।। মীর শামছুল আলম বাবু ।।
উর্দু ভাষা ও পাকিস্তানি প্রযোজকের চ্যালেঞ্জের জবাব হিসেবে বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ-পরিবেশে যেকোন ধরণের সুযোগ সুবিধা ছাড়াই শুধু কঠোর আত্মবিশ্বাস আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যিনি বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক কাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের মত দুঃসাহস দেখিয়ে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণোজ্জ্বল হয়ে আছেন তিনি আব্দুল জব্বার খান-এদেশের চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ পরিচালক।

এদেশের চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ পরিচালক আব্দুল জব্বার খান
উপমহাদেশে প্রথম বায়োস্কোপ দেখানো হয় ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই তারিখে বোম্বের ওয়াটসন হোটেলে এবং পরে কোলকাতায়। ১৮৯৮ সালে মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন কোলকাতায় ‘দি রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানী’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৩ সালের ৩ মে তারিখে মুক্তি পায় দাদা ভাই ফালকে পরিচালিত চলচ্চিত্র (নির্বাক) রাজা হরিশ চন্দ্র। ১৯১৮ সালের ৮ নভেম্বর মুক্তি পায় কোলকাতায় নির্মিত প্রথম বাংলা পূর্ণাঙ্গ (নির্বাক) চলচ্চিত্র জ্যোতিষ ব্যানার্জী পরিচালিত ‘বিল্বমঙ্গল’। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯১৪ সালে শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আর ১৯১৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল জব্বার খাঁ। পরবর্তীতে তিনি ১৯৫৬ সালে নির্মাণ করেন বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সবাক বাংলা চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’- সে এক সুবর্ণ ইতিহাস।
আব্দুল জব্বার খান পেশায় একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হলেও সৌখিন নাট্যকর্মী। ১৯৫৩ সালের জানুয়ারী মাসের একদিনে কমলাপুর ড্রামাটিক এসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে পূর্ববঙ্গ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুারোর পরিচালক ডক্টর আবদুস সাদেকের নিমন্ত্রনে এক সভায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে তাঁর নতুন পরিচয়ের বিজ অঙ্কুরিত হয়। ড. সাদেক চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয়ক এই সভায় প্রদেশের ৯২টি প্রেক্ষাগৃহে বিদেশি ছবির বদলে যাতে স্থানীয় ছবি চলে সে জন্যে ছবি তৈরির কথা বলেন। ডক্টর সাদেকের বক্তব্যের পর অবাঙালি উর্দুভাষী চিত্রব্যবসায়ী ফজলে দোসানীর এখানকার আবহাওয়া খারাপ, আর্দ্রতা বেশি। কাজেই এখানে ছবি তৈরি সম্ভব নয় – এই মন্তব্যের জবাবে আবদুল জব্বার খান চ্যালেঞ্জ করে বললেন – “কলিকাতায় যদি ছবি হতে পারে তবে ঢাকায় কেন হবে না? আমি প্রমথেশ বড়–য়াকে ছবির শুটিং