ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দিন ২৩ সেপ্টেম্বর নয় ২৪ সেপ্টেম্বর

Comments

।। বিশেষ প্রতিবেদন ।।

বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে ১৯৩০ সালে স্বাধীনতার অভ্যূদয় ঘটেছিলো মাষ্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে। মুক্তিকামী মুষ্টিমেয় তরুণই সেদিনের অগ্নিগর্ভ ইতিহাসের স্রষ্টা। সেই সে সাহসে প্রদীপ্ত সংগ্রামসংক্ষুব্ধ চট্টগ্রাম মুক্ত করার রক্তক্ষয়ী দিনপঞ্জীর ১৮ থেকে ২২ এপ্রিল ছিল এক মহতী শিক্ষার উজ্জ্বল দিন। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অদম্য প্রেরণা এবং দৃপ্ত প্রত্যয়ের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। যুব বিদ্রোহের অগ্নিস্ফূলিঙ্গ। সে স্ফূলিঙ্গ আগুনের গোলা হয়ে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল।

বৃটিশ বেণিয়াদের লুঠতরাজের আমলে, শোষকশ্রেণীর স্পর্ধিত দিনরাত্রিকে দেশমাতৃকার এই কতিপয় অমিততেজ সন্তান যে অকুতোভয় লড়াইয়ের সূচনা ক’রে সেদিন বিদেশী সাম্রাজ্যলোভী পরাশক্তিকে ভীতসন্ত্রস্ত্র করে তুলেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার জালিয়ানওয়ালাবাগ -এর নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নিতে আক্রমণ করেছিলেন চট্টগ্রাম শহরের “ইউরোপিয়ান ক্লাব”। সে ছিল ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। ক্লাবের একজন মুসলিম বাবুর্চির সাহায্যে ক্লাবের বিভিন্ন তথ্য জেনে নিয়ে তাঁরই টর্চের আলোর তিনবার সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রীতিলতা ‘চার্জ’ বলে নির্দেশ দিয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে গেলেন। রাত প্রায় ১০:৪৫ মিনিটের (সাক্ষীদের সাক্ষ্যমতে) সময় আক্রমণ চালালেন সাত সহযোদ্ধা ভাই শান্তি চক্রবর্তী, কালী দে, প্রফুল্ল দাস, সুশীল দে, মহেন্দ্র চৌধুরী, বীরেশ্বর রায়, পান্না সেন এর একমাত্র “চম্পা” বোন অপারেশনের অধিনায়ক ‘অসম সাহসীকা’ বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

সফল আক্রমণে ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হলো। শ্মশানে পরিণত হল ক্লাবঘর। অভিযান শেষে ফিরবার পথে লুকিয়ে থাকা ইংরেজের গুলিতে আহত হলেন প্রীতিলতা। প্রীতিলতা মৃত্যু নিশ্চিত আরো দ্রুত সেটা করবার জন্য তিনি নিজেই নিজের পকেট থেকে পটাশিয়াম সায়ানাইডের মোড়ক খুলে খেয়ে ফেললেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম বিপ্লবী নারী-শহীদের দেহ চট্টগ্রামের রাস্তায় পড়ে রইলো ।

দেশমাতৃকার মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গিকৃত সেই আত্মত্যাগ বছরের পর বছর ধরে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে, আজও করছে। যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।

তারিখটি নিয়ে দ্বিমত দেখা যায় বিভিন্ন জনের লেখাতেই। কেউ বলেন “২৩ সেপ্টেম্বর” কেউ বলেন “২৪ সেপ্টেম্বর”। ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের তারিখ “২৪ সেপ্টেম্বর” সঠিক বলেই লক্ষণীয়। কারণ পুরনো নথি ও বাংলার বিভিন্ন লেখকের লেখাতে ব্যবহৃত আক্রমণের দিন “২৩ সেপ্টেম্বর” বিধৃত হলেও, মূলত দুটি কারণে এই তারিখ সঠিক নয় বলে প্রতীয়মান হয়:

১) সম্রাট বনাম সূর্যসেন মামলার বাদী পক্ষের ৩০ নং সাক্ষী ইন্সপেক্টর ম্যাকডোনাল্ড তার সাক্ষ্যে ঘটনার তারিখ উল্লেখ করেছেন “২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩২”। এটি অধিক গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে তার কারণ একজন ইংরেজ ইংরেজী তারিখ ভুল বলবার কথা নয় যেখানে সে সময়ে বাঙালীর মাঝে বাংলা তারিখের চল ছিল বেশী।

২) ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় ক্লাবে বিশেষ তাস খেলার আয়োজন ছিল। সেদিনটি ছিল শনিবার। পাশ্চাত্যে “Saturday Night” সাপ্তাহিক আনন্দ উৎসবের দিন হিসেবেই পালন করা হতো, এখনও হয়।

তাই সর্বোচ্চ ক্ষয়ক্ষতির প্রয়োজনে “২৪ সেপ্টেম্বর” শনিবারকে আক্রমণের দিন হিসেবে বেছে নেয়াই যৌক্তিক বলে মনে হয়।

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, অনেকে মনে করেন ২৩ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ হয়েছিল রাত দশটার পরে এবং অপারেশন শেষ করতে মধ্যরাত পেরিয়ে গিয়েছিল তাই প্রীতিলতা মৃত্যুবরণ করেন মধ্যরাতের পরে। সে কারণে তাঁর মৃত্যু দিন ২৪ সেপ্টেম্বর। এই যুক্তির গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যায় না কারণ ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ ছিল ঝটিকা আক্রমণ, কয়েকজনের সাক্ষ্য থেকেই জানা যায় ঘটনা ঘটার সময় রাত ১০:৪৫ এর কাছাকাছি সময়। তাহলে গেরিলা কায়দায় তড়িৎ ঘটেছিল বলে সেখানে অন্তত দেড় ঘন্টা সময় নেবার প্রয়োজন পড়ে না আর পটাশিয়াম সায়ানাইডের বিষক্রিয়া তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটায় বলে প্রীতিলতার মৃত্যুও সাথে সাথে ঘটেছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। পুলিশের ভাষ্য অনুসারে তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল ১১:৩০ এর দিকে এবং তারা সেখানে মৃত প্রীতিলতা ক্লাব থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে পড়ে থাকতে খুঁজে পায়।

বাংলাদেশের বেশ ক’টি সংগঠন প্রীতিলতা আত্মাহুতি দিবস পালন করেন ২৩ তারিখে। এছাড়া প্রীতিলতার স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলোতে যে ২/১টি ফলক লাগানো রয়েছে তাতেও ভুল তারিখটিই লেখা হয়েছে।

মাত্র সেদিনের অর্থাৎ ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের এমন একটা ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল দিনকে যদি ভুল করে বসি তবে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে আমাদের।

তাই আসুন সকলে আমাদের উদযাপনের তারিখ সঠিক ইতিহাসের সঠিক দিন অনুসন্ধানে শুদ্ধতার প্রয়াস নিই। দেশপ্রেমের মহিমায় দেদীপ্যমান দিন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের শহীদ হবার দিন, আত্মত্যাগে বলিয়ান বাংলার এক বীর নারীর বিজয়ের দিন, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বর্ণোজ্জ্বল দিন, হিসেবে “২৪ সেপ্টেম্বর” পালন করি। প্রেরণার মুক্তিফলক হয়ে ভাস্বর হোক আমাদের ইতিহাসে এইদিন।

লেখক: সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.