।। ইন্দ্রাণী ঘোষ ।।
সেন্ট লুই মিসুরিতে জন্মেছিলেন এক বিরল মনজ্ঞ দার্শনিক কবি। প্রখর বুদ্ধিমত্তা যার কবিতার শেষ কথা। ২৬ সে সেপ্টেম্বর ১৮৮৮ জন্ম গ্রহন করেন টমাস স্তিরান্স এলিয়ট। ১৮৩৪ শালে এলিয়ট পরিবার চলে আসেন সেন্ট লুইসে। এলিয়ট বলেছিলেন তিনি মিসুরি এবং ম্যাসাচুসেটস উভয় দেশ মাতৃকার সন্তান। ম্যাসাচুসেটস এর দীর্ঘ ফার গাছের সারি , সুরেলা চড়াই পাখি, লাল পাথুরে নদীতট , গভীর নীল সমুদ্র তিনি ভুলতে পারেন না যখন সেন্ট লুইসে থাকেন। আবার ভোলেন না সেন্ট লুইসের গভীর সবুজ বনানীকে। তিনি নব্য ইংল্যান্ডের সেন্ট লুইস এবং ম্যাসাচুসেটস উভয়ের সাথেই নাড়ির বন্ধনে আবদ্ধ। টমাসের পিতামহ ‘উলিয়াম গ্রিনলিফ এলিয়ট’ ইউনিটারিয়ান চার্চের একটি বিশিষ্ট পদে থাকার ফলে বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনা এবং অনান্য সেবামূলক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। ফলত ধর্মীয় চেতনা এই ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন কবির অবচেতনে প্রোথিত হয়েছিল অজান্তেই। তাঁর পরম সত্যের খোঁজ চলেছে দেশকাল ধর্মের সীমানা ছাড়িয়ে, কবিতা হতে কবিতা পেরিয়ে, সারা বিশ্বের কবি এবং সৃষ্টিশীল মানুষের মননে মনোজ্ঞ ছায়াপাত করে। উঠে আসে একের পর এক কালজয়ী পাথুরে ভাস্কর্যের মত কবিতা।‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’, ‘প্রুফরক অ্যান্ড আদার অবসারভেশনস’, ‘এশ ওয়েডনেসডে’, ‘ফোর কোয়াত্রেটস’, ‘পোরট্রেট অফ আ লেডি’। আসে বিশ্বাসে টলমল চেতনার প্রতিফলন “ মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল” এক কালজয়ী নাটক। এবং সবশেষে সৃষ্টিশীলতার রসায়ন নিয়ে প্রবন্ধ “ দ্য ট্র্যাডিশন এন্ড ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’, জটিল মনস্তত্ত নিয়ে প্রবন্ধ “ হ্যামলেট অ্যান্ড হিস প্রবলেমস’।
ম্যাসাচুসেটসের মিলটন অ্যাকাডেমি থেকে স্নাতক হওয়ার পর এই প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ কবিটি পাড়ি দেন হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপরই বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা , এবং একের পর এক কালজয়ী কাব্যগ্রন্থের জন্ম । ভাবতে অবাক লাগে যুদ্ধের ভয়াবহতা যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে এই কবির কলমের গভীরতা। এলিয়ট কে খুঁজে পেয়েছিলেন এজরা পাউনড। ‘দ্য লাভ সংগস অফ জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’ যখন পাউনডের হাতে পৌঁছয় , জহুরী পাউনডের ‘টমাস এলিয়ট’ কে চিনে নিতে অসুবিধে হয় নি। ইউরোপ এবং আমেরিকা সাহিত্য আঙিনায় বিখ্যাত জহুরী ক্রিটিক বা সমালোচক পাউনড সাক্ষাৎ কষ্টি পাথর , সোনা চিনে নিতে তাঁর অসুবিধে হত না। ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সারা জাগানো কবিতা সংকলন ‘লাভ সংগস অফ জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’। প্রশংসায় পঞ্চমুখ পাউনড বলেন ‘টমাস নিজেকে আধুনিক শুধু করে নি, নিজেকে কঠোর মানসিক অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেছেন। বেশির ভাগ কবি এ দুটির একটি করে থাকেন। বা কেউ কেউ কোনটাই করেন না”।
‘দ্য সং অফ জে. আলফ্রেড প্রুফ্রক’ – এখানেই দেখা যায় কবির অলটার ইগোকে। “লেট আস গো দেন ইউ এন্ড আই’ কবি ডেকে নেন তাঁর অন্তরের সাথী প্রুফ্রককে। দুজনে ঘুরে বেড়ান পথে পথে। চেতনা ধাক্কা খায় হলুদ কুয়াশা মোড়া লন্ডনের জানলার শার্শিতে। এই নগরীর পথে পথে চিমনির কালির বিষণ্ণতা মাখানো। যেখানে মানুষ মুখোশ পরে আরও কিছু মুখোশে মোড়া মুখের সম্মুখীন হতে। ‘টু প্রেপেয়ার আ ফেস ফোর দ্য ফেসেস আই মিট’। এক উর্বরতা রোহিত কক্ষ থেকে বেড়িয়ে আসে কিছু মহিলা, উর্বর ভাস্কর মাইকেলএঞ্জেলোর ভাস্কর্যের আলোচনা করতে করতে। ‘উমেন কাম এন্ড গো টকিং অফ মাইকেল এঞ্জেলো’। এ ভাবেই ঘোরে তাঁরা মহানগরীর পথে পথে। এই বিষণ্ণ লন্ডন নগরীতে মানুষ নিজেদের জীবন মাপছেন কফির চামচের খুদ্র পরিসরে। ‘ আই হ্যাভ মেসারড আউট মাই লাইফ ইন কফি স্পুন্স’। শেষ ছত্রে কবি বলেন ‘টিল হিউমান ভয়সেস অয়েক আস , এন্ড উই ড্রাউন’। অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন এই কবি। এনেছিলেন নতুন জোয়ার প্রতীকে, চিত্রকল্পে, শব্দে, রঙের ব্যবহারের দুনিয়াতে। এই বিশ্ব এক বিশাল ‘ওয়েস্টল্যানড’। যে বিশ্ব যুদ্ধে জর্জরিত, চিন্তায় অক্ষম, কর্ষণে, মানসিক পরিশ্রমে অপারগ। এক বিশাল বন্ধ্যা জমি এই সমাজ এবং সমাজে বসবাসকারী মানুষ। এই ছিল কবির কবিতার অনবদ্য যুগান্তকারী ছবি।
এলিয়ট বলেন তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘ট্র্যাডিশন এন্ড ইনডীভিজুয়াল ট্যালেন্ট’ এ,
‘পোয়েট্রি ইস নট এ টারনিং লুস অফ ইমোসন। বাট ইট ইস অ্যান এস্কেপ ফ্রম ইমোশন। পোয়েট্রি ইস নট অ্যান এক্সপ্রেশন অফ পার্সোনালিটি , বাট অ্যান এস্কেপ ফ্রম পার্সোনালিটি। দোস হু হ্যাভ পারসোনালিটি অ্যান্ড ইমোশন নোস , হোয়াট ইট মিন্স টু ট্রাই টু এস্কেপ ফ্রম দিস থিংস’।
অর্থাৎ কবিতা শুধু আবেগের প্রকাশ নয়। কবিতা বুদ্ধি এবং মেধার মোড়কে মোড়া এক উন্নতমানের সৃষ্টি। আবেগ এবং যা কিছু ব্যক্তিগত তাঁকে প্রকাশ সেই ব্যক্তিই করেন না, যিনি এ দুটির মুল্য জানেন। রোম্যান্টিক কবিদের স্টাইলে চরম আঘাত হানলেন এই কবি। শুরু হল বিংশ শতাব্দীর কবিতার জগতে নতুন ধারা, কবিতা রচনার। কবি কে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন ফরাসী কবি মালারমে, বোঁদলেয়ার, লাফারজ, প্রভৃতি কবিরা। এরপরই আসে এলিয়টের বিশ্ববিখ্যাত ‘প্লাটিনাম রড’ অণুঘটকের কথায়। বিজ্ঞানীর চোখ দিয়ে কবি বুঝিয়ে দেন নতুন সৃষ্টির রসায়ন। পূর্বসূরিদের প্রভাব বর্তমান কবিতায় থাকাই স্বাভাবিক। তবে সেখান থেকে সরে এসে নতুন কালজয়ী রচনাই আসল মোক্ষ। পূর্বসূরিদের রচনা এবং অনুভুতিপ্রবণ কবির মন কাজ করবে সেই প্ল্যাটিনাম রডের মত যা কিনা দুটি গ্যাসের মধ্যে থাকলে সালফুরিক এসিড তৈরি করতে অণুঘটকের কাজ করে থাকে। অর্থাৎ কবি মন প্লাটিনাম রডের মত, তা মাধ্যমের কাজ করবে কিন্তু নিজের কথা সরাসরি বলবে না। এখানেই আসে কবি মনের ‘নৈবৃক্তিকতার’ প্রশ্ন। যা কিছু ব্যাক্তিগত তাঁর থেকে রসদ নিয়ে তৈরি হবে এমন সৃষ্টি যা চিরন্তন এবং শুধুই ব্যাক্তিগত পরিসরে আবদ্ধ নয়।
রবীন্দ্রনাথ কিন্তু প্রথমে তীব্র নিন্দা করেন এলিয়টের কবিতার তাঁর ‘আনট হেলেন’ এবং ‘প্রিলিউড’ কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে। পরবর্তী কালে কবি বিষ্ণু দে কবির ‘দ্য জার্নি অফ ম্যাজাই’ অনুবাদ করেন এবং এলিয়টের নাম গোপন করে রবীন্দ্রনাথকে দেখান ছন্দের সংশোধনের জন্য।এবার রবীন্দ্রনাথ যারপরনাই মুগ্ধ হন। তখন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আসল কবির পরিচয় রবীন্দ্রনাথকে জানান। রবীন্দ্রনাথ নিজের কথা ফিরিয়ে নেন এবং ‘তীর্থযাত্রী’ নাম দিয়ে কবিতাটি অনুবাদ করেন।পরবর্তীকালে কবি বিষ্ণু দে এই কবিতাটির আরও পরিণত অনুবাদ করেন এবং নাম দেন ‘রাজর্ষিদের যাত্রা’। রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেন এলিয়টের ছন্দ, প্রতীক, চিত্রকল্প, বাগধারার,ব্যবহার যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবক্ষয় আক্রান্ত সমাজ ও পৃথিবীর চিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর এলিয়টের উপর গবেষণা পত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইন্সটিটিউট হলে’ পাঠ করেন। পরে তাঁর এই গবেষণাপত্রটি ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সনে। এখানে সুধীন্দ্রনাথ বিখ্যাত প্রাক আধুনিক কবিদের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেন এবং বলেন যে আধুনিক কবি এলিয়টের ছন্দের ব্যবহার ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ কবিতায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ। সমাজ যখন ক্ষয়িষ্ণু এবং রোগাক্রান্ত সেই পৃথিবীর এবং সমাজের কবিতার ছন্দ হবে গদ্যের মত, সেটাই স্বাভাবিক। ‘ঐতিহ্য ও টি. এস. এলিয়ট’ রচনায় তিনি অবশ্য এলিয়টের লেখনীর ভূয়সী প্রশংসা করলেও এলিয়টের অতিরিক্ত ক্রিশ্চান ধর্মে বিশ্বাসের সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে এলিয়টের অতিরিক্ত খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাস কবিতার নান্দনিক দিকটির উপর যে প্রভাব ফেলেছে তা কাঙ্খিত নয়। কবি বিষ্ণু দে চির এলিয়ট অনুরাগী। যদিও তিনিও এলিয়টের অতিরিক্ত খ্রিস্টধর্ম অনুরাগ নিয়ে একটু বিচলিত ছিলেন , তৎসত্ত্বেও তিনি এলিয়টের কালজয়ী অনুবাদ করেন। ‘অ্যাশ ওয়েডনেসডে’ কে বলেন ‘চড়কের গান’, ‘ভার্জিন’ হলেন ‘দেবকীমাতা’, ‘ইটারনাল দোলর’ হল ‘ চিরন্তন মথুর’, ‘এক্সাইল’ হল ‘ দ্বারকায় নির্বাসন পালা’। ১৯৫৫ সনে জীবনানন্দের প্রবন্ধ সঙ্কলনে বারবার ফিরে আসে এলিয়টের প্রসঙ্গ।
পরিশেষে বলা যেতে পারে এই মনোজ্ঞ, দার্শনিক কবি তাঁর প্রভাব বিস্তার করেছেন দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীর কবিদের বৌদ্ধিক জগতে,আবেগকে অতিক্রম করে। আবেগ আধুনিক যুগের কবিতায় যে অনুঘটকের কাজ করতে পারে তা দেখিয়েছিলেন এই পণ্ডিতমনস্ক কবি। কবিতা যে জটিল এবং কঠোর কর্ষণযোগ্য হতে পারে তারই দীক্ষা সারা বিশ্বের সাহিত্যকে দিয়েছিলেন এই কবি। সাহিত্যকে বাঁধা যায় না দেশকালের সীমায়, তাই বাংলা সাহিত্য দু হাত বাড়িয়ে গ্রহন করেছে এই কবির পাণ্ডিত্য।
লেখক পরিচিতি:
ইন্দ্রাণী ঘোষ। জন্ম মহারাষ্ট্রের পুনা শহরে। পড়াশুনা দশম শ্রেণী অবধি দক্ষিণ কলকাতার নব নালন্দা ও দ্বাদশ, একাদশ শ্রেণী ডায়সেশন স্কুলে। পরবর্তী কালে স্নাতকত্তর ডিগ্রী লাভ বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন থেকে। স্বামীর চাকরি সুত্রে বেশ কিছুদিন কলকাতার বাইরে এবং দেশের বাইরে বসবাস।একটি কন্যা সন্তানের জননী। বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতায় স্থিত এবং একটি বেসরকারি স্কুলে কর্মরত। পিতা অধ্যাপক ছিলেন।