উপলব্ধি: ২ মার্চ-পতাকা দিবস । শামীমা ইসলাম তুষ্টি

Comments

আমার বাবা মহিব উল ইসলাম ইদু একজন মুক্তিযোদ্ধা, ছোটবেলা থেকেই জেনে বড় হয়েছি আমার বাবা স্বাধীনতার প্রথম পতাকা বহনকারী, কিন্তু ইতিহাসের কোথাও তার নাম লেখা নেই, তাতে করে আমার বাবার কোন দু:খ বা কষ্ট নেই, যখন বুঝতে শিখলাম বাবাকে বলতাম, বাবা পতাকা দিবস পালন করা হয় কিন্তু কোথাও তোমার কথা বলা হয় না কেন? বাবা বলেন আমরা কোন কিছু পাবার আশায় দেশ স্বাধীন করিনি! আমরা মুক্তিযোদ্ধারা তোমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ দিয়েছি, কোন প্রতিদান এর আশায় নয়।

পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের “পতাকা বহনকারীকে দেখামাত্র গুলী করার ঘোষণা উপেক্ষা করে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ জ্ঞান করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রকাশ্যে মিছিল সহকারে আমার বাবা পতাকা বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি তার গর্বিত সন্তান!!!

Mohib Ul Islam Edu

মুক্তিযোদ্ধা মহিব উল ইসলাম ইদু। ছবি :ফেসবুক

১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে জয়লাভ করে। শুরু হয়ে যায় পাকিস্তানিদের বাঙালীদের ক্ষমতা না দেবার ষড়যন্ত্র।

৩ মার্চ, ১৯৭১, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। কিন্তু কুখ্যাত সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খাঁন ১ মার্চ, ১৯৭১-তে রেডিও টিভিতে ঘোষণার মাধ্যমে হঠাৎ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে এবং সামরিক প্রশাসন “তথাকথিত পতাকা” প্রদর্শন ও বহনকারীকে দেখা মাত্র গুলী ও যে ভবনে পতাকা দেখা যাবে সেই ভবনের আশে পাশের ১০০ গজ এলাকা গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে ।

এই ঘোষণা রেডিও টিভিতে একটু পরপরই প্রচার করা হচ্ছিলো। আমার বাবা তখন রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ১৯৬৬ সন থেকেই ছাত্রলীগের বিপ্লবী শাখা নিউক্লিয়াসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের আমাদের প্রাণপ্রিয় পতাকা নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২ মার্চ, ১৯৭১, সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের সামনে এক ছাত্র গণসমাবেশের ডাক দেয়।

নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেই গণসমাবেশে আমাদের প্রাণপ্রিয় পতাকা (সবুজের মাঝে লাল গোলকের উপর বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত) প্রদর্শন ও উত্তোলনের কর্মসুচী গ্রহণ করা হয়। নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রতিবাদে ওই পতাকা প্রকাশ্যে মিছিল সহকারে গণসমাবেশে নিয়ে আসার জন্য বাবার বিশিষ্ট বন্ধু তৎকালিন ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক, শেখ জাহিদ হোসেনেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

একই পাড়ায় (গুলবাগ) থাকার সুবাদে ২ মার্চ, ১৯৭১, সকাল ৮টায় গুলবাগের রেল লাইনের পাশের দোকানের ঝাঁপের চিকন বাঁশ নিয়ে এসে পতাকা বেঁধে আমার বাবা মালিবাগের গুলবাগ থেকে মিছিল সহকারে রেল লাইন ধরে (তখন খিলগাঁও বিশ্বরোড হয়নি) মৌচাক, সিদ্ধেশরী, বেইলী রোড, হয়ে রমনা পার্কের ভিতর দিয়ে তৎকালিন রেসকোর্স ময়দানের কাঠের ঘেরা বেষ্টনী ভেঙ্গে বর্তমান শিখা চিরন্তনীর সামনে দিয়ে টি এস সির সামনে মিছিল রেখে সেখান থেকে জনতার করে দেওয়া রাস্তা ধরে শেখ জাহিদ হোসেন আর বাবা কাঁধে করে পতাকা নিয়ে উপথিত হন। কলাভবনের গাড়ী বারান্দায় অনুষ্ঠিত ছাত্র গণজমায়েতের মঞ্চের সামনে যেয়ে শেখ জাহিদ হোসেন বাবার হাত থেকে পতাকা নিয়ে সামরিক কায়দায় মঞ্চ পরিচালনাকারী তৎকালিন ডাকসু’র ভিপি, (বর্তমানে দিকভ্রান্ত) ছাত্রনেতা আসম আবদুর রবের হাতে উঠিয়ে দেন!

পরবর্তিতে ১৯৭১ সালে ভারতে যেয়ে দেরাদুন জেলার টান্ডুয়া সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বি এল এফ (মুজিব বাহিনী) এর মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে উচ্চতর গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

যেহেতু শেখ জাহিদ হোসেন (তৎকালিন ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক) নেতা ছিলেন তাই উনার নেতৃত্বে মিছিল সহকারে সারা পথ কাঁধে করে পতাকাটি বহন করে নিয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার বাবার হয়েছিলো। সেই অর্থেই আমার বাবা স্বাধীনতার প্রথম পতাকা বহনকারী।

লেখক পরিচিতি:
শামীমা ইসলাম তুষ্টি, মহিব উল ইসলাম ইদুর কন্যা, অভিনয় শিল্পী
Shamima Islam Tushti

*এই  লেখার মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। -সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.