করতে দেখেছি। কলিকাতার কোনো কোনো নির্মাতাও এখানে এসে ছবির শুটিং করেছেন। তাহলে এখানে কেন ছবি হবে না? মি. দোসানী আপনি জেনে রাখুন, যদি আগামী এক বছরের মধ্যে কেউ ছবি না করে তবে আমি জব্বার খানই তা বানিয়ে প্রমাণ করব।” এই চ্যালেঞ্জের জবাব হিসেবেই পরের বছর আবদুল জব্বার খান শুরু করেন পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের প্রথম পূর্নাঙ্গ সবাক বাংলা ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ এর কাজ।
১৯৫৩ সালের ২৩ তারিখে ৫১ নম্বর নারিন্দা রোডে ইকবাল ফিল্মস এর একটি সভায় স্থির করা হয় ‘ইকবাল ফিল্মস’ প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে প্রামাণ্য ও কাহিনীচিত্র তৈরি করবে। ক্যামেরা, ক্যামেরাম্যান ও চিত্রনাট্য – সব হলেও অভিনেতা- অভিনেত্রী কোথায়? বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী কলিম শরাফীর স্ত্রী মিসেস কামেলা শরাফী বেশ নামী নাট্যশিল্পী। কলিম শরাফী চাকরী করেন চট্টগ্রামে একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতে। জব্বার খান তাদের উভয়কে ছবির নায়ক-নায়িকা করার প্রস্তাব নিয়ে চট্টগ্রামে যান। ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাবে শরাফী খুবই উৎসাহিত হলেও এক পর্যায়ে পারিশ্রমিক দাবী করেন। এই পর্যায়ে জব্বার সাহেবের একজন নায়কের জন্য টাকা খরচ করা মোটেই সম্ভব নয়। তাই হতাশ হয়ে ঢাকায় ফিরে আসার জন্য প্রস্তুত জব্বার খানকে একবন্ধু তাঁকে বললেন – পাথর ঘাটায় পূর্ণিমা সেন গুপ্তা নামে একটি মেয়ে আছে। সে নাটকে অভিনয় করে – এই মেয়েকে নায়িকা করা যেতে পারে।

মুখ ও মুখোশের একটি দৃশ্য
নায়িকা কাষ্ট করা হলো। আর সব চরিত্রই বাকি। তাই আজাদ, ইত্তেফাক ও মর্ণিং নিউজ পত্রিকায় এদেশের প্রথম ছবিতে অভিনয়ের জন্য পাত্র-পাত্রী নেয়া হবে শীর্ষক বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। এই বিজ্ঞাপন দেখে গোপনে যোগাযোগ করেন ইডেন কলেজের আইএ ক্লাসের ছাত্রী পিয়ারী। পিয়ারী বেগমদের বাড়ি পূরান ঢাকার আব্দুল হাদী লেনে। বাবা ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রশাসন বিভাগে চাকরী করেন। মেয়ের ছবিতে অভিনয় করা বাবা পছন্দ করবেন না তাই পিয়ারী বেগম পরিচালককে অনুরোধ করেন তার আসল নাম ব্যবহার না করে কোন ছদ্মনাম ব্যবহার করার জন্য। পিয়ারী বেগমের ছদ্মনাম রাখা হয় নাজমা। কিন্তু সমস্যা বাধে পত্রিকায় যখন ছবি ছাপা হয়। পত্রিকায় ছবি দেখে পিয়ারী বেগমের বাবা ব্যাপারটা সম্পর্কে অবগত হন এবং মেয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। ঘটনাটা জব্বার খান সাহেব জানার পর নিজে গিয়ে পিয়ারী বেগমের বাবার সাথে দেখা করে তাকে বুঝিয়ে রাজী করান। বিজ্ঞাপন দেখে গোপনে আরো যোগাযোগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্রী এবং বেতার ও মঞ্চের নাট্যশিল্পী জহরত আরা। আমিনুল হক তখন ঢাকা রেডিওর বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা। তাকে