আ হিউউউউজ সিক্স! (গল্প)

Comments

।। ইমাম মুত্তাকিন ।।

শ্যামাপুর বিদ্যুৎ উন্নয়ন কেন্দ্রের কোয়ার্টার এটা । পড়ন্ত বিকেল । বিশাল মাঠ । মাঠে বিভিন্ন রকমের খেলা চলছে । মাঠের চারপাশে বেশ প্রশস্ত রাস্তা , একটু বয়স্কে রা সেখানে হাটাহাটি করছেন । মাঠের পাশ জুড়ে বেঞ্চে আলোচনার ঝড় । আর ফ্লাস্ক হাতে চা , বাদাম ওয়ালা কিংবা পিয়াজু বিক্রেতা এই আলোচনা আরো জমিয়ে তুলছে । এক কথায় একটা শান্তিময় পরিবেশ ।
তিথির তানপুরার মাস্টার মাত্র গেল । গেল ঠিক না , তিথি মুখ কাচুমাচু করে মাস্টার কে তাড়ালেন । মাস্টার ছাত্রি কে না ঘাটিয়ে বের হয়ে আসলেন । তিথি ভাল ছাত্রি , কি তানপুরায় ,আর কি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হাইস্কুলে ।
চশমা লাগিয়ে বারান্দায় মায়ের গা ঘেসে দাড়াল সে । মাঠে তিথির ভাই ফাইজ ক্রিকেট খেলছে । ব্যাট করছে ও । ফাইজ অলরাউন্ডার । স্পিন আ্যটাকে সে যেমন এগিয়ে , তেমনি কাভার ড্রাইভ , পুল আর চিকি শট খেলতে ওস্তাদ । ফাইজ মা আর বোনের দিকে তাকিয়ে একটা উচু করে ছয় মারল । মা আয়েশা আক্তার হাত তালি দিলেন । তিথিও খুশি । আজকাল তিথি বেশি বাইরে যায় না । সে আর খুকি নেয় , সে এখন পূর্নবতি কিশোরী । মা-ই তার সবচেয়ে আপন বন্ধু । আয়েশা অক্তার মেয়ের চুল গুলো এলিয়ে দিচ্ছেন আর কথা বলছেন । -কিরে আজ মাস্টার কে তাড়াতাড়ি ছাড়লি যে ? শরীর খারাপ ? -না মা ! ভাল লাগছিল না । -কি জানি বাপু , কিছু বুঝি না । -কিছু হয় নি মা । তুমি আমাকে বেনী করে দাও । আয়েশা আক্তার বেনী করা শুরু করলেন । মেয়ে বড় হচ্ছে , তাকে বোঝা এখন কঠিন হবেই এটাই স্বাভাবিক । মেয়েরা বড় হয় আর কঠিন হয় তাদের বুঝে ওঠা ।
তিথি তানপুরা ছেড়ে উঠে আসার কারন টা.. মাঠের উইকেট কিপার । ছেলেটা ওদের ক্লাসেই পড়ে । উইকেটের পেছনে ছেলেটা নানারকম চিত্‍কার করতেই থাকে , করতেই থাকে । পাচ ফুট সাড়ে ছয়ের ছেলেটা লাফ ঝাপে মাঠের শিরোমনি । রনি , ছেলেটার নাম রনি । ব্যাপারটা কেউ বোঝে কি না কে জানে ? রনি উইকেটের পেছনে যত চিত্‍কার করে , আর তিথি তানপুরার চিত্‍কার থামিয়ে বারান্দায় আসে । রনি দূর থেকে হয়ত তিথিকে দেখতে পায় । তখন সে আরো জোরে চিত্‍কার দিতে শুরু করে । মাথার ক্যাপ খুলে , বারবার চুল ঠিক কর । কেন করে ! কার জন্য করে ব্যপারটা আষাঢ়ের আকাশের মত ঘোলাটে । ঘেমে নেয়ে বাড়ি ফিরেছে ফাইজ । সাতাশ রান আর দুটো উইকেট নিয়েছে সে । ম্যাচ ও তাদের দখলে । বা হাত দিয়ে ডান হাতে কিল দিতে দিতে ফাইজ বলল , রনি ভাই কে আমি আউট না করলে নির্ঘাত ম্যাচটা হারতাম । একটা চঞ্চলতা নিয়ে প্রশ্ন করে তিথি , ক্যান কত রান করছে ও ? -আর বলিস না আপু . রনি ভাইয়ের হাতে যা স্ট্রোক ! ১৬ বলে ৪০ করছে । -তাও জিততে পারে নাই ? – নাহ্ ! বাকিরা ভাল খেলতে পারে নি । তিথির মন খারাপ হল কিনা , বোঝা গেল না । তবে এটুকু ঠিক ক্লাসে পাঁচ রোল আর হাতের স্ট্রোক মেইনটেইন করাতে সে বেশ খুশি ।
পাতলা পাতলা গোঁফ নিয়ে আস্তে আস্তে পুরুষ হয়ে ওঠার দিকে এগুচ্ছে রনি । নচিকেতা আর অঞ্জন দত্তের গানে গানে একটু একটু করে রোমান্স বেড়ে উঠছে । লেখার খাতা এদিক সেদিক কারোর প্রভাব স্পষ্ট বোঝা যায় । থার্টি টু -থার্টি ফোরের বুকের মাঝে যে কাও কে নিয়ে স্বপ্নের কারখানা চলছে , তা ক্রিকেট মাঠের চিৎকারেই বোঝা যায় ।
