১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে যে চার কোটি বাঙালী জনসংখ্যা ছিল, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন তারমধ্যে একজনই মনুষ্যপদবাচ্য – তাঁর নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যার জন্ম ওই সালেরই ২৬ সেপ্টেম্বর। ১৮২০ সাল তাই বাঙালীর আত্মপরিচয় গঠনের ইতিহাসে অবিস্মরণীয়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হলেন মধ্যযুগীয় সমস্ত প্রকার গোঁড়ামি, কুসংস্কার থেকে মুক্ত এক বিরল ব্যক্তিত্ব। তত্কালীন সমাজ ও সংস্কার থেকে স্রোতের বিপরীতে চলা এক বলিষ্ঠ চরিত্র যা তাঁর জন্মের ২০০ বছর পরেও বিস্ময়কর। আসলে বিদ্যাসাগরের মতো মনীষীদের চর্চা বাংলাদেশে একেবারেই হয়নি। কিছুটা পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে তাও অপ্রতুল।
এর ফল তো আমরা পাচ্ছি। নবপ্রজন্মের ক’জন চেনেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে? গুটিকয় মানুষ বিদ্যাসাগরের নাম কেবল পণ্ডিত হিসেবেই হয়তো শুনেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।’
বিদ্যাসাগর ভগবান মানতেন না জেনেও স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে দু’জন বড় মানুষ, একজন বিদ্যাসাগর, আর অপরজন রামকৃষ্ণ।’
কিম্বা বিপরীত মেরুতে থাকা ধর্মীয় গুরু রামকৃষ্ণ কি গভীর আবেগ নিয়ে বিদ্যাসাগরের বাড়িতে গিয়েছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে সে কথা কতজন জানেন!
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজে সংস্কৃত সাহিত্যের দিকপাল ছিলেন। কিন্তু এরপরেও পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী বিজ্ঞান শিক্ষার বিস্তার চেয়েছিলেন তিনি। তিনি বেদান্ত দর্শন নির্ভর শিক্ষার বিরোধী ছিলেন। বলেছিলেন, ‘কতকগুলি কারণে সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য আমাদের পড়াতেই হয়। কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্ত দর্শন সে সম্বন্ধে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই।’ এর পরিবর্তে তিনি আধুনিক যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার বিস্তার চেয়েছিলেন।
মধ্যযুগীয় কূপমণ্ডুক চিন্তা থেকে সমাজকে মুক্ত করার লক্ষ্যে নারী শিক্ষার বিস্তার তাঁর হাত দিয়েই হয়েছিল। হিন্দু ধর্মের প্রচলিত চিন্তার বিরুদ্ধে গিয়ে তত্কালীন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের মতো অসাধ্য কাজ তিনিই করেছিলেন।
বিদ্যাসাগর পরবর্তী সময়ে তার জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে মূলত কিছুই করা হয়নি, হয়নি তেমন করে বিদ্যাসাগর চর্চা। উপমহাদেশের আজকের স্বাধীন রাষ্ট্রযন্ত্র কিছুই করেনি বরঞ্চ শাসকরা বারবার ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে তাঁর জীবন ও সংগ্রামকে।
ভুলিয়ে দিতে না পারলে রাষ্ট্রযন্ত্রে ঘাপ্টি মেরে থাকা উদ্ধত কৃপাণ ধর্মীয় মৌলবাদীদের যে বিপদ! ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামটি ওদের কাছে ভয়ঙ্কর প্রতীয়মান হয়। তাই তো বাংলাদেশে বিদ্যাসাগরের নাম মুছে যায় পাঠ্য পুস্তক থেকে আর পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যাসাগরের পাথরের মূর্তিও রক্ষা পায় না ওদের হাত থেকে!