উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের ধারক পন্ডিত বারীণ মজুমদার

Comments

বাংলাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্যতম পুরোধা পন্ডিত বারীণ মজুমদার। তিনি কেবল বাংলাদেশ নয় বরং উপমহাদেশীয় রাগ সঙ্গীতের অন্যতম ধারক ছিলেন।

১৯২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের পাবনা জেলার রাধানগরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে মা মনিবালা মজুমদার ও পিতা জমিদার নিশেন্দ্রনাথ মজুমদারের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন বারীণ মজুমদার। পারিবারিকভাবে সেতার বাদক মা মনিবালা মজুমদারের কাছে তার সঙ্গীত শিক্ষার হাতেখড়ি হলেও রীতি অনুযায়ী ১৯৩৮ সালে তিনি কলকাতায় ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে প্রথম তালিম নিতে শুরু করেন এবং তাঁর কাছে রাগ ভূপালি শেখেন। সংগীতের প্রতি সীমাহীন আগ্রহ দেখে তার সংগীত পিপাসু পিতা জমিদার নিশেন্দ্রনাথ মজুমদার লক্ষৌ থেকে ওস্তাদ রঘুনন্দন গোস্বামীকে নিয়ে এসে বারীণ মজুমদারের ওস্তাদ হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৯৩৯ সালে তিনি লক্ষৌর মরিস কলেজ অব মিউজিক এ সরাসরি তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বি মিউজিক লাভ করেন। সেখানেই তার পরিচয় হয় উদয় শংকর ও রবি শংকরের সাথে। ১৯৪৩ সালে তিনি একই প্রতিষ্ঠান থেকে সঙ্গীত বিশারদ ডিগ্রি অর্জন করেন। মরিস কলেজ অব মিউজিক এ থাকাকালীন সময়ে তিনি উক্ত কলেজের অধ্যক্ষ পন্ডিত শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকর, অধ্যাপক জে এন নাটু এবং ওস্তাদ হামিদ হোসেন খাঁ এর মত সংগীতজ্ঞের কাছ  থেকে তালিম গ্রহণ করেন। পরে ওস্তাদ খুরশীদ আলী খাঁ, চিন্ময় লাহিড়ী, আফতাব-এ-ম্যুসিকী, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর কাছেও তালিম নেন।

Barin Majumdar02

পণ্ডিত বারীণ মজুমদার

১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার পরে দেশ ভাগ শেষে ১৯৪৭ সালে বারীণ মজুমদার স্থায়ীভাবে পাবনা চলে আসেন। কিন্তু ১৯৫২ সালে জমিদারী হুকুম দখল আইনের বলে তাঁদের ১৮ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত বসতভিটাসহ সব পৈতৃক সম্পত্তি সরকারি দখলে চলে যায়। এ সময় অর্থসংকটে পড়ে তাঁর পরিবার। জীবিকার প্রয়োজনে একপর্যায়ে বেছে নেন ফটোগ্রাফি। কিন্তু সংগীতের নেশায় বেশি দিন ফটোগ্রাফি করতে পারেননি। ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তখন থেকেই তিনি ঢাকা বেতারে নিয়মিত রাগসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। একই সময় তিনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গীত বিষয়ে সিলেবাস প্রণয়ন  করেন। আগ্রা ও রামপুর সাহাসওয়ান ঘরানার শাস্ত্রীয় সংগীত সাধক পন্ডিত বারীণ মজুমদারই প্রথম এদেশে সঙ্গীতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে মিউজিক কলেজ প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেন। ১৯৬৩ সালের ১০ নভেম্বর কাকরাইলের ভাড়া বাসায় ১৬ জন শিক্ষক এবং ১১ জন ছাত্রছাত্রীর সহায়তায় মাত্র ৮৭ টাকা নিয়ে সম্পূর্ণ প্রতিকুল পরিবেশে দেশের প্রথম ’কলেজ অব মিউজিক’ এর যাত্রা শুরু করেন। এই প্রতিষ্ঠানটির প্রারম্ভলগ্নে যাঁরা এ উদ্যোগে পণ্ডিত বারীণ মজুমদারের সাথে যুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন, কামাল লোহানী, আব্দুল আলীম, মীর কাশেম খান, আবেদ হোসেন খান, নারায়ণ চন্দ্র বসাক, ফজলে নিজামী, শেখ লুৎফর রহমান, ইলা মজুমদার, কামরুজ্জামান মনি, খালিদ হোসেন, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, প্রমুখ।

সে সময়কার শাসক মোনেম খাঁ এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যকলাপ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করলেও এর কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করেনি পাকিস্তানী শাসকেরা। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য, স্বাধীন দেশে, নিজের হারানো জমিদারীর সর্বশেষ সম্বল এবং স্ত্রীর সঞ্চয়কে পুঁজি করে নিজ হাতে গড়া সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের গ্রান্ট তসরূপের মিথ্যা দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৭৮ সালের মামলা করা হয় এবং ১৮ দিন হাজত বাস করতে হয় পণ্ডিত বারীণ মজুমদারকে।

