২১ শে এপ্রিল পাকিস্থানি সেনারা ফরিদপুর জেলায় প্রবেশ করার পর থেকে ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা-নির্যাতন ও ধর্ষণ চালাতে ধাকে। ২১ শে এপ্রিল রাতে মুক্তিযোদ্ধারা নগরকান্দা থানা আক্রমণ করে বেশ কিছু অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা এই সংবাদ পেলে ৩০শে এপ্রিল যুদ্ধে নেতৃত্বকারী কমান্ডার আব্দুল আজিজ মোল্লার বাড়ি আক্রমণ করে। কমান্ডার আব্দুল আজিজ মোল্লাকে পাকিস্তানি সেনারা বাড়ি না পেয়ে তার বাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগ করে ফেরার পথে পাকিস্তানি সেনারা আলগাদিয়া গ্রামে আক্রমণ চালায়। ফুলমতি বেগম তার এক বছরের মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা ফুলমতি বেগমকে ধরে তার কোলের মেয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাকে নির্যাতন করতে থাকে। ফুলমতি বেগমের দেওরা পাকিস্তানি সেনাদের বাঁধা দিতে আসলে পাকিস্তানি সেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে।
২ মে পাকিস্তানি সেনারা ভাঙ্গার জান্দি গ্রাম আক্রমন করে প্রায় ৪২ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করে। ধর্ষণ করে অনেক নারীকে। এই সংবাদ ভাঙ্গা উপজেলার হিন্দু পরিবারের লোকজন পেলে তারা ভাঙ্গা হতে পালিয়ে নগরকান্দার আসফরদি গ্রামে এসে আত্মগোপণ করেন। ১৪ মে ভাঙ্গার মুন্নু রাজাকার এই সংবাদ পেয়ে, ১৫ মে আসফরদি গ্রাম আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। আসফরদি গ্রামে আশ্রয়রত হিন্দু পরিবারের সদস্যরা গোপন সোর্সের মাধ্যমে এই সংবাদ পেয়ে যান, তারা ১৪ মে রাতে আসফরদি গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান। ১৫ মে সকালে পাকিস্তানি সেনারা আসফরদি গ্রাম আক্রমণ করে। হিন্দু পরিবারের সদস্যদের না পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা আসফরদি মিয়া বাড়ি আক্রমণ করে ৬ জনকে হত্যা করে এবং গ্রামের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ করে প্রায় ৯ জন গ্রামবাসিকে হত্যা করে। আসফরদি গ্রাম আক্রমণ করে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি সেনারা চর-যশোরদী ইউনিয়নের ধরমদি গ্রামে আক্রমণ করে। ধরমদি গ্রামের ছিহারুন বেগম পাকিস্তানি সেনাদের আসতে দেখে পাট খেতের মধ্যে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা তাকে দেখে ফেলে। ছিহারুন বেগমকে পাকিস্তানি সেনারা ধর্ষণ করে পাটক্ষেতের মধ্যে ফেলে রেখে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে। পাকিস্তানি সেনারা ছিহারুন বেগমের গোপনাঙ্গ ছিড়ে ফেলেছিল।

২৯ মে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামবাসির সহযোগিতায় চাঁদেরহাট নামক স্থানে ২৯ জন পাকিস্তানি সেনা ও একজন রাজাকারকে হত্যা করে। পাকিস্তানি সেনারা এই সংবাদ পেলে ৩০ মে হতে চার দিক হতে পাকিস্তানি বাহিনী নগরকান্দায় আসতে থাকে। ৩১ মে পাকিস্তানি বাহিনী নগরকান্দা ও ভাঙ্গা থানা হতে এসে বাগাট নামক গ্রামে আক্রমণ করে। বাগাট গ্রামের মিনি বেগম পাকিস্তানি সেনাদের আসতে দেখে তাদের ঘরের মাচালের উপরে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী মিনি বেগমের বাবা, ভাই, দাদিকে ধরে গুলি করে হত্যা করে। মিনি বেগম তার পরিবারের সদস্যকে হত্যা করতে দেখে মাচাল থেকে বের হয়ে আসেন। পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে ফেলে। পাকিস্তানি সেনারা একজন রাজাকারের সহযোগিতায় মিনি বেগমে তাদের ঘরের মধ্যে নিয়ে নির্যাতন করে ফেলে রেখে যায়। মুঞ্জুয়ারা বেগম তার নানি সহ তার বাড়ির পাশে গেজুর টুকাতে আসলে তাকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে ফেলে। পাকিস্তানি সেনারা তার নানিকে গুলি করে হত্যা করে রেখে যায়। এবং তাকে নির্যাতন করে ফেলে রেখে যায়।
পাকিস্তানি বাহিনী বাগাট গ্রাম আক্রমণ করে চাঁদেরহাটে গিয়ে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে পাশ^বর্তী এলাকার যে সকল গ্রামবাসি পালিয়ে অন্য স্থানে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন তারা সকলে বাড়ি ফিরে আসেন। রাত ১০ টার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল চর-যশোহরদি ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রামের নারীদের উপর আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারা লাল মতি সহ অনেক নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করে।

