এন্ড্রু কিশোরদের রক্ষা করুন । মন্তব্য প্রতিবেদন

Comments
বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’, ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘আমি চিরকাল প্রেমের কাঙাল’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘পড়ে না চোখের পলক’সহ ১৫ সহস্রাধিক গানের শিল্পী এন্ড্রু কিশোর। চলচ্চিত্রে গান গেয়ে আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন এন্ড্রু কিশোর।
শিল্পী বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। তাঁর কিডনি ও হরমোনজনিত সমস্যা দেখা দেয়। ফলে তাঁর ওজন হ্রাসসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা শুরু হয়। এড্রেনাল গ্লান্ড একটু বড় হয়ে গেছিল। সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় জ্বর। প্রতিদিন তাঁর জ্বর আসছিল কিন্তু চিকিৎসকরা কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এ অবস্থায় স্থানীয় চিকিৎসকদের পরামর্শে উন্নততর চিকিৎসার জন্যে বিদেশে যাওয়ার ব্যয়বহুল বিকল্প ছাড়া আর উপায় ছিল না। 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগিয়ে এলেন। ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, এ রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে চিকিৎসার জন্যে শিল্পীর হাতে প্রধানমন্ত্রী ১০ লাখ টাকা অনুদানের চেকটি তুলে দিলেন। আশার আলোয় বুক বেঁধে পর দিনই (৯ সেপ্টেম্বর) শিল্পী ভর্তি হলেন সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে। শুরু হলো চিকিৎসা।
সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে প্রাথমিক চেকআপের পর জানা গেল তার শরীরের এড্রেনাল গ্লান্ড বড় হওয়ার কারণ এড্রেনাল টিউমার। এই টিউমার থেকেই মূল জটিলতা সৃষ্টি। ক্যানসার টিউমার প্রতিরোধের এন্ড্রু কিশোরকে নিতে হবে ১৮টি কেমোথেরাপি।
চিকিৎসক জানিয়েছেন সপ্তাহে একটি করে কেমো দিতে হবে। ইতোমধ্যে প্রথমটি দেওয়া হয়েছে। বাকি আছে আরও ১৭টি। সব মিলিয়ে টানা তিন থেকে সাড়ে তিন মাস সিঙ্গাপুরে থাকতে হবে এন্ড্রু কিশোরকে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এন্ড্রু কিশোরের লাখো ভক্ত শুভ কামনা জানাচ্ছেন, কামনা করছেন শিল্পীর আরোগ্য লাভের। ধন্যবাদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই কিছু ব্যক্তি মানবিক এই বিষয়টি নিয়ে আক্রমণাত্মক নেতিবাচক প্রচারে নেমে পড়লেন আদাজল খেয়ে। তাদের বক্তব্য ‘উনি স্বছল’, ‘প্রধানমন্ত্রী কেন সহায়তা দিলেন’, ‘লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন সেগুলো চিকিৎসায় লাগান’, ইত্যাদি।
কিন্তু কেন?
