ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা

Comments

২৫ মার্চ, ১৯৭১

সারাদিন

মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা পণ্ড হয়ে গেছে সে খবর ছড়িয়ে পড়ল সারাদেশে।

হাজার হাজার মানুষ শেখ মুজিবের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনের সামনে অপেক্ষমান পরবর্তি নির্দেশের।

সকালে রমনা প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো ও তার উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা শেষে ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, সমাধান ক্রমেই অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে।

সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মত। ঢাকার ইপিআর সদর দফতর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্নস্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়।

হেলিকপ্টারযোগে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল ইফতিখার জানজুয়া, মেজর জেনারেল এ ও মিঠঠা, মেজর জেনারেল খুদাদাদ খান, কর্নেল সাদউল্লাহ খান প্রমুখ রংপুর, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ঝটিকা সফর করে ও ব্রিগেড কমান্ডারদের সাথে মন্ত্রণা সভায় মিলিত হয়। তারা সেনানিবাস পরিদর্শন শেষে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসে।

দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে।

সন্ধ্যা

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বৈঠক করেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে।

সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে মন্ত্রণা সভায় সর্বশেষ নির্দেশনা দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া কোন রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই রাত পৌঁনে আটটায় গোপনে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিমানবন্দর ত্যাগ করেন।

রাত

ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে যায় শেখ মুজিবের কাছে। রাত ৯ টার দিকে শেখ মুজিব তাঁর বাসভবনে উপস্থিত দলীয় নেতা, কর্মী, সমর্থক, ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট অখন্ড পাকিস্তানের সমাপ্তি টানতে চলেছেন।

দাবানলের মতো ঘরে ঘরে খবর পৌঁছে যায় যে ইয়াহিয়া ‘ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তান পালিয়ে গেছে’। মুহুর্তে মানুষ বুঝে ফেলে কিছু একটা ঘটবে এ রাতেই। তাই রাতেই পথে নেমে আসে ছাত্র-জনতা এবং পথে পথে গড়ে তোলে অসংখ্য ব্যারিকেড।

পাকিস্তানী বর্বর হানাদার বাহিনী বাঙালীর কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে পূর্ব পরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়ন করতে ”বেলুচিস্তানের কসাই ” নামে খ্যাত জেনারেল টিক্কা খান কে দায়িত্ব দেয়া হয়।

গণহত্যার প্রস্তুতি

৫৭ ব্রিগেডের ১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে ঢাকা সেনানিবাসের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ঢাকা সেনানিবাসে রিজার্ভ হিসেবে মোতায়েন করা হয়।

৪৩ হালকা বিমানবিধ্বংসী রেজিমেন্টকে ঢাকা বিমানবন্দরে মোতায়েন করা হয়।

২২ বেলুচ রেজিমেন্টকে আগে থেকেই পিলখানাস্থ ইপিআর সদর দফতরে অবস্থান করছিল।

৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রমণে দাতিত্ব দেয়া হয়।

১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে পুরান ঢাকা আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়।

ফিল্ড রেজিমেন্টকে শেরেবাংলা নগর, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় বসবাসরত বিহারীদের রক্ষার জন্য মোতায়েন করা হয়।

১৮ পাঞ্জাবের এক কোম্পানি, ২২ বেলুচের এক কোম্পানি ও ৩২ পাঞ্জাবের এক কোম্পানি সমন্বয়ে গঠিত বাহিনীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

মেজর জেড এ খানের নেতৃত্বাধীন এক কোম্পানি কমান্ডোকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি আক্রমণ ও তাঁকে আটক করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এক স্কোয়াড্রন এম-২৪ ট্যাংক প্রস্তুত ও শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থানের নির্দেশ দেওয়া হয়।

২৫ মার্চ দিবাগত অর্থাৎ ২৬ মার্চ মধ্যরাত ১টায় আক্রমণের সিদ্ধান্ত পাল্টে ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টায় আক্রমণের সময় নির্ধারণ করা হয়।

সে অনুসারে রাত ১০টার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর একটি বড় কনভয় যুদ্ধ সাজে শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

প্রতিরোধ

শহরমুখী সেনাবাহিনীর মেকানিক্যাল কলামটি প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ঢাকার ফার্মগেটে। এখানে বড় বড় গাছের গুঁড়ি, অকেজো স্টিম রোলার এবং ভাঙা গাড়ির স্তূপ জমিয়ে রাখা হয়েছিল পথটি আটকানোর জন্য। সেই সঙ্গে মুক্তিকামী বেপরোয়া প্রতিরোধোন্মুখ জনতার মাঝ থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ওঠে। গুলি করে এ প্রতিরোধ ভেঙে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ট্যাংকগুলো সামনে এগিয়ে যায়।

রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ রেসকোর্স ময়দানের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সেনাবাহিনীর অন্তত ৭০/৮০ টি সাঁজোয়া যান পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

রাত ১১টা ২০ মিনিটের মধ্যেই সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানসমূহ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের চারিদিকে অবস্থান নিতে শুরু করে।

পাকবাহিনীর এ আক্রমণের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশের জেলা ও সাব ডিভিশনসমুহে পুলিশ বেতার মারফত “Base for all station of east Pakistan police, keep listening, watch, we are already attacked by the pak army. Try to save yourself, over” বার্তা পাঠিয়ে দেয়া হয়।

রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যদের সতর্ক করতে তৎকালীন আইজিপির দেহরক্ষী কনস্টেবল আব্দুল আলী অস্ত্রাগারের পাগলা ঘন্টা বাজিয়ে সবাইকে একত্রিত করেন। অস্ত্রাগারে কর্তব্যরত সেন্ট্রিরা রাইফেলের গুলিতে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে নিজেদের মধ্যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিতরণ করে। পুলিশ সদস্যরা পুলিশ লাইন্সের চারিদিকে, ব্যারাক ও বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নেয়।

রাত ১১টা ৪০ মিনিটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল তাজের নেতৃত্বে পাক সেনাদের কনভয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের মেইন গেটে এসে পৌঁছোয়।

রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের দক্ষিণ–পূর্ব দিক (পুলিশ হাসপাতাল কোয়ার্টার সংলগ্ন) থেকে প্রথম গুলিবর্ষণ করা হয়। প্রায় সাথে সাথেই প্যারেড গ্রাউণ্ডের উত্তর –পূর্ব দিক (শাহজাহানপুর ক্রসিং) থেকেও গুলিবর্ষণ করা হয়। ব্যারাকের ভেতরে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা হামলা প্রতিরোধে পাকসেনাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে।

একই সময়ে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর পরিকল্পনানুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর  ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পিলখানায় ইপিআর-এ হামলা করে। পিলখানায় অবস্থিত বাঙালী সৈন্যরা সব সীমাবদ্ধতার মধ্যেই প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। বাঙালী সৈন্য ও পাকিস্তানী বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হয়।

গণহত্যা

পিলখানা ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণের সাথে সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, চানখাঁর পুল, শাঁখারি বাজার, তাঁতি বাজারসহ সমগ্র ঢাকাতেই শুরু হয় প্রচন্ড আক্রমণ।

বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নির্বিচারে ঘুমন্ত মানুষ হত্যার উৎসবে মেতে ওঠে।

পথ-ঘাট, বস্তি-ঘরবাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করতে থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আক্রমণ করে। বর্বর বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের আঘাতে বিধ্বস্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন। পাকিস্তানী হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। আহত হন অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা (পরে মারা যান) সহ হাজারো মানুষ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় আঘাত। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। হত্যাযজ্ঞ চলে ইকবাল হলে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিণত হয় ভুতুরে এলাকায়।

সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময়।

শুরু হয় বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম বর্বর, বীভৎস ও স্বল্পসময়ে বৃহত্তম গণহত্যা।

বাঙালীয়ানা/এসএল

উত্তাল মার্চের আর সব দিনগুলো:
বাংলায় পড়ুন –

১ মার্চ ১৯৭১ ২ মার্চ ১৯৭১ ৩ মার্চ ১৯৭১ ৪ মার্চ, ১৯৭১ ৫ মার্চ, ১৯৭১
৬ মার্চ, ১৯৭১ ৭ মার্চ, ১৯৭১ ৮ মার্চ, ১৯৭১ ৯ মার্চ, ১৯৭১ ১০ মার্চ, ১৯৭১
১১ মার্চ, ১৯৭১ ১২ মার্চ, ১৯৭১ ১৩ মার্চ, ১৯৭১ ১৪ মার্চ, ১৯৭১ ১৫ মার্চ, ১৯৭১
১৬ মার্চ, ১৯৭১ ১৭ মার্চ, ১৯৭১ ১৮ মার্চ, ১৯৭১ ১৯ মার্চ, ১৯৭১ ২০ মার্চ, ১৯৭১
২১ মার্চ, ১৯৭১ ২২ মার্চ, ১৯৭১ ২৩ মার্চ, ১৯৭১ ২৪ মার্চ, ১৯৭১ ২৫ মার্চ, ১৯৭১
২৬ মার্চ, ১৯৭১ ২৭ মার্চ, ১৯৭১ ২৮ মার্চ, ১৯৭১ ২৯ মার্চ, ১৯৭১ ৩০ মার্চ, ১৯৭১
৩১ মার্চ, ১৯৭১

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.