তিনি রাগসংগীতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ‘মণিহার সঙ্গীত একাডেমী’ নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

১৯৬৫ সাল থেকে পন্ডিত বারীণ মজুমদার নিয়মিত ঢাকা টেলিভিশনের বিশেষ শ্রেণীর শিল্পী হিসেবে রাগসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। ১৯৬৮ সালে ডিগ্রি ক্লাসের সিলেবাস তৈরি করে সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত করেন এবং ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিষয়ক পরীক্ষা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭০ সালে তিনি সঙ্গীত কলেজের তহবিল সংগ্রহের জন্য ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজন করেন যেখানে নাজাকাত-সালামত আলী, আমানত-ফতেহ আলী, মেহেদী হাসান, আসাদ আলী খাঁসহ বহু গুণী শিল্পী অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি ভারতের বিখ্যাত সব কন্ঠশিল্পী এবং যন্ত্র শিল্পীদের নিয়ে ’আলাউদ্দিন সঙ্গীত সম্মেলন’ আয়োজন করেন।

১৯৭৩ সালে শিক্ষা কমিশনের অধীন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সিলেবাস প্রণয়ন করেন এবং উক্ত কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭২-৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বেতারের অডিশন ও গ্রেডেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮২ সাল থেকে দীর্ঘ সময় তিনি ’সুর সপ্তক’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৮৬ সালের ১৪ মার্চ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ’মনিহার সঙ্গীত একাডেমী’, যার উদ্বোধন করেন পন্ডিত যশরাজ। ১৯৯০ সালে ’মনিহার সঙ্গীত একাডেমী’র সার্টিফিকেট প্রদান অনুষ্ঠানে আসেন পন্ডিত ভি.জি.যোগ। ১৯৯১ সালের জুন মাসে তিনি শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত তিনদিনব্যাপী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ’সঙ্গীত কলি’ ও ’সূর লহরী’ নামে দুটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন।

Barin Majumdar_Ila Majumdar

বারীণ মজুমদারের স্ত্রী ইলা মজুমদার

ওস্তাদ বারীণ মজুমদারের স্ত্রী ইলা মজুমদার ছিলেন একজন বরেণ্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী। ১৯৮১ সাল থেকে প্রায় ২২ বছর তিনি রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৫ বছর জাতীয় সংগীত মহাবিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। সংগীতচর্চা ও শিক্ষকতার পাশাপাশি ইলা মজুমদার লেখালেখির জগতেও বিচরণ করেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘স্মৃতিতে শ্রুতিতে বারীণ মজুমদার’, ‘দিনগুলি মোর’ ও ‘সংগীতের তত্ত্বকথা’। ২০১১ সালের ৩ মে ৭০ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান সংগীতজ্ঞ ইলা মজুমদার।

তাঁদের ঘরে তিনটি সন্তানের জন্ম হয়। প্রথম সন্তান মধুমিতা মজুমদারের জন্ম হয়েছিল ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে। ৯ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধকালে ‘৭১ এর ২ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে বাঁচতে শরণার্থী হয়ে দেশ ত্যাগের সময় গানবোটের মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণের মধ্যে বিক্রমপুর এলাকায় হারিয়ে যায় মধুমিতা। এই দম্পতী তাঁদের কন্যাকে আর কখনই ফিরে পাননি। তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান পার্থ মজুমদার একজন সঙ্গীত পরিচালক এবং কনিষ্ঠ সন্তান বাপ্পা মজুমদার একজন সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক।

Barin Majumdar_Modhumita

১৯৭১ এ হারিয়ে যাওয়া কন্যা মধুমিতা মজুমদার

সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি অনেক সম্মাননা ও পদকে ভূষিত হন। ১৯৭০ সালে পন্ডিত বারীণ মজুমদারকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের বেসামরিক খেতাব ’তমঘা-ই-ইমতিয়ায’ দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে ২১শে পদক প্রদান করা হয়। একই বছর বরেন্দ্র একাডেমী তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করে। তিনি ১৯৮৮ সালে কাজী মাহবুবউল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্ট ও ১৯৯০ সালে সিধু ভাই স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন। শিল্পকলা একাডেমী ১৯৯১ সালে তাঁকে গুণীজন সম্মাননা প্রদান করে। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ ১৯৯৩ সালে তাঁকে রবীন্দ্রপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৫ সালে বেতার টেলিভিশন শিল্পী সংসদ তাঁকে শিল্পীশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। পন্ডিত বারীণ মজুমদারকে ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমীর ফেলোশিপ প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পদক প্রদান করে।

রাগসঙ্গীত চর্চা ও সঙ্গীত শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে পন্ডিত বারীণ মজুমদার বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন।

২০০১ সালের ৩ অক্টোবর ঢাকার হলিফ্যামিলি হাসপাতালে বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

লেখক: সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.