কফি আততা আনানের জন্ম এপ্রিল ৮, ১৯৩৮। তিনি ছিলেন ঘানার একজন কূটনীতিবিদ এবং জাতিসংঘের সপ্তম মহাসচিব। খ্রিস্টান ধর্মালম্বী হিসেবে প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায় জনগোষ্ঠীর মুখপাত্র হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। আনান এবং জাতিসংঘ যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার (২০০১) লাভ করেন। তিনি কফি আনান ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া নেলসন ম্যান্ডেলা প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সংগঠন দা এল্ডারস-এর চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।
ঘানার কোমাসি শহরে জন্মগ্রহণ-করা আনান ম্যাকালেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অর্থনীতি’, গ্র্যাজুয়েট ইউনিভার্সিটি জেনেভায় ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ এবং এমআইটিতে ‘ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৬২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জেনেভা কার্যালয়ে কাজ করার মাধ্যমে তিনি জাতিসংঘে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি জাতিসংঘ সচিবালয়ের আরো কিছু পদে কাজ করেছেন, যার মধ্যে আছে মার্চ ১৯৯২ থেকে ডিসেম্বর ১৯৯৬ পর্যন্ত শান্তিরক্ষা বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্বপালন। ১৯৯৬ সালের ১৩রা ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদ তাকে মহাসচিব নিযুক্ত করে, পরে সাধারণ পরিষদেও তা সমর্থিত হয় এবং তিনিই প্রথম জাতিসংঘের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে মহাসচিব হন। ২০০১ সালে তিনি মহাসচিব পদে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন, এবং ২০০৭ সালের ১লা জানুয়ারি বান-কি-মুনের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।
মহাসচিব হিসেবে আনান জাতিসংঘের আমলাতন্ত্র সংস্কার করেন; এইচআইভির প্রতিরোধে কাজ করেন, বিশেষত আফ্রিকায়। নিরাপত্তা পরিষদ সম্প্রসারণ না করায় তিনি সমালোচিত হন এবং জাতিসংঘের তেলের-বিনিময়ে-খাদ্য কর্মসূচী নিয়ে তদন্তের পর তার পদত্যাগের দাবিও ওঠে। জাতিসংঘে কর্মজীবন সমাপ্তির পর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করার উদ্দেশ্যে ২০০৭ সালে তিনি আনান কমিশন গঠন করেন। ২০১২ সালে তিনি চলমান সিরিয়া সংকট সমাধানে জাতিসংঘ-আরব লীগের যৌথ বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন কিন্তু সংকট সমাধানে জাতিসংঘের কাজে কোনো অগ্রগতি না দেখে তিনি অব্যাহতি নেন।
২০১৬-র সেপ্টেম্বরে তাকে মায়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট তদন্তে গঠিত একটি জাতিসংঘ কমিশনের প্রধান নিযুক্ত করা হয়, যা ‘আনান কমিশন’ নামে পরিচিত।
১৯৩৮ সালের ৮ এপ্রিল গোল্ড কোস্টের (বর্তমান ঘানা) কোমাসি শহরে কোফানড্রোস বিভাগে কফি আনান জন্মগ্রহণ করেন। তার যমজ বোন ইফুয়া আততার নামের শেষাংশ আততা তার নামেও রয়েছে, আকান ভাষায় যার অর্থ ‘যমজ’।[১৪] তিনি এবং তার বোন সেদেশের আশান্তি ও ফানতে নামক অভিজাত দুটি গোষ্ঠীতে জন্ম নেন এবং তাদের দাদা ও চাচারা ছিলেন উপজাতীয় গোষ্ঠীপ্রধান। আকানদের সংস্কৃতিতে অনেক ছেলেমেয়ের নাম সপ্তাহের যে দিনে সে জন্মগ্রহণ করেছে সেদিনের সাথে সাযুজ্য রেখে রাখা হয়, এবং তার কতজন বড়ভাই/বোন আছে সেটার হিসাবেও। কফি নামটা তাদের ভাষায় শুক্রবারের সাথে সম্পৃক্ত।
১৯৫৪ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত আনান কেপ কোস্টে এমফ্যানসিপাম নামে একটি অভিজাত মেথডিস্ট আবাসিক স্কুলে পড়ালেখা করেন। তিনি বলেন এই স্কুল তাকে শিখিয়েছিল, কোনো এক স্থানের দুঃখকষ্ট, সংকট সবজায়গার মানুষকেই প্রভাবিত করে। ১৯৫৭ সালে আনান এমফ্যানসিফাম থেকে পাশ করেন এবং সেবছরই গোল্ড কোস্ট যুক্তরাজ্যের অধীনতা থেকে মুক্তি পায় আর দেশের নতুন হয় “ঘানা”।
১৯৫৮ সালে আনান কোমাসি কলেজ অফ সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে অর্থনীতিতে পড়া শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে ফোর্ড ফাউন্ডেশন থেকে তিনি অনুদান পান যার দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় ম্যাকালেস্টার কলেজে তার অর্থনীতিতে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়া শেষ করেন। ১৯৬১-৬২ সময়কালে তিনি জেনেভার দ্য গ্র্যাজুয়েট ইন্সটিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর কয়েক বছর কর্ম অভিজ্ঞতার পর তিনি এমআইটি স্লোন স্কুল অব ম্যানেজমেন্টে স্লোন ফেলোজ প্রোগ্রামে অধ্যয়ন করেন (১৯৭১–৭২) এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৬২ সালে, কফি আনান জাতিসংঘের সহযোগী সংগঠন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাজেট অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি ঘানার পর্যটনের পরিচালক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। ১৯৮০ সালে তাকে জেনেভায় জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রধান নিযুক্ত করা হয়। ১৯৮৩ সালে তিনি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সচিবালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সেবার পরিচালক পদে আসীন হন। ১৯৮০’র দশকের শেষদিকে তিনি জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব হিসেবে পরপর তিনটি পদের দায়িত্ব পান: মানবসম্পদ, ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা সমন্বয়ক (১৯৮৭–১৯৯০); কর্মসূচী পরিকল্পক, বাজেট ও ফিন্যান্স, এবং নিয়ন্ত্রক (১৯৯০–১৯৯২); শান্তিরক্ষা কার্যক্রম (মার্চ ১৯৯৩ – ডিসেম্বর ১৯৯৬)।
১৯৯২ সালে তৎকালীন মহাসচিব বুত্রোস বুত্রোস ঘালি ডিপার্টমেন্ট অফ পিসকিপিং অপারেশনস (ডিপিকেও) চালু করার পর প্রধান হিসেবে আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ম্যারাক গোল্ডিং এবং তার ডেপুটি বা সহকারী হিসেবে আনানকে নিয়োগ দেয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালের মার্চে আনান গোল্ডিংয়ের পদে উন্নীত হন। তার এই শান্তিরক্ষা-প্রধানের পদে থাকার সময়কালেই সোমালিয়ার যুদ্ধ হয় যেখানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন চরমভাবে ব্যর্থ হয় এবং সংঘটিত হয় রুয়ান্ডার গণহত্যা (১৯৯৪)। ১৯৯৫ সালের ২৯শে আগস্ট মহাসচিব বুত্রোস ঘালি যখন উড়োজাহাজে ছিলেন বলে তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না, কফি আনান জাতিসংঘ কর্মচারীদেরকে “বসনিয়ায় বিমানহামলার বিরুদ্ধে তাদের ভেটো দেয়ার ক্ষমতা সীমিত সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে” নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর ফলে ন্যাটো তাদের অপারেশন ডেলিবারেট ফোর্স পরিচালনের সুযোগ পায় এবং আনান যুক্তরাষ্ট্রের সুনজরে আসেন। রিচার্ড হলব্রুকের মতে, আনানের “সাহসী উদ্যোগে” যুক্তরাজ্যে আশ্বস্ত হয় যে বুত্রোস ঘালির পরিবর্তে তিনিই উপযুক্ত লোক হবেন।
১৯৯৬ সালে তৎকালীন মহাসচিব বুট্রোস বুট্রোস ঘালি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বীহীনভাবে নির্বাচনে দাঁড়ান। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে তিনি ১৫টির ১৪টি ভোট পেলেও যুক্তরাষ্ট্র ভেটো প্রদান করে। নিরাপত্তা পরিষদে চারটি ব্যর্থ সভার পর বুট্রোস ঘালি তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন এবং তিনিই এপর্যন্ত একমাত্র মহাসচিব যিনি দ্বিতীয় মেয়াদ পাননি। বদলি প্রার্থীদের মধ্যে আনান ছিলেন সবচেয়ে এগিয়ে, প্রথম রাউন্ডে আমারা এসেকে তিনি এক ভোটে পরাজিত করেন। তবে ফ্রান্স চারবার আনানের বিপক্ষে ভেটো দেয়, যদিও পঞ্চমবারে নিরস্ত হয়। শেষপর্যন্ত ১৯৯৬ সালের ১৩ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদ আনানের পক্ষে সুপারিশ করে। চারদিন পর সাধারণ পরিষদের ভোটে তা নিশ্চিত হয়। ১লা জানুয়ারি ১৯৯৭ তিনি তার প্রথম মেয়াদে মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন।
২৭শে জুন ২০০১ তারিখে নিরাপত্তা পরিষদ আনানকে দ্বিতীয় মেয়াদে সুপারিশ করে এবং সাধারণ পরিষদ ২৯শে জুন তার পুনঃনিয়োগ অনুমোদন করে।
২০০১ সালে নোবেল পুরষ্কারের শতবর্ষে নোবেল কমিটি ঘোষণা দেয় যে সেবছর শান্তি পুরষ্কার জাতিসংঘ এবং কফি আনানকে যৌথভাবে দেয়া হবে। জাতিসংঘকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং মানবাধিকারকে প্রাধান্য দেয়ায় আনানকে এই পুরষ্কার দেয়া হয়। নোবেল কমিটি আফ্রিকায় এইচআইভির বিস্তার রোধে তার অঙ্গীকার এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তার অবস্থানেরও স্বীকৃতি দেয়।
জাতিসংঘের কর্মজীবন শেষে আনান জেনেভায় বসবাস করতে শুরু করেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী উদ্যোগে নেতৃত্ব দেন। ২০০৭ সালে আনান ‘কফি আনান ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই অলাভজনক স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের শাসনব্যবস্থা আরো কল্যাণমূলক করতে এবং সুন্দরতর ও শান্তিপূর্ণ একটি পৃথিবী গড়তে মানুষ ও দেশগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে।
প্রতিষ্ঠানটির মূলনীতিতে আছে, অন্যায়হীন এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ তিনটি স্তম্ভের ওপর নির্ভর করে: শান্তি ও নিরাপত্তা, টেকসই উন্নয়ন, মানবাধিকার ও আইনের শাসন। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য হচ্ছে কার্যকরী নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে এই তিনটি স্তম্ভের বিপরীতে যেসব প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে, যুদ্ধ-সহিংসতা থেকে শুরু করে পাতানো নির্বাচন কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন – এসবকিছুকে প্রতিহত করে সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে এগিয়ে যাওয়া।
রাখাইন কমিশন (মায়ানমার) :
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আনানকে বলা হয় মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সম্পর্কিত উপদেষ্টা কমিশনের নেতৃত্ব দিতে। মায়ানমারের এ অঞ্চলটি দরিদ্র ও অনুন্নত, এবং জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে পীড়িত, যেখানে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধের বিপরীতে রয়েছে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং সরকার ও সেনাবাহিনীও রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে। “আনান কমিশন” নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত এই কমিশনকে মায়ানমারের অনেক বৌদ্ধ রোহিঙ্গাদের সাথে তাদের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ মনে করে এবং বিরোধিতা করে।
২০১৭-র ২৪শে আগস্ট যখন আনান কমিশন তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে, রিপোর্টের সুপারিশগুলোতে উভয় পক্ষই নারাজ হয় এবং ভয়ানকভাবে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে – ঐ অঞ্চলে এ দশকের সবচেয়ে বড় আকারের এবং রক্তাক্ত মানবিক বিপর্যয়ে মায়ানমার থেকে অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা হয়। আনান এর সমাধান করতে জাতিসংঘকে উদ্যোগী করার চেষ্টা করেও বিফল হন।
কফি আনান ১৯৬৫ সালে এক নাইজেরীয় অভিজাত বংশের নারী টিটি আলাকিজাকে বিয়ে করেন। কয়েক বছর পর তাদের মেয়ে আমা এবং পরে ছেলে কোজো জন্মগ্রহণ করে। ১৯৭০’র দশকের শেষদিখে তারা আলাদা থাকতে শুরু করেন এবং ১৯৮৩ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ১৯৮৪ সালে আনান জাতিসংঘের সুয়েডীয় আইনজীবী নেন আনানকে বিয়ে করেন।
১৮ই আগস্ট ২০১৮ তারিখে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে ৮০ বছর বয়সে সামান্য অসুস্থতার পর কফি আনান মৃত্যুবরণ করেন।
১) বাংলা উইকিপিডিয়া
২) “Annan: `Peace is never a perfect achievement’ – United Nations Secretary General Kofi Annan”
৩) “BBC – The Editors: How to say: Kofi Annan”
৪) “Kofi Annan – Biographical”। www.nobelprize.org