নির্বাচন করা হয় একটি চরিত্রের জন্য। পূর্ণিমা সেন ও পিয়ারী বেগম দুজনই দুটি প্রধান চরিত্রের জন্য নির্বাচিত হন। ছবির মুখ্য চরিত্রে (শমসের ডাকাত) নেয়া হয় ইনাম আহমেদকে, দ্বিতীয় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করার জন্য সিদ্ধান্ত নেন আবদুল জব্বার খান নিজেই। অন্যান্য চরিত্রে নির্বাচিত হন সোনা মিয়া, রহিমা (খালা), নূরুল আনাম খাঁ, (মাওলানা আকরাম খার ভাই) ভবেশ মুখার্জী, গওহর জামিল (নৃত্যশিল্পী এবং অভিনেত্রী রওশন জামিলের স্বামী) আলী মনসুর, সৈয়দ রেদোয়ানুর রহমান (সাংবাদিক) সিলেটের কামরুজ্জামান, নেত্রকোনার এফ. করীম (তৎকালীন ম্যাজিষ্ট্রেট), বিলকিস বারী, চাঁদপুরের রেলওয়ে গার্ড ওয়ারিশ মিয়া, আউয়াল খান (জব্বার খানের ছোট ভাই) সাইফুদ্দিন (জব্বার খানের শ্যালক) জুলু খান (জব্বার খানের শিশুপুত্র) খালেদা, ফায়জা, আতাউর, রফিক, আশরাফ, শাহাদাত, খুসু ডাক্তার, হাশমত,জহির চৌধুরী, আওলাদ, খয়ের, সুজাত, বাচ্চু, মঞ্জুর, ইকবাল, সোবহান, আকরাম, জুম্মন, সরদার জয়নুদ্দিন (সাহিত্যিক), লাকি, কাওসার, সাদেক, আলীম, মোস্তফা, শফি, হাই, সেকান্দর, ফজলু, ওয়ার্ছি, হাফেজ, আলমগীর ও আরো অনেকে।
ছবির অভিনেতা- অভিনেত্রী নির্বাচনের কাজ শেষ হয় ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে। এবার শুরু হয় চিত্রগ্রহণের প্রস্তুতি। ক্যামেরার সাউন্ড গেট না থাকায় মুরারী মোহন বললেন, দৃশ্যানুযায়ী ডায়লগ টেপে (স্পুলে) রেকর্ড করতে হবে। তবুও কি আর করা, এ পদ্ধতিতেই ডায়লগ রেকর্ড করে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। গীতিকার গফুর সাহেব ছিলেন আব্দুল জব্বার খানের বন্ধু। সারথী নামে তিনি গান লিখতেন। বন্ধুত্বের সুত্রে তিনি এ ছবির জন্য দুটি গান লেখেন। সমর দাস ও ধীর আলীকে সঙ্গীত পরিচালনা ও সহকারী হিসাবে নেয়া হয়। কণ্ঠশিল্পী নেয়া হয় আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসনাৎ (মাহবুবা রহমান) কে। আর যন্ত্র-সঙ্গীতে নেয়া হয় মীর কাশেম খান (সেতার) কানাইলাল শীল (সেতারা) মোবারক আলী (তবলা) বজলুল করীম (তবলা) ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান (তবলা) আবেদ হোসেন খান (সেতার) ধীর আলী মিয়া (বাঁশি) মোবরক, খাদেম হোসেন, মনসুর আলী প্রমুখ।

মুখ ও মুখোশের একটি দৃশ্যে আলী মনসুর ও জহরত আরা
সবতো হলো। কিন্তু রেকর্ডিং করা হবে কোথায় ? ঢাকায় তথা বাংলাদেশে তখন কোন রেকর্ডিং ষ্টুডিও বা গ্রামোফোন কোম্পানী গড়ে ওঠেনি। জব্বার খান ছবির স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী গান দুটিই আগে টেপে রেকর্ড করে রাখার কথা চিন্তা করেন। সমর দাসও যথা সময়ে আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসানাতকে নিয়ে গান রেকর্ডিং করার আয়োজন করেন শান্তিনগরের ইকবাল ফিল্মস-এর অফিস রুমের দেয়ালে কাপড় টাঙ্গিয়ে – কোন মহরত ছাড়াই গান দুটি রেকর্ডিং করা হয়।
গান রেকর্ডিং করার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় চিত্রগ্রহণের। চ্যালেঞ্জের বাস্তব রূপ দেবার চুড়ান্ত সময় এসে গেছে। ৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কালিগঞ্জের খালে প্রথম ক্যামেরা বন্দী হলো একটি মাছ ধরার দৃশ্য। পরপর দুদিন চলে মাছ ধরার দৃশ্য গ্রহণ। আর প্রথম পর্যায়ের এই চিত্রগ্রহণে অংশ নেন আমিনুল হক, জামান, রফিক ও গ্রামবাসীরা। ক্যামেরা অপারেট করা হতো জেনারেটরের সাহায্যে আর জেনারেটরের শব্দ নিয়ন্ত্রণের জন্য মাটির নিচে গর্ত খুঁড়ে সেখানে রাখা হয়েছিলো জেনারেটর ।
দ্বিতীয় পর্যায়ে চিত্রগ্রহণ করা হয় তেজগাঁও এলাকার একটি গভীর জঙ্গলে (বর্তমানে তেজগাঁও শিল্প এলাকা)। ওই দিনে একটি ডাকাতির দৃশ্যে অন্যান্যের সঙ্গে অংশ নেন মোহাম্মদ হোসেন (বিচারপতি)। কিন্তু পরের দিন আর তিনি শুটিং করতে আসেননি। মোহাম্মদ হোসেন সাহেব বাদ পড়ায় চিত্রনাট্য পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। এতে কিছুদিন শুটিং বন্ধ রাখতে হয়। প্রস্তুতি নিয়ে আবার যখন কাজে নামবে তখনই শুরু হয় ভয়াবহ বন্যা। ১৯৫৪ সারাদেশ বন্যার পানিতে প্লাবিত । সব লোকেশন বাতিল হয়ে যায়। হতাশ হয়ে যায় জব্বার খানের ইউনিট। আর বুঝি চ্যালেঞ্জ রক্ষা করা সম্ভব হবে না। সবাই তল্পীতল্পাসহ ফিরে গেলেন আপন আপন গৃহে। পূর্ণিমা সেন থেকে গেলেন ঢাকাতেই।

মুখ ও মুখোশের একটি দৃশ্যে পিয়ারী বেগম
এসময় ইকবাল ফিল্মস উদ্যোগ নেয় এই বন্যার ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরী করার। উদ্দেশ্য, এই প্রামাণ্য চিত্রের ফিল্মের সঙ্গে মুখ ও মুখোশ ছবির তিন দিন শুটিং-এর ফিল্মটুকু নিয়ে লাহোরে যাওয়া এবং প্রিন্ট করে দেখা। জব্বার খান প্রামাণ্যচিত্রের ফিল্মের সঙ্গে মুখ ও মুখোশ ছবির তিনদিন শুটিং-এর ফিল্মটুকু নিয়ে মুরারী মোহনসহ লাহোরে সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী নুরজাহানের স্বামী শওকত রিজভীর শাহনুর ষ্টুডিওতে গেলেন। প্রিন্ট করালেন। দেখা গেল সবই ঠিক আছে, শুধু শব্দের সঙ্গে মুখ মিলছে না। তখন ষ্টুডিওর মালিক শওকত রিজভী ও টেকনিশিয়ানরা নানা রকম পরামর্শ দেন। জব্বার খান আবার আশান্বিত হয়ে শাহনুর ষ্টুডিওতে একজন সম্পাদক নিয়োজিত করে আসেন যে, বিভিন্ন সময়ে স্যুটিং করা ফিল্ম পাঠানো হবে এবং তিনি তা প্রিন্ট করে ফলাফল জানাবেন আর প্রামাণ্যচিত্রের ৩টি প্রিন্ট নিয়ে ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি নেন।
ঢাকায় ফেরার সময় ক্যামেরাম্যান মুরারী মোহন ষ্টুডিওর কর্মচারীদের বললেন, জব্বার খানের এই পাগলামীর কি হবে কে জানে। তিনি স্ত্রীর অসুখের কথা বলে জব্বার খানের কাছ থেকে কন্ট্রাক্টের পাওনা বাকি টাকা নিয়ে লাহোর থেকেই কোলকাতায় চলে যান। তবে কথা দিয়ে যান যে, খুব শিগগীরই তিনি আবার ঢাকায় ফিরে আসবেন। ফিরে আসার কথা বলে গেলেও আর আসেনি।
জব্বার খান প্রামাণ্যচিত্রের প্রিন্ট নিয়ে একাই ফিরে এলেন ঢাকায়। প্রামান্যচিত্রটি তখন সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছিল।