ক্লাস নাইনে ছেলে মেয়েদের কম্বাইন্ড ক্লাস ছিল না । ক্লাস টেনে শুরু হয়েছে । এক ক্লাস হয়েও তাই রনি আর তিথির আলাপ চোখেই । মুখের আলাপে কি একটা সংকোচ আছে । মনের গহিনে এই সংকোচ জয়ের বিদ্রোহ চলে হয়ত দুজনের । বন্ধু মহলের সদস্যেরা সে বিদ্রোহের আগুনে ঘি ঢাললেও তা যথেষ্ট বোধ হয় না । সারারাত ভেবে রাখা কথা গুলো কর্পূরের মত উবে যায় , লজ্জার রক্তিম আভা ফেলে যায় মুখে । এ আর অবাকের বিষয় কি ? এই দুর্গম পথের আহবান ছাড়তে পেরেছে কে ?
ক্লাসে নোটিশ এসেছে । কাল শুক্রবার ক্লাস এইট আর ক্লাস টেনের ক্রিকেট ম্যাচ । ক্লাস এইট আর টেনের ছেলেরা স্পোর্টস্ স্যার কে নিয়ে ক্লাসে ক্লাসে এই নোটিশ দিয়ে বেড়াচ্ছে । রনি ক্নাসে এসে যখন এই কথা গুলো বলছিল , বান্ধবিদের গুতাগুতিতে তিথি যতটা বিব্রত তার চেয়ে বেশি বিব্রত সে তার অনুজ কে নিয়ে । ফাইজ ক্লাস এইটের ক্যাপ্টেন .. হারলে যে তিথিকে তার ভাইকে প্রোবোধ দেওয়ার মত কিছুই থাকবেনা । আর তার মনের বলটা যে কিপারে তালু বন্দি তার হারই বা কিভাবে চাই সে ?
এত সব টেনশনেই শুক্রবার আসল । ভাইকে উত্‍সাহের শেষ রইল না তিথির , আর শঙ্কার গ্লাস ও উপচে উঠল উইকেট কিপার কে নিয়ে । বাবা-মা কে সাথে নিয়ে মাঠে গেছে ফাইজ । তিথি যায় নি । মাঠ জুড়ে খালি একজন কে দেখার জন্যে যাওয়া চলে না । কেউ ব্যপারটা বুঝলে লজ্জার সীমা থাকবে না ।
ক্লাস এইট ব্যাট করছে । বিশ ওভারের খেলা । ওপেনার জুটিতে চল্লিশের উপরে রান । মাঠে ক্নাস টেনের ক্যাপ্টেন রনি বেশ চিন্তিত । কিপিং করছে বোলার চেঞ্জ করছে , কাজটা বেশ কঠিন । তার উপর দূরে বারান্দায় যার সামনে খেলা চলছে ,সেটাও একটা চাপ । সময়ে সময়ে স্কোর বোর্ডে উইকেট আর রানে অংক বাড়তে বাড়তে ক্রিজে আসল ফাইজ । মাঝে মাঝে শট আর ডিফেন্সে ভালই খেলছে ফাইজ । কি একটা টানে ফাইজের উপর কনসেন্ট্রেট করতে পারছে না রনি । ফাইজ ও এগুচ্ছে বেশ । তার চল্লিশ রানের সুবাদে যখন এইটের স্কোর একশ পয়ত্রিশ । তখন সংকোচ বাদ দিয়ে রনি বোলার কে তকমা দিয়ে আসল । তিন বল পর দূর্দান্ত একটা ক্যাচে রনি বিদায় জানাল তার সংকোচ আর সাথে ফাইজ কে । তিথি এই সময়টা উদ্বিগ্নতায় পার করেছে । কি এক দোটানা কাজ করছে তার মাঝে । ব্যাপারটা পুষে রাখা কষ্ট । মাঠে না গিয়ে খারাপ করে নি সে । বারান্দা থেকে ফাইজের ঘর্মাক্ত আর হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে সে বেশ উত্‍ফুল্ল ।
ফাইজের পর বেশিদূর এগুলো না ইনিংস । একশ পচাত্তুরে দারুন এক টার্গেট । ক্লাস টেন ব্যাটে নেমেছে । এরাও কম যায় না । জুনিয়রদের কাছে তো আর হারা যায় না ! চারে ছয়ে ওরাও ভালই এগুচ্ছে । কোন বোলার যখন উইকেট নিতে কামিয়াব হচ্ছিল না , বল হাতে পেয়ে দারুন টার্ন এনে চমত্‍কার ব্রেক থ্রু আনল ফাইজ । ফাইজের ঘূর্নিতে তিন জন নাকানি চুবানি খেয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরল । স্ট্রাইক গেল রনির হাতে । ওয়ার্ম আপের উছিলায় একজনকে দেখাও হল । একটু শক্তিও পাওয়া হল সে সুযোগে । রনি বিপর্যয় সামাল দিয়ে ভালই এগুচ্ছে । মাঠে বেশ উত্তেজনা । জম জমাট ম্যাচটা শেষ হবে শেষ ওভারে পনের রানে । ক্লাস টেনের হাতে তিনটা উইকেট । কান্ডারি হয়ে টিকে আছে রনি । শেষ ওভারে বল করতে আসছে ফাইজ । ফাইজ অলরেডি তিন উইকেট পেয়েছে । ওর বলে যে টার্ন করতেছে তাতে , পনের রান করা সহজ না ।
ম্যাচটা যেন শেষ ওভারে এসে বেশিই নাটকিয়তা পাচ্ছে । তিথি শেষ পর্যন্ত নেমেই আসল । এত প্যানিক সে ধরে রাখতে পারছে না ।ফাইজ ছাড়া কি কেউ বল করতে পারত না ? এক অনাহূত টেনশনে মাথা ঝিমঝিম করছে তার । লাস্ট ওভার প্রথম বল , রনি স্ট্রাইকে জোরাল শট , তবুও এক রানের বেশি হল না । টাইট ফিল্ডিং । স্ট্রাইক যে ভয়ে ছাড়তে চাই ছিল না সেটাই হল । পরপর দুই বলে আরো দুই উইকেট থলিতে পুরল ফাইজ । তিথির মুখটা এই উত্তেজনায় কেউ দেখেনি । ঐ মুখটা আনন্দ আর টেনশনের এমন আল্পনা সচারচর দেখা যায় না । তিন বলে দরকার চৌদ্দ রান , স্ট্রাইকে রনি । চারিদিকে চোখ মেলে দেখল সে । না ! সময়টা রোমান্সের না । ফাইজের হ্যাট্রিক বল । ফাইজের জয়ধ্বনি ভেস্তে গেল বিশাল ছয়ে । এখনও ম্যাচে টিকে থাকল ক্লাস টেন । দুই বলে বাকি আরো আট রান । সারা মাঠে যতটা টেনশন তার থেকেও বেশি টেনশন তিথির । বুকটা কেপে যাচ্ছে তার । পরের বল টা ফ্লিডিং মিসের কারনে চার হল । ফাইজ তো রেগেই আগুন । ম্যাচটা আবার না ফস্কে যায় । লাস্ট বল ! চোখ বুজে রেখেছে তিথি । না হলে সে বুঝি মরেই যাবে । বলটা উইকেটের বাইরে থেকে চমত্‍কার টার্ন করল । রনি এক পা পিছিয়ে রুম নিয়ে সজোরে ব্যাট চালাল । এবং ছয় …!!!
ফাইজ কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলছে । ম্যাচ সেরা সে হয়েও , ম্যাচটা জেতাতে পারেনি সে । সবাই খুব বাহবা দিলেও মনে ধরল না ফাইজের । মুখ ফুলিয়ে বসে আছে সে । এখন সন্ধ্যা । কলিংবেল বাজছে তিথিদের বাসার । রনি এসেছে । আর ওর মা । দরজা খুলে দিতেই ধাক্কার মত খেয়েছে দুজনেই । রনি এসেছে ফাইজ কে ঠান্ডা করতে , কি অকালেই যে ফাইজ লাস্ট ওভারে বলে এসেছিল । ফাইজ বলে না আসলে হয়ত এখানে আসতে হত না । রনি ফাইজকে ঠান্ডা করতে পেরেছ । তিথি দেওয়ালের ওপাশ থেকে শুনেছে । চিত্‍কার আর এই ঠান্ডা গলার কিপারের দুই কন্ঠের ভাষা অনেক মিষ্টি । কিভাবে এত মিষ্টি করে কথা বলতে হয় খুব কাছ থেকে দেখার ইচ্ছা হচ্ছিল তিথির । কংক্রিটের দেয়ালের বাধা পেরুতে কষ্ট নেই , কষ্ট লাজুকতার বাধা পেরুতে ।
শনিবার । রনি ক্লাস রুমের গেটের সামনে পায়চারি করছে । ভয়ংকর টার্নে বল যদি সে ছয়ে উড়িয়ে দিতে পারে তাহলে , তিথি কে আলাপের ছকে আনতে সমস্যা কোথায় ? তিথি দুর থেকে দেখেই বুঝতে পেরেছে রনি আরেকটা ছয়ের অপেক্ষায় । তিথির হাসি পাচ্ছে , হাসি সে গিলতে পারছে না । ফ্রন্ট ফুটে এসে ছয় মারার মত করে , রনি এগিয়ে আসল । তিথি ডিফেন্স করতে গিয়ে এল . বি . ডাব্লিউ ……

 

ইমাম মুত্তাকিন

ইমাম মুত্তাকিন

 

লেখক:

ইমাম মুত্তাকিন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ার, ডেকো গ্রুপ।

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.