একাত্তরের প্রীতিলতা

Comments

।। সাগর লোহানী ।।

১৯৭১, এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ, ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক মানস ঘোষ একজন মুক্তিযোদ্ধার একটি ছবি প্রকাশ করলেন তাঁর পত্রিকায়। ভারত ও বাংলাদেশের জনগণ জানল ছবিটি একজন নারীর। যিনি পুরুষের বেশে পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ রেখে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে রুখে দাঁড়িয়েছে। সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে পাবনার রণাঙ্গনে। এই মহীয়সী নারীই শিরিন বানু মিতিল।

shirin_banu-1

পুরুষের পোশাকে মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল, যে ছবি ষ্টেটসম্যানে ছাপা হয়েছিল

একটি রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে শিরিন বানু মিতিল সাহসী, পরাক্রমশালী, দৃঢ়প্রত্যয়ী এক মানুষ যিনি সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ-সংশয়কে ঝেড়ে ফেলে লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছিলে তাও কিনা পুরুষের ছদ্মলেবাসে। অকুতোভয় এই নারী সমাজ, প্রথা ও বাধা ভেঙে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মাত্র ২০ বছর বয়সে পুরুষের পোশাক পরে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করে হয়ে উঠলেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত, এক অনুকরণীয় প্রেরণা।

রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোয় উদ্ভাসিত ছিল তাঁর পূর্ববর্তী দুই প্রজন্ম। নানা খান বাহাদুর ওয়াসীম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন পাবনার প্রথিতযশা আইনজীবী, সমাজসেবী এবং পাবনা পৌরসভার প্রথম সভাপতি ও জেলা বোর্ডের আজীবন সভাপতি। শিরিন বানু মিতিলের মা সেলিনা বানু ও বাবা খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ। বাবা ছাত্র জীবন থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। মা ছিলেন পাবনা জেলার ন্যাপ সভানেত্রী এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পার্থী হিসেব বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সেলিনা বানু এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেলিনা বানুর এক ভাইও সেই সময়ে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেলিনা বানু রাজনীতিতে আসেন ১৯৩৯ সালে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়। পিতার প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল রাজনীতির ধারা সেলিনার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় সেলিনা বানু মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির লঙ্গরখানায় স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে নন্দিত হয়েছিলেন। ১৯৪৬ থেকে ৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি পাবনা জেলা ছাত্র ফেডারেশন সভাপতি হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন। ১৯৪৯ সালে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সাথী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

এমনই পারিবারিক রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা শিরিন বানু মিতিল নিজেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অদম্য দেশপ্রেমিক নারী, প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় সমুজ্জ্বল করেছেন। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে দেশের অন্যান্য স্থানের মত পাবনা জেলাও পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। জারি হয় সান্ধ্য আইন৷ ২৬ মার্চ তারা রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করে৷ সাধারণ মানুষের উপর নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার। পাবনায় প্রাথমিক প্রতিরোধ শুরু হয় একাত্তরের ২৫ মার্চেই৷ চলে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। ২৭ মার্চ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শুরু হয় পাল্টা আক্রমণ। ২৭ মার্চ পাবনা পুলিশ লাইনে যে যুদ্ধ সংগঠিত হয় সেখানে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয়। সেই যুদ্ধ রূপ নেয় জনযুদ্ধে। ঘরে ঘরে মেয়েরাও যুদ্ধে নামে গরম পানি, অ্যাসিড বাল্ব, বটি আর দা নিয়ে।

মিতিলের দুই চাচাতো ভাই জিন্দান ও জিঞ্জির যুদ্ধের ময়দানে রওনা হয়। তাদের মা পাবনা মহিলা পরিষদের সভানেত্রী রাকিবা বেগম তাঁর ছেলেদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের কি মানুষ করেছি ঘরে থেকে অসহায়ভাবে মরার জন্যে? মরতে হলে যুদ্ধ করতে করতে মরো।’ শিরিন বানু মিতিলের মতো সংগ্রামী মেয়েদের মানসিকতা ছিল ‘মেরে মরো’৷ শত প্রতিকূলতার মাঝেও তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সহযোদ্ধা চাচাতো ভাই জিঞ্জিরের কাছে মাত্র ত্রিশ মিনিটে থ্রি নট থ্রি চালনা শিখে ফেলেন। কিন্তু নারী হিসেবে সে সময়কার সমাজে সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়া ছিল খুবই কঠিন ব্যাপার। এমন পরিস্থিতিতে মিতিলও ঘরে বসে থাকেননি। তিনি পুরুষের পোশাক, শার্ট প্যান্ট গায়ে চাপিয়ে কিশোর যোদ্ধা সেজে যুদ্ধে অংশ নিলেন।