ঢাকায় আসার পর বেশ কিছুদিন যায়। কিন্তু মুরারী মোহন ঘোষ আর ঢাকায় এলেন না। তখন জব্বার খান সহকারী চিত্রগ্রাহক কিউ. এম. জামানকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি এ ছবির চিত্রগ্রহণ করতে পারবেন না? প্রত্যয়ের সঙ্গে জামান সাহেব উত্তর করলেন, নিশ্চয়ই পারব, যদি আপনি সুযোগ দেন। এতে আবার আশার সঞ্চার হলো। তাই এবার আয়োজন করা হল মহরত অনুষ্ঠানের। ১৯৫৪ সনের ৬ আগষ্ট শাহবাগ হোটেলের ছাদে (পরবর্তীতে পি.জি হাসপাতাল, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) মহরত অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান অতিথি হয়ে এসে তৎকালীন গভর্নর মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা এই মহরত উদ্বোধন করেন।
ইতিমধ্যে সরকারের প্রচার বিভাগের জন্য একটি চলচ্চিত্র স্টুডিও স্থাপনের পথকে সুগম করতে সরকার ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা অনুমোদন দেয়। প্রাদেশিক গভর্ণর ইস্কান্দর মির্জার সহায়তায় ওই টাকায় স্টুডিওর জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয় করে তেজগাঁওস্থ বি.জি প্রেসের ভিতরে অস্থায়ী স্টুডিও স্থাপন করা হয়। নাজির আহমদকে ডেপুটি ডিরেক্টর করে জনসংযোগ দপ্তরের অধীনে চলচ্চিত্র বিভাগের কাজ এখান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১৯৫৫ সালের ১৯ জুন। জব্বার খান মুখ ও মুখোশ ছবির পোষ্ট প্রোডাকশনের কাজ করার জন্য এই স্টুডিও থেকে সহায়তা পেতে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে নাজীর আহমদ তাতে অসম্মতি জানান।
আব্দুল জব্বার খান নিরুপায় হয়ে শুটিং শেষ করে গান টান সব নিয়ে লাহোরে যান। সেখানে তিন মাস থেকে অভিজ্ঞ সম্পাদক লতিফ সাহেবের সহায়তায় সম্পাদনা শুরু হয়। কিন্তু সমস্যা শব্দের সাথে ছবির ‘মিস লিপিং’, স্থানীয় বাঙালীদের সহায়তায় ডাবিংয়ের জন্যে হাফ শিফ্ট নষ্ট হল, কেউই পারল না। সংলাপই বলতে পারে না। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার বললেন, আগের সংলাপই রাখতে – ‘রি-রেকর্ডিং’ করে সাউন্ড ঠিক করে দেবে। এক শিফট কাজ হল – নয়েজ কমালে ডায়লগও কমে যায়। জব্বার সাহেব ভাবলেন ধারা বর্ণনা দেবেন, কিন্তু সম্পাদক রাজি না – এতে ছবি চলবে না। এরপর উনি একটা শব্দের প্রত্যেকটা অক্ষর ফ্রেম কেটে কেটে জোড়া দিয়ে অনেক কষ্ঠ করে এক মাসে সম্পাদনা শেষ করলেন, ওই সময় অনেক টিটকিরি শুনতে হয়েছে। কাজ শেষ হল –
ফিল্মসহ ফেরত আসতে আরেক ঝামেলা – কাস্টম আইনে এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে ফিল্ম ও স্বর্ণ যাবে না। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি আবদুস সাত্তার (বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট) তখন করাচীতে। তার সহায়তায় সেই সমস্যার সমাধান হল। করাচীর বাঙালীরা মুখ ও মুখোশ দেখতে চায় – এজন্য একদিন দেরি করতে হলো। হল ঠিক করে ছবি দেখানো হলো। মুখ ও মুখোশ এর প্রথম প্রদর্শনী হলো করাচীতে অবস্থানরত বাঙালীদের মধ্যে।