একজন ডাক্তার টাকা ছাড়া রুগী দেখেন না, একজন খেলোয়াড় টাকা ছাড়া খেলতে নামেন না, একজন চাকুরীজীবী বেতন ছাড়া চাকরী করেন না। কেননা এটা তাদের পেশা, জীবিকা নির্বাহের উপায়। এই বিনিময় মূল্য নেয়ায় কোন অন্যায় নেই।
একজন শিল্পী ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সাধনা করে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। সাবিনা, রুনা, এন্ড্রু কিশোর, বন্যা, সঞ্জীব, বাপ্পাদের শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে রাষ্ট্রের কোন ভূমিকা কী ছিল? তারা কি শিল্পী হয়েছেন রাষ্ট্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করে? বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক গড়ে তুলতে রাষ্ট্রের তেমন কোন উদ্যোগ থাকে না, সম্ভব হয় না। 
তাই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অর্থায়নে তারা শিল্পী হয়ে ওঠেন। শুধু তাই নয় শিল্পী হয়ে তারা দেশের মুখ উজ্জ্বল করেন দেশে এবং দেশের বাইরে। দেশের চলচ্চিত্র, রেডিও, টেলিভিশনের মত গণমাধ্যমকে রাখেন সুস্থ ও সচল। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দেশে এবং দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় অন্য দেশের সামনে তুলে ধরতে ডাক পড়ে সাবিনা, রুনা, রথীন রায়, খুরশিদ আলম, সুবীর নন্দী, এন্ড্রু কিশোর, বন্যা, সঞ্জীব, বাপ্পাদেরই।
অন্যদিকে অপরাপর পেশায় যারা আছেন, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, আমলা, বেসরকারী চাকুরে, ইত্যাদি … তারা কিন্তু উচ্চ শিক্ষার্থে এই রাষ্ট্রের দেয়া ভর্তুকিতে পাবলিক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসিক ২৫/৩০ টাকা বেতনে লেখাপড়া করে নিজ পেশায় আসীন হয়েছেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করেছে। এসব পেশায় নিয়োজিত বিশেষ করে সরকারী কাজেযুক্তরা পাচ্ছেন বাড়ী, গাড়ী, অবসরভাতাসহ নানা সুবিধা। শুধু কি তাই! যারা জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াও সংসদে বসছেন তারাও এসবের বাইরে পাচ্ছেন ‘ট্যাক্স ফ্রি’ সুবিধা, নিরাপত্তা, এমন কি রাষ্ট্রের অর্থে হজ্বের সুযোগও। 
কিন্তু এই শিল্পীরা কি পাচ্ছেন? এঁদের প্রতি রাষ্ট্রের কি কোন দায়িত্ব নেই? মূলত কিছুই করে না রাষ্ট্র এদের জন্যে। এমন কি এদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক পাইয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, সরকার, সমাজের কোন ভূমিকা নেই।
আপনারা কি জানেন রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ১৫ মিনিট গান গেয়ে এন্ড্রু কিশোররা কত টাকা পান? ১৫’শ থেকে সর্বোচ্চ ১৮’শ টাকা! ক’টি গান গাইবার ব্যবস্থা হয় সারা মাসে? প্রাইভেট চ্যানেলে সারা সপ্তাহে একটি কি দুটি গানের অনুষ্ঠান হয়। দেশের প্রায় অর্ধশত এফএম রেডিও প্রতিদিন কেবলমাত্র এন্ড্রু কিশোরের কতশত গান প্রচার করে, তারা কি এর বিনিময়ে একটি টাকাও রয়ালটি দিয়েছেন এন্ড্রু কিশোরকে কিম্বা সে গানের গীতিকার/সুরকারকে? আর অ্যালবাম?  আজকাল তো সিডি/ডিভিডি-র বাজার শূন্য। যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বড় বড় কথা বলছেন তারা বলবেন কি জীবনে কয়টা সিডি কিনে গান শুনেছেন?
এরপরেও এঁরা কিন্তু যা আয় করেছেন তার জন্যে কর দিয়েছেন রাষ্ট্রকে। এঁরা যা করেন তা দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। দেশে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিনোদনের মূখ্য ভাগ এঁরাই করে যাচ্ছেন নিরবে।
আসুন না এঁদের পাশে দাঁড়াই একবার। সোচ্চার হই এঁদের অধিকার আদায়ে। প্রাপ্য অধিকার পেতে হাতেহাত লাগাই। এঁরা আমাদের জাতীয় সম্পদ। এঁদের জীবন রক্ষায় যতক্ষণ স্বাভাবিক পথ প্রস্তুত না হবে ততক্ষণ রাষ্ট্রকে বিকল্প পথে এদের সহায়তায় দাঁড়াতেই হবে। তা না হলে রাষ্ট্র কি কেবল সুবিধাভোগীর হাতে জিম্মি হয়ে থাকবে?
প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ যে তিনি অন্তত এদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অনুরোধ তাঁর প্রতি এঁদের প্রাপ্য পেতে সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করে ভবিষ্যৎ এন্ড্রু কিশোরদের পাশে এসে দাঁড়ান।
সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন এন্ড্রু কিশোর। আপনার আরোগ্য প্রত্যাবর্তনের শুভ কামনায় প্রতিক্ষায় রয়েছে আপনার অগণিত ভক্ত, সুহৃদ।
লেখক: সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.