পাবনায় ২৮ মার্চ টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনার সাথে জনতার এক তুমুল যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সেই যুদ্ধে তিনি ছিলেন একমাত্র নারী যোদ্ধা। এই যুদ্ধে ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৩১ মার্চ পাবনার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয়। ৯ এপ্রিল যমুনা নদীর তীরে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার নগরবাড়ী ঘাটে এক প্রচন্ড যুদ্ধ সংগঠিত হয়, সে সময় কন্ট্রোল রুমের পুরো দায়িত্বে ছিলেন যাঁরা তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সি এবং একমাত্র নারী ছিলেন মিতিল।

ষ্টেটসম্যানের সেই সাংবাদিক মানস ঘোষ তাঁর স্মৃতিচারণে বলছেন, “শিরিনকে আমার অসামান্য লেগেছিল। কারণ আমি তখন যশোর, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহীর বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের খবর যোগাড় করতে গিয়ে প্রচুর মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছি; কিন্তু কোন তরুণী মুক্তিযোদ্ধা নজরে পড়েনি।  …………… ভোর পাঁচটায় যখন ঈশ্বরদী পৌঁছি স্টেশনে দেখি প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা। ডিসি (মুক্তিযোদ্ধা নুরুল কাদের খান) সাহেব শুধু অস্ত্রশস্ত্র নয় সঙ্গে করে ভারতীয় সাংবাদিকদের এনেছেন। এই খবর চাউড় হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের খুঁজতে শুরু করে। আমার কাগজের চিত্র সাংবাদিক শ্যামদাস বোস এবং এক সহযোগী সাংবাদিক চন্দ্র শেখর সরকার ও আমায় তারা ঘিরে ধরে। তখনই আমার চোখ পড়ে শিরিনের ওপর। শারীরিকভাবে রফিকুল ইসলাম বকুল বা ইকবালের মতো সে বলিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা নয়। বরং সে খুব শীর্ণ ও লাজুক প্রকৃতির। আমার কাছে এসে বলল, ‘নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত’। আমার হাত থেকে প্রায় জোর করে এয়ার ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল ‘দামী কিছু নেই তো’? উত্তর দেয়ার আগেই সে বলে ওঠে ‘যুদ্ধের খবর করতে এতো ঝুঁকি নিয়ে আমাদের পাবনায় এসেছেন। আমাদের মেহমানদারি করতে দিন। ডিসি আমাদের বকুল, ইকবাল ও শিরিনের হাতে সঁপে দিয়ে কালেক্টরেটে চলে গেলেন।

আমি তাঁর উৎকণ্ঠা কাটাবার জন্য বলি ‘আমি বিভিন্ন রণাঙ্গনে গেছি; কিন্তু কোন তরুণী মুক্তিযোদ্ধার দর্শন পাইনি। তাই শিরিনকে আমি দেখে বিস্মিত। সত্যি একেই বলে ধন্যি মেয়ে। …..  ডিসি সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ হতেই শিরিনকে জিজ্ঞাসা করি ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে কেন মুক্তিযুদ্ধে নামলো? তোমার মতো মেয়েরা এই বয়সে লেখাপড়া, বিয়ে-শাদীর কথা ভাবে।’ শিরিনের উত্তর শুনে আমি তাজ্জব বনে যাই। ‘এপার বাংলার মেয়েরা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্তের উত্তরসূরি। তারা আমাদের যে পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সেই পথেই আমরা চলতে অভ্যস্ত। তিন দশকের বেশি পাকিস্তানী শাসনের কারণে আমাদের অনেক মনমানসিকতা বদলেছে, যে কারণে চুলটাকে বয়কাট দিতে বাধ্য হয়েছি। আর শাড়ি ছেড়ে শার্ট, প্যান্ট পরতে হয়েছে। না হলে আমি শাড়ি পরেই যুদ্ধ করতাম। আমি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। বঙ্গবন্ধু ঠিকই বলেছেন বাঙালীর জন্য পাকিস্তান হয়নি। সেইজন্য শুধু আমি নই, আমার পুরো পরিবার মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করছে।’

শিরিন যে এক নির্ভীক সৈনিক ছিল তার প্রমাণ পেলাম হাতেনাতে। হঠাৎ কালেক্টরেটে ২০/২৫ জনের একটি সশস্ত্র দলের উদয় হলো। সকলের হাতে চীনা অটোমেটিক রাইফেল। তারস্বরে তারা চেঁচিয়ে বলছে ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। মাওসেতুং লাল সেলাম।’ তারা ডিসির চেম্বারের দিকে রাইফেল তাক করে বলছে ‘আমাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ডিসি তাদের দাবি-দাওয়া সম্বন্ধে কথা বলুক। ‘তাদের কয়েকজন আকাশে তাক করে কয়েক রাউন্ড গুলিও ছুড়ল। শিরিন একজনকে চিহ্নিত করে বলল, ‘ওই লোকটা হচ্ছে টিপু বিশ্বাস। এরা আপনাদের নক্সালদের মতো মাও-এর ভক্ত।’ হঠাৎ শিরিন ওদের উদ্দেশ করে বলে ওঠে ‘এটা কি এসব করার সময়? আপনারা বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, বেইমানি করছেন। আপনাদের লজ্জা করে না? বাঙালীরা আপনাদের কোনদিন ক্ষমা করবে না। আপনাদের অভাব-অভিযোগ থাকলে ডিসি সাহেবকে স্মারকলিপি দিয়ে যান। কিন্তু ডিসি সাহেব মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খুবই ব্যস্ত তাঁকে অযথা ডিস্টার্ব করবেন না।’

কালেক্টরেটে টিপু বিশ্বাসদের উপস্থিতির খবর পেয়েই রফিকুলের মতো মুক্তিযোদ্ধা বেশ কয়েকজন টয়োটা করে সেখানে উপস্থিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। রফিকুল ও টিপুর লোকেরা একে অপরের দিকে রাইফেল তাক করে অবস্থান নেয়। আমার মনে হলো এই বুঝি দুই বিবাদী পক্ষ সম্মুখ সমরে নেমে পড়ে। দুই পক্ষই মারমুখী। তখন অন্য এক শিরিনকে দেখলাম। কালেক্টরেটের দোতলা থেকে নেমে সে সোজা দুই পক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই পক্ষকে কালেক্টরেট ছেড়ে চলে যেতে বলল। কিন্তু কোন্ পক্ষ আগে যাবে তা নিয়ে গোল বাঁধল। পাবনার আকাশে হঠাৎ দুটি এক ইঞ্জিনের ছোট বিমানের আবির্ভাবে এক কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। ডিসি সাহেব কালেক্টরেটের দোতলার বারান্দা থেকে রফিকুলদের উদ্দেশে বললেন, টিক্কা খান প্লেনগুলো পাঠিয়েছে ‘রেকি’ করতে। কারণ সে ঢাকা থেকে এক বিশাল বাহিনী সড়কপথে পাঠিয়েছে পাবনা পুনর্দখলের লক্ষ্যে। সঙ্গে সঙ্গে রফিকুল জানান, ‘আমরা তাহলে নগরবাড়ি ঘাটে গিয়ে হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করি। কারণ এই বাহিনী ফেরি করে নগরবাড়ি ঘাটেই নামবে। আমরা ঐ সময় সবাই ডিসির চেম্বারে ফিরে বসতে যাচ্ছি, তখন ঘরে হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা। বললেন, ‘পাক বাহিনী পাঁচটি ফেরি করে নগরবাড়িতে নেমেছে এবং পাবনা শহরের দিকে এগোচ্ছে। নগরবাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তারা ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে। আমরা অটোমেটিক রাইফেল ও মর্টার দিয়ে সামাল দিতে পারছি না।’ তা শুনেই নুরুল কাদেরের নির্দেশ, মালপত্র গুটান এবং কুষ্টিয়ার উদ্দেশে যাত্রা। তার পোর্টেবল ওয়ারলেস সেটে খবর আসছে পাক আর্মিরা দারুণ বেগে পাবনার দিকে এগোচ্ছে। ….. শিরিনকে রফিকুল ও ইকবালদের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সঁপে দিয়ে পাবনা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বললেন, তোমরা আলাদাভাবে এসো। পদ্মা পার হতে হবে। তোমাদের নৌকার ব্যবস্থা করে রাখছি।’

নুরুল কাদেরের সব নির্দেশ শুনে শিরিনকে ভীত আতঙ্কিত বা সন্ত্রস্ত বলে মনে হলো না। বরং বার বার বলতে শুনেছি ‘আপনারা এগোন, আমরা আসছি। এক সঙ্গে পদ্মা পার হওয়া সঠিক কাজ হবে না’ বলে সে মুক্তিযোদ্ধাদের দলে ভিড়ে গেল। এমন পরিস্থিতিতেও তাকে স্থির শান্ত দেখাচ্ছিল।”

এ ঘটনার কিছুদিন পরেই ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকায় মিতিলের ছবি এবং তাঁর পুরুষ সেজে যুদ্ধ করার খবরটি পত্রিকায় প্রকাশ করায় তাঁর পক্ষে আর পুরুষ বেশে যুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাঁর যুদ্ধ থেমে থাকেনি। পরবর্তীতে পাবনা শহর পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা দখল হলে তিনি ২০ এপ্রিল সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন।

কলকাতায় নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্রের বাসায় কাটাতে হয়েছে মিতিলকে কিছুদিন। প্রথমে কয়েকজন নারী বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে ঘুরে ঘুরে মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দল গঠন করেন। ৩৬ জন নারী নিয়ে গোবরা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। আস্তে আস্তে সদস্য সংখ্যা বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে সদস্য ছিল প্রায় আড়াইশো। সেখানে বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত নারীদের একমাত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গোবরা ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখানে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কলকাতায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে চলতে থাকে তাঁর মুক্তিযুদ্ধ সংঠনের কাজ। অস্ত্রের অভাব থাকায় মহিলা গ্রুপের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব ছিল না। তাই প্রথম দলের একটি অংশ আগরতলায় যান মেডিক্যাল কোরের সদস্য হিসেবে। বাকিরা বিভিন্ন এলাকায় ভাগ হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন। মিতিল মেজর জলিলের নেতৃত্বে পরিচালিত ৯ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন।

ShirinBanu03

শিরিন বানু মিতিল

দেশপ্রেম ও সাহসিকতার মূর্ত প্রতীক শিরিন বানু মিতিল স্বাধীনতার পরে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নারীরা কল্পনাতীত সাহসের সাথে পুরুষের পাশে থেকে সমান তালে লড়াই করেছি, কিন্তু বীরাঙ্গনা শব্দের মধ্য দিয়ে নারীদের যোদ্ধার চাইতে নির্যাতিত হিসেবেই বেশি বিবেচনা করা হয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের লড়াই এখনও চলছে এবং নারীদের এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’

মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল ১৯৭৯ সালে রাশিয়ার মস্কোয় অবস্থিত ফেন্ড্রশিপ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে মস্কো হতে দেশে ফিরে বাংলাদেশ সরকার এর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালিত ‘ওরাল রিহাইড্রেশন প্রজেক্ট’ এর রাজশাহী বিভাগের ব্যবস্থাপক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। পল্লী উন্নয়ন একাডেমীতে ১৯৮২-১৯৮৭ পর্যন্ত উপ পরিচালক, পল্লী শিক্ষা ও নারী উন্নয়ন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে একটি বেসরকারি সংস্থায় জেন্ডার ও গভর্নেন্স ইউনিট এর পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

পাবনা শহরের দিলালপুর মহল্লার খান বাহাদুর লজে ১৯৫০ সালের ২ সেপ্টেম্বর শিরিন বানু মিতিল জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ প্রারম্ভে শিরিন বানু মিতিল পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। ১৯৭০-১৯৭৩ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী এবং কিছু সময়ের জন্য পাবনা জেলা মহিলা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এই বামপন্থী নেতা মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু ছিলেন তিন সন্তানের জননী। পাবনার বীর শিরিন বানু ৭ নম্বর সেক্টরে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিলেও যুদ্ধের পর তিনি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট বা সনদের জন্য আবেদন না করায় তাঁর কোনো “মুক্তিযোদ্ধা সনদ” নেই। দেশকে তিনি ভালোবেসেছিলেন হৃদয় দিয়ে। তাই তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংরক্ষণ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও নারীমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে আমৃত্যু নিয়োজিত রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের সাহসী, সরল, মমতাময়ী, ঋজু এই মুক্তিযোদ্ধা ২০১৬ খৃষ্টাব্দের ২০ জুলাই বুধবার মধ্যরাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন।

অনন্য সাহসী কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল পাক হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক বলিষ্ঠ অধ্যায়, প্রদীপ্ত তারুণ্যের অত্যাশ্চর্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত, দখলদার হায়েনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে এক দুরন্ত যৌবনের লড়াকু প্রতীক হয়ে দেদীপ্যমান আমাদের মাঝে।

 

 

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.