ঢাকায় এসে জব্বার সাহেব ছবির জন্য হল পান না। কারণ হল মালিকরা শুনেছেন এটা কোনো ছবিই হয়নি। দর্শকরা চেয়ার টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে। এগিয়ে এলেন সময় পাকিস্তান ফিল্ম ট্রাস্টের মোশাররফ হোসেন চৌধুরী ও আউয়াল সাহেব, ফনীবাবু এরা চেষ্টা করে হল ঠিক করলেন। কিন্তু ঢাকাতে হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত মুকুল (এখন আজাদ) আর রূপমহল এর মালিক কমল বাবু রাজি হলেন। বললেন, জব্বার সাহেব টাকা খরচ করল আর আমার কয়েকটা চেয়ার যদি ভাঙ্গে তো ভাঙ্গুক।
এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ‘১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট’ ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবির মুক্তির দিন। প্রিমিয়ার শো উদ্বোধন করলেন গভর্ণর শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক। সকাল বেলা মুকুল প্রেক্ষাগৃহে বেশ জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হলো। মুক্তি পেল ৩টার শো থেকে ঢাকার রূপমহলএ। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে। হাউজ ফুল হয়ে ছবি চলল। প্রতি মুহুর্তে হাততালি, হাততালি, হাততালি একদম বিরতি পর্যন্ত। এই হল উর্দু ভাষা ও পাকিস্তানি প্রযোজকের চ্যালেঞ্জের জবাব – ‘মুখ ও মুখোশ’এর কাহিনী।
মুখ ও মুখোশ -এর ক্রেডিট লাইন –
ইকবাল ফিল্মস্ লিমিটেড এর প্রথম অবদান “মুখ ও মুখোশ”
রূপায়নে –
পূর্ণিমা আমিন নূরুল আনাম খাঁ জামান কাওসার
নাজমা রফিক আতাউর জুম্মন আউয়াল
জহরৎ কামরু সোনামিয়া হাফেজ সাদেক
রহিমা মীনার সাহাদাৎ মোস্তফা সফি
বিলকিস আশরাফ হাসমত জয়নুদ্দিন সেকান্দার
খালেদা খুসু জহির ফজল লাকী
জব্বার খাঁ ভবেশ খায়ের আলীম মষ্টার জুলু
ইনাম আওলাদ সুজাত আকরাম ও
আলি মনসুর রেদওয়ান বাচ্চু আলমগীর আরো অনেকে
বিনয় বিশ্বাস ওয়াছি মঞ্জুর সোবহান
এফ. করিম ওয়ারিস ইকবাল হাই
ছাইফু
প্রধান কর্ম্ম-সচিব নুরুজ্জামান
ব্যবস্থাপনায় আতাউর রহমান, আশরাফ্উজ্জামান, হাসমাত আলী, শামছুল হক
শব্দ গ্রহণে – মাইনুল ইসলাম, সাহায্য করেছেন – হাসমত আলী
স্থির চিত্রগ্রহণে – ক্রিসেন্ট স্টুডিও, নওয়াবপুর রোড, ঢাকা
সম্পাদনায় – এম, এ, লতিফ, সাহায্য করেছেন – গোলাম মোস্তফা, দায়ুদ, হুমায়ুন
পরিচালনায় সাহায্য করেছেন শাহজাহান, হাবীব মেহেদী
সঙ্গীত রচনায় – সারথী
নৃত্য পরিচালনায় – গওহর জামিল
রূপসজ্জায় – শমশের আলী
রেখা অঙ্কনে – মোস্তফা আজিজ
সঙ্গীত পরিচালনায় – শ্রী সমর দাস,
কণ্ঠ সঙ্গীতে – মাহবুবা হাসনাত ও আব্দুল আলিম
চিত্রগ্রহণে – মেছবাহুজ্জামান, সাহায্য করেছেন আমিনুর রহমান, মহীউদ্দিন, রবিউল
শাহনূর স্টুডিওতে পরিস্ফুটিত
কাহিনী, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় – আব্দুল জব্বার খাঁ।
লেখক:
মীর শামছুল আলম বাবু, পথিকৃৎ পর্বতারোহী, আলোকচিত্র ও চলচ্চিত্রগ্রাহক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা ও গবেষক।