১ জুন সকাল আনুমানিক ৯টার সময় পার্শ্ববর্তী এলাকা ভাঙ্গা, ফরিদপুর সদর, মুকসুদপুর হতে পাকিস্তানি সেনারা এসে নগরকান্দার ৯টি গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং তাদের সৈন্যদের লাশ উদ্ধার করার জন্য ঘোড়ামাড়া বিলের কাছে প্রায় ১৫০-২০০ সৈন্য একত্র হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের আসতে দেখে নগরকান্দার আশপাশের আতঙ্কিত গ্রামবাসিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। কোদালিয়া গ্রামের নারী-পুরুষ ও শিশুসহ প্রায় ৪০-৪৫ জন মিয়া বাড়ির পাশের জঙ্গলে (ভেলুর ভিটা) একটি ডোবার মধ্যে আত্মগোপণ করার চেষ্টা করেন। কৌশলগত কারণে আব্দুল আজিজ মোল্লার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আত্মগোপণ করেন। পাকিস্তানি সেনারা গ্রামবাসীর উপস্থিতি টের পেয়ে মিয়া বাড়ির জঙ্গল ঘেরাও করে সেখান হতে নারী ও ৩ বছরের নিচের শিশুকে একটি, ৪-১৫ বছরের শিশুদের একটি এবং পুরুষদের একটি মোট ৩ ভাগে ভাগ করে এবং নারীদের কোদালিয়া মসজিদ মাদ্রাসার মাঠে নিয়ে রাখে এবং পুরুষদের দিয়ে ২৯ তারিখের মৃতদেহ ও লুটরাজ মালামাল মাথায় তুলে দিয়ে নগরকান্দা থানায় পাঠিয়ে দেয়। আর কিছু লোককে মাদ্রাসার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখে।

৪-১৫ বছরের শিশুদের বিলের ওপারে একটি জায়গায় রাখে এবং তাদের বলা হয় তোমাদের মা রান্না করছে, রান্না শেষ হলে তোমাদের যার যার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সকাল ১০টা হতে বিকাল ৩টা পর্যন্ত তাদের বন্দি করে রাখা হয়। নারী ও শিশুদেরকে মাদ্রাসার মাঠে বসিয়ে রেখে নারীদের বলা হয়, তুমরা কোরআন-তসবি পড়ো। নারীদের অনেকেই বলে, আমাদের কোরআন-তসবি বাড়িতে, আমরা গিয়ে নিয়ে আসি। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা বলে, এখন আনতে হবে না, যা আছে তাই পড়ো। সকাল ১০টা হতে বেলা ৪টা পর্যন্ত কোন ধরণের খাবার পানি না দিয়ে তাদের মাঠে প্রখর রোদের মধ্যে বসিয়ে রাখে এবং তাদের উপর নির্যাতন চালায়। শিশুরা পানি খেতে চাইলেও তাদের পানি খেতে দেয়া হয়নি।

বেলা সাড়ে তিনটার সময় হঠাৎ করে পাকিস্তানি সেনারা যে সকল নারীদের বন্ধি করে রেখেছিল তাদের সবাইকে পানি খাওয়াতে থাকে। সবাইকে গোল হয়ে মাদ্রাসার মাঠের এক কোনায় বসানো হয়। তাদের কলমা পড়ায়। তারপর বিকাল আনুমানিক ৪টার সময় মাথা নিচু করে বসিয়ে তিন দিক (উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব দিক) থেকে মেশিনগান সেট করে গুলি বর্ষণ করা হয়। গুলিবর্ষণ শেষে মৃতদেহগুলো মোটা কম্বল দিয়ে ঢেকে রেখে দেয়। পাকিস্তানি সেনাদের এই আক্রমণে ১৬ জন নারী শহিদ হয়। ২ জন নারী প্রানে বেচেঁ যায়।

পাকিস্তানি সেনারা কোদালিয়া গ্রামে অগ্নিসংযোগ করতে দেখে ঈশ্বরদী গ্রামের যে সব জনগণ ছিল তারা পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপণ করার চেষ্টা করে।

ঈশ্বরর্দী গ্রামের একই পরিবারের পাঁচজন পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য জঙ্গল মধ্যে আত্মগোপন করার চেষ্টা করে। পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থান টের পেয়ে গেলে কলম শেখ জঙ্গল হতে পালিয়ে বাশ ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পরে। কিন্তু তার মা, ভাই ও দুই বোনকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে ফেলে। তাদের ধরে এনে এক সাথে গুলি করে এতে তিন শহিদ হন। ফুলমতি আক্তারারে পিছনে মাংস পেসিতে গুলি লেগে মাংস পেসি উরে যায়। তিনি বেঁচে যায়। ৮ বছরের শিশু শ্রীমতি আক্তারের মাথায় গুলি লেগে মাথা উরে যায়। পাকিস্তানি সেনারা তাদের অমানবিক ভাবে হত্যা করে তাদের ঘর বাড়ি জ¦ালিয়ে দেয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল নগরকান্দা ও ভাঙ্গা হতে ছোট পাইককান্দি গ্রামে আক্রমণ করে। গ্রামের যাকে সামনে পাচ্ছিল তাকে গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য নুরজাহান বেগম তাদের গ্রামের পাট ক্ষেতের মধ্যে আত্মগোপণ করার চেষ্টা করেন। পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে ফেলে। পাকিস্তানি সেনারা নুরজাহান বেগমকে সেখানে নির্যাতন করে ফেলে রেখে যায়। নুরজাহান বেগমের মাকে গুলি করে হত্যা করে ফেলে রেখে যায় এবং তার ৮ বছরের মেয়েকে গুলি করে ফেলে রেখে যায়।

১ জুন পাকিস্তানি বাহিনী গোপালগঞ্জ, মুকসুদপুর হতে চর-বল্লবদি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কুমার নদী পার হয়ে চর-বল্লবদি গ্রামে প্রবেশ করে। কুমার নদী পার হওয়ার সময় চর-বল্লবদি গ্রামের ২ জন গ্রামবাসিকে হত্যা করে ফেলে রেখে আসে। চর-বল্লবদি গ্রামে প্রবেশ করে সিদ্দিক মাতুব্বরের বাড়ি পাকিস্তানি সেনারা ঘিরে ফেলে। সিদ্দিক মোল্লাকে পাকিস্তানি সেনারা গ্রেফতার করে। সিদ্দিক মাতুব্বরের স্ত্রী মোনোয়ারা বেগম তার স্বামীকে বাঁচাতে আসলে পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে ফেলে। পাকিস্তানি সেনারা সর্ব প্রথম তার হাতে বারি দিয়ে হাত ভেঙ্গে ফেলে। তার পরে পাকিস্তানি সেনারা মোনোয়ারা বেগমের উপরে ঝাঁপিয়ে পরে। মোনোয়ারা বেগমকে পাকিস্তানি সেনারা নির্যাতন ও ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায়।

নগরকান্দার তালমা ইউনিয়নে রাজাকারের তৎপরতা ছিল অনেক। রাজাকারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই বোনকে পাকিস্তানি সেনাদের মনোরঞ্জন করার জন্য তুলে নিয়ে যায়। তাদের দুই বোনকে প্রায় রাতেই ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যেত, দিনে তাদের বাড়ি দিয়ে যেতেন। দুই বোন অনেক বার পালানোর চেষ্টা করলেও রাজাকারদের কারণে পালিয়ে অন্য কোথাও যেতে পারে নাই।

বর্তমানে নগরকান্দা থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফজলুল হক মাতুব্বর ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই বীরাঙ্গনাদের সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনারা চলে যাওয়ার পরে ছিহারুন বেগম, ফুলমতি বেগম, মিনি বেগম ও মোনোয়ারা বেগমকে তাদের বাড়ি হতে উদ্ধার করে ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করাই। চিকিৎসা শেষে তাদেরকে আমরা নিরাপদ স্থানে রেখে আসি। আমাদের এলাকায় এমন আরো অনেক ধর্ষিত নারী রয়েছে। তাদের ইচ্ছা না থাকার কারনে তাদের নাম আমরা প্রকাশ করতে পারছি না।’

লেখক : কর্মকর্তা, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট