কালপর্বের আখ্যানে স্বরূপ সন্ধান
পায়া ভাঙা চৌকির ভারসাম্যের ইটের ফাঁকে
ঝাঁঝালো অক্ষরে লেখা সেই আখ্যানের
নড়বড়ে জীবনটা তোষকহীন চাদরে ঢেকে
লুকোচুরির সেই প্রাণান্ত সংগ্রাম এখনো
থরে থরে সামনে এসে আচম্বিতে দাঁড়িয়ে যায়।
শিক ভাঙা জানালায় বাতাস প্রবেশের অধিকার
অভাবী চোরকে স্বাগত জানানোর সামিল বিধায়
ঘটি কম্বলের সামান্য হিসেবের সঞ্চয়কারীর
লবনাক্ত স্বপ্নকে পিঠ মুড়ে বেঁধে রাখার মতো করে
ঘামের প্রস্রবণকে মেনে নেয়া দীর্ঘ রাতও জেগে ওঠে।
মাথার উপরে ছাদের পলেস্তরার চাকাগুলোর
অদ্ভুত এক পক্ষপাত বারবার আশ্চর্য আচ্ছন্নতায়
মাথা বা শরীরকে বাঁচিয়ে এক বা দুই ইঞ্চি দূরত্বে
ঝপাত করে প্রায়ই মেঝে বা বিছানায় আছড়ে পড়লে
বেরিয়ে আসা রডগুলো দাঁত খিচিয়ে রসিকতা করতো।
ভাঙা আয়নার ঘোলাটে পারায় প্রতিবিম্বের মুখটা
অচিন কোনো নৃগোষ্ঠীর অচেনা চেহারায় নিজেকে
হারিয়ে ফেলেছিলাম জাতিত্বের বিশিষ্টতার
পূর্বপুরুষের পরম্পরাগত মায়াবী মায়া আর
বিশ্বাসের বলিষ্ঠ প্রেমের শ্যামল মুখচ্ছবি।
তারপর বদলেছে দিন, জীবনের সূচক
স্যাটেলাইটের আগ্রাসনে আমিও বিশ্ববাসী এক
ঘুম কিনি, সুখ কিনি, দুঃখও কিনি বিলাস বিতানে
সাম্রাজ্যবাদ ব্যবসা করে মহামারীর প্রাণের দামে
লোভের মহোৎসব ছড়িয়ে আছে পূঁজির ক্ষমতায়।
এখন বিলাসী পথের আইল্যান্ড জুড়ে সংগ্রামের বিপণন
পিঠমুড়ে বেঁধে রেখেছি সরল চেতনার বিশ্বাসী দু’হাত
আশ্চর্য আচ্ছন্নতায় অধর্মের অন্ধকার সিঁড়ি পেরিয়ে
ঘামের প্রস্রবণের নদীকূলে ভাঙনের বাঁক প্রতিবাঁকে
খুঁজে ফিরছি জাতিত্ব প্রমাণের ডিএনএ গবেষণার।

প্রণয় পুরাণ
আমাদের দুটো চায়ের কাপ
কালো এবং সাদা
কালো যদি কৃষ্ণ হয়
সাদা প্রেমের রাধা।
রাধার কাপে কৃষ্ণের ঠোঁট
কৃষ্ণের ঠোঁট রাধায়
আমাদের ঠোঁট এমনি করেই
ভুল করে না ধাঁধায়।
গল্পে গল্পে যখন ফুরায়
পূর্ণ কাপের চা
পুন্যঠোঁটে ডুবে থেকে
কৃষ্ণ-রাধের বাঁচা।
বাঁচতে বাঁচতে কৃষ্ণ রাধা
দূর পাহাড়ি নদী
শ্রাবণ মেঘের আর্দ্রভেলা
বৃষ্টি নিরবধি।
আকাশ নীলের শরৎ রঙে
গাঙচিলেদের ডানায়
প্রেম জোয়ারে কৃষ্ণ রাধা
ভরছে কানায় কানায়।
রাধা কৃষ্ণ, কৃষ্ণ রাধা
প্রেমের অরুন্ধতী
জীবন সুখের গল্পকথা
সুরের অনুভূতি।
মন যমুনার বৃন্দাবনে
প্রেমের আবাসন
আমি কৃষ্ণ সে যে রাধা
সুরের আলাপন।
রাধার কাপে কৃষ্ণের ঠোঁট
কৃষ্ণের ঠোঁট রাধায়
এক পৃথিবী রঙের আলো
মিলনকাব্য সাজায়।

নিজের মধ্যে
আমি নাহয় আমার কাছেই যাই
সবই আপন, সব হবে পর, নিজ ছাড়া কেউ নাই।
নিজের মধ্য অসীম তুমি নিরাকারে থাকো
নিরাকারের সাথেই তোমার প্রেমটা হলো নাকো
প্রেমিক আমি প্রেম নাহি পাই ডুবি মরা নদে
প্রেম ঢেউ যে অনন্ত তা বাক্য এবং পদে
সপ্তপদে জীবন ঘেরা একান্ততা পিছে
একাগ্র মন বাঁধা আনে জগত হলে মিছে।
জগত জুড়ে রিপুর খেলা ছড়িয়ে দিল কে যে
রঙের কাছেই হার মানালো নিরাকারের সে যে!
আমি নাহয় নিজের কাছে যাই
নিজের মাঝে ডুবে মরে যা কিছু হোক পাই।

চঞ্চল ইঁদুর
একা একা। দুর্বোধ্য রাত। মৃতপুরী সিঙ্কহোল।
মৃত্যুর মতো নিথর রাত। স্বপ্ন নয়, জাগ্রত নয়।
চঞ্চল ইঁদুর। কুট-কুটুস হৃদমাত্রা।
ক্ষুধার্তের হাহাকার। চাবুকের শপাং শপাং।
বেদনাহত শুশ্রূষাহীন। লাশকাটা কোনো ঘর।
কালো কালো অসংখ্য বিড়াল।
অশরীরী রেডিয়াম চোখ।
জোহা হল। নারীর তীব্র চিৎকার!
টর্চার সেল! আলোহীন বদ্ধঘর।
গোঙানি কাতরানো। কালাপানি স্বরে ভাসা।
সারমেয় কু-কান্না। অতৃপ্ত নিঃশ্বাস।
শ্মশানের বাতাস। দানবীয় শিস। পোড়া গন্ধ।
একা। একা রাত। ঘুমহীন, বীভৎস—অপেক্ষা।

তারপর!
আমি অপেক্ষা করতে করতে ঘুমোতে গেলাম
তুমি এসে জাগিয়ে দিতে পারো অথবা
ঘুমের মধ্যে এসে দেখা দিও।
সকালে আধো-জাগা মাতালের মতো হাতটা
পাশে তোমার অস্তিত্ব খুঁজতে থাকবে
তুমি তখন অন্য কোনো রান্নাঘরে লুচি ভাজছো।
আমি আবারও অপেক্ষা করবো,
কখন তোমাকে জানাবো ঘুমের মধ্যে
তুমি কেমন করে আমার কাছে এসেছিলে!
তুমি শুনতে চাইবে তার সবটুকু—
আমি গড়গড় করে বলে যাবো আদরের সব কথা
তুমি বলবে—’তারপর?’
আমি বলবো—তারপর ঘুমটা ভেঙে গেলো!
তখন দু’জনের আনন্দে হঠাৎই
নেমে আসবে হেমন্তের শূন্যতার চিরবিষাদ।
আমরা ফের ঘুমের মধ্যে আলিঙ্গনাবদ্ধ হবো,
গল্প শেষে আবারও জানতে চাইবে, ‘তারপর!’
আমরা জানি, তারপর আবার একই গল্পের অপেক্ষা…

লেখক:
কামরুল বাহার আরিফ, কবি ও সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদক