার দানবাক্স ততই চাবিহারা
তুমি যত মিথ্যার বাসনা সাজাইছ
আমার সিনা ততবারই চাক হইছে।
চারকোণা ঘরের সত্য কে জানতে চায়!
কত জানতে চায়!
সত্য কি এতই সহজ!
যে কালে তুমি নাই যে মনে তুমি নাই যে দেহে তোমার বাস নাই বাসনা নাই
সেইকালের সত্য তুমি কেমনে জানবা
যদি না লেখা হয়!!
একদিন ইস্রাফিলের শিঙ্গায় উঠবে মহা ওঙ্কার
আসমান ভাইঙ্গা পড়বে মাটির পায়ের তলায়
আর
আমি লেখব সেই ইতিহাস, সবুর কর
আপাতত মস্তক বন্ধক থাকুক….

৩
জোছনার ছবি আঁকে যারা
পিছনে চাঁদ চুরি হয়ে যায় তার আসমান থেকে…
রাত ভাঙা অন্ধকার পার হয়ে যায়
রূপসী মেকআপে
তারার বাতিওয়ালা ঘর-বিছানা-মানুষ-মানুষী পোশাক-আশাক
তবু
আন্ধারে নাই বাতি জ্বালবার তেল।
ঘরে মানুষী-মানুষ বাইরে আন-মানুষের গীতবাদ্য
সব আয়োজন যার নিজের তরে
তবু, ঘরে আর বাইরে সাড়ে তিনহাত অন্ধকার
ছড়ায়ে যায় ঠিক, বাতাসের কানে কানে…

৪
আব্বা মরে গেছেন, আম্মাও
এখন আমরা খুব কান্দি তাঁদের জন্য।
মাঝরাইতে আমি আম্মার কথা মনে কইরা একমনে কাইন্দা উঠলে
আমার মেয়েরা দৌড়াইয়া আসে।
আমাদের ভাইর বউরা আমাদের খুব ভালো কইরা জানায়ে দেয়,
তোমার ভাই আম্মার কথা মনে কইরা কবর জিয়ারত করে
কবরের দেখভাল করার জন্য লোক রাখছে
যদিও ভাবী আম্মার মরণের তারিখ ভুল করে।
প্রায় রাতেই আব্বার জন্য এইটা করতে পারিনাই
ওইটা করতে পারিনাই বইলা ডুকরে কাইন্দা ওঠে আমার বোন।
আর
আমি কেবল মনে করতে পারি
আব্বার শুক্কুরবারের দিনগুলা আমি আমরা ও তারা
কেমনে নষ্ট কইরা দিসি নিজেদের দুনিয়াদারীর উসিলায়!
বাড়ান্দার গ্রিল ধইরা দাঁড়ানো বয়সের ভারে নুইয়া পড়া আব্বার
পিছনে দাঁড়াইয়া আমি তা়র চোখের বিছানো রোশনাই ধইরা দেখতাম..সামনে..
রাস্তায় একজন বৃদ্ধতরের হাতে ধইরা জুম্মার নামাজে লইয়া যায় কেউ।
হঠাৎ পিছন ফিরা আব্বা আমারে দেইখা চোখের লোভ আড়াল করেন
আর
আমি ভাবতে বসি, মেয়েমানুষ ক্যান মসজিদে যাইতে পারে না!!
আর একজন মানুষ…
চুপ করে দেখেন
মাঝরাইতে নীরবে হাঁটেন
হঠাৎ ঘরে উঁকি দিয়া দেখেন…
আম্মার ঘরে আজরাইল আইসা গেছেন-আম্মা খাটে উথাল-পাথাল করেন
ফোনগুলান কেউ ধরে না কেউ ধরে না কেউ না! কারোটা বন্ধ!
তাদের মরণের পর তিনি হাউমাউ কইরা কাইন্দা উঠেন।
আমি তার কান্দনের শব্দ
আব্বার জুম্মা পড়নের লোভ
আর
আম্মার চোখে রং হারানো ছয়টা বাড়ির
হাড়গোড়ের ছাই গোপনে বুকের নিরাকে চাপা দিয়া রাখি…

৫
খুব দূরে যাই না
কাছ থেকে জানি রীতি
পূবে নর পশ্চিমে নারী
উত্তরে সহধর্মীনি দক্ষিণে ঊর্বশী।
কবিতা লেখার ছল করে কাটে পহর পহর বেলা
অজানা প্রেমের কাঙাল জাগায় আধা রাত ভোরবেলা…
বলি, যাও কাজ কর কথা বল ছুঁয়ো না সরু তার আঙুলগুলা
অথচ সায় পেয়ে তুমি ঢুকে যাও ঘর, বাড়ির উঠান বৈঠকখানা
পার কর সকাল দুপুর সাঝ রাত পহর
অথচ
বিছান বিছানো ঘর তোমার।
আমার পূবে নর পশ্চিমে নর
উত্তর দক্ষিণে দুই শিশু
বাঁধি না তবু ঘর, জানলায় ঢুকে পড়ে রোশনাই
তাই খুঁজি না চান্দের মুখ।
আর
দীর্ঘ মানুষ আমি প্রসিদ্ধ ছায়া ফেলি
অতঃপর… সামনে থেকে চলে যাই দূর…

লেখক:
আসমা সুলতানা শাপলা, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক