বাংলা লোকসঙ্গীতের প্রাণ পুরুষ, মরমী শিল্পী আব্দুল আলীম। বাংলাদেশের লোক সঙ্গীতের উৎকর্ষ সাধনে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।
বর্হিবিশ্বে বাংলা গান বিশেষ করে লোকগানকে তিনি পরিচিত করেছেন তার অসাধারণ কণ্ঠ মাধুর্যে। বাংলা গানের প্রবাদপ্রতীম এই শিল্পী রয়েছেন তাঁর অজস্র ভক্তের গহীন অন্তরে। কিন্তু তাও ক্রমম্রিয়মাণ। অবহেলা আর চর্চার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তাঁর অসাধারণ গানের ভান্ডার। তাঁর পুত্রকন্যা ছাড়া আর কাউকে সেভাবে তাঁর গান গাইতে দেখা যায় না। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই হতে পারে তাঁর সঙ্গীত ভান্ডারকে সংরক্ষণের একমাত্র উপায়।
প্রতিভাধর এই শিল্পী ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শেখ মো. ইউসুফ আলী। শিল্পীর বয়স যখন ১০/১১ বছর তখন তাঁর এক সম্পর্কিত চাচা গ্রামের বাড়ীতে কলের গান (গ্রামোফোন) নিয়ে আসেন। তিনি তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ বরকত তাঁর সহপাঠী। প্রায় প্রতিদিনই তিনি চাচার বাড়ীতে গিয়ে গান শুনতেন। পড়াশোনার জন্য গ্রামের স্কুল তাঁকে বেশী দিন ধরে রাখতে পারেনি। তাই কিশোর বয়সেই শুরু করলেন সঙ্গীতচর্চা। আবদুল আলীমের নিজ গ্রামেরই সঙ্গীত শিক্ষক সৈয়দ গোলাম ওলীর কাছে তালিম নিতে শুরু করেন। ওস্তাদ তাঁর ধারণ ক্ষমতা নিরীক্ষা করে খুবই আশান্বিত হলেন। গ্রামের লোক আবদুল আলীমের গান শুনে মুগ্ধ হতো। পালা-পার্বনে তাঁর ডাক পড়তো। আবদুল আলীম গান গেয়ে আসর মাতিয়ে তুলতেন। সৈয়দ গোলাম ওলী আবদুল আলীমকে কোলকাতায় নিয়ে গেলেন। কিছুদিন কলকাতা থাকার পর তাঁর মন ছুটলো ছায়াঘন পল্লীগ্রাম তালিবপুরে। কিন্তু ওখানে গান শেখার সুযোগ কোথায়? তাই বড় ভাই শেখ হাবিব আলী একরকম ধরে বেঁধেই আবার কলকাতা নিয়ে গেলেন।
১৯৪২ সালে যখন উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছে সে সময়ে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এলেন এক অনুষ্ঠানে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। আলীমের বড় ভাই শেখ হাবিব আলী আব্দুল ছোট ভাইকে নিয়ে গেলেন সেই অনুষ্ঠানে। বড় ভাই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের কাছে আলিমের নাম দিলেন গায়ক হিসেবে। এক সময় মঞ্চ থেকে আবদুল আলীমের নাম ঘোষণা করা হলো। ইতস্তত শিল্পী মঞ্চে এসে গাইলেন, ‘সদা মন চাহে মদিনা যাবো’। মঞ্চে বসে আবদুল আলীমের গান শুনে শেরে বাংলা শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন। কিশোর আলীমকে জড়িয়ে নিলেন বুকে। উৎসাহ দিলেন এবং তখনই বাজারে গিয়ে পাজামা, পাঞ্জাবী, জুতা, পুটি, মোজা কিনে দিলেন।
এরপর একদিন গীতিকার মো. সুলতান কলকাতায় মেগাফোন কোম্পানীতে নিয়ে গেলেন আবদুল আলীমকে। সেখানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল। কবি নজরুল শিল্পীর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে রেকর্ড কোম্পানীর ট্রেনার ধীরেন দাসকে আবদুল আলীমের গান রেকর্ড করার নির্দেশ দিলেন। ১৯৪৩ সালে মো. সুলতান রচিত দু’টি ইসলামী গান আবদুল আলীম রেকর্ড করলেন। গান দু’টি হলো- ‘আফতাব ঐ বসলো পাটে আঁধার এলো ছেয়ে ও চল ফিরে চল মা হালিমা আছেরে পথ চেয়ে।’ এবং ‘তোর মোস্তফাকে দেনা মাগো, সঙ্গে লয়ে যাই, মোদের সাথে মেষ চারণে ময়দানে ভয় নাই’। মাত্র তেরো বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে তাঁর গানের প্রথম রেকর্ড বের হল।
এতো অল্প বয়সে গান রেকর্ড হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তা আর বিস্ময় হয়ে থাকেনি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার লোক সঙ্গীতের এক অবিসংবাদিত কিংবদন্তি পুরুষ। বাংলা লোক সঙ্গীতের এই অমর শিল্পী লোক সঙ্গীতকে অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যেখানে জীবন, জগৎ এবং ভাববাদী চিন্তা একাকার হয়ে গিয়েছিল।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের একমাস পূর্বে আবদুল আলীম কলকাতা ছেড়ে গ্রামের বাড়ীতে চলে এলেন। ঐ বছরেই ডিসেম্বর মাসে ঢাকা এলেন। পরের বছর ঢাকা বেতারে অডিশন দিলেন। অডিশনে পাশ করলেন। ১৯৪৮ সালের আগষ্ট মাসের ৯ তারিখে তিনি বেতারে প্রথম গাইলেন, ‘ও মুর্শিদ পথ দেখাইয়া দাও’। গানটির গীতিকার ও সুরকার ছিলেন মমতাজ আলী খান।
এরপর পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের সাথে আবদুল আলীমের পরিচয় হয়। কবি জসীমউদ্দিন তাঁকে পাঠালেন জিন্দাবাহার ২য় লেনের ৪১ নম্বর বাড়ীতে। একসময় দেশের বরেণ্য সঙ্গীত গুণী শিল্পীরা এখানে থাকতেন। এখানে তিনি প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ মমতাজ আলী খানের কাছে তালিম গ্রহণ করেন। মমতাজ আলী খান আবদুল আলীমকে পল্লী গানের জগতে নিয়ে এলেন। পরবর্তীতে তিনি কানাই শীলের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন। এদেশের পল্লীগান হলো মাটির গান। পল্লীর কাদা মাটির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা শিল্পী আবদুল আলীম মাটির গানকেই শেষ পর্যন্ত বেছে নিলেন। এর আগে তিনি ইসলামী গানসহ প্রায় সব ধরনের গান গাইতেন। গান শেখার ক্ষেত্রে আর যাঁরা তাঁকে সব সময় সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়েছেন- তাঁদের মধ্যে বেদার উদ্দিন আহমেদ, আবদুল লতিফ, শমশের আলী, হাসান আলী খান, মোঃ ওসমান খান, আবদুল হালিম চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লোকসঙ্গীতের অমর কণ্ঠশিল্পী মরহুম আব্বাস উদ্দিনের পরামর্শক্রমে তিনি ওস্তাদ মো. হোসেন খসরুর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম গ্রহণ করেন।
১৯৫১-৫৩ সালে আবদুল আলীম কলকাতায় বঙ্গীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলনে গান গেয়ে বিদেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। এ সময় পল্লী গানের জগতে শিল্পীর সুখ্যাতি শীর্ষচূড়ায়।
তিনি ১৯৬২ সালে বার্মায় অনুষ্ঠিত সঙ্গীত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। বার্মায় তখন অনেকদিন যাবৎ ভীষণ খরা চলছে। গরমে মানুষের প্রাণ বড়ই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আকাশে খন্ড খন্ড মেঘের আনাগোনা। শিল্পী অন্যান্যদের সাথে মঞ্চে উঠলেন গান গাইতে। গান ধরলেন- ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে।’ কাকতালীয়ভাবে গান শেষ হতেই মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। অনুষ্ঠানে বার্মার জনৈক মন্ত্রী বললেন, ‘আবদুল আলীম আমাদের জন্য বৃষ্টি সাথে করে এনেছেন’। তখন থেকেই শিল্পী বার্মার জনগণের নয়ন মণি হয়ে আছেন।
সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে তিনি ১৯৬৩ সালে রাশিয়া এবং ১৯৬৬ সালে চীন সফর করেন। এই দুটি দেশে তিনি পল্লীগান পরিবেশন করে দেশের জন্য প্রচুর সুখ্যাতি অর্জন করেন। বিদেশে বাংলাদেশের পল্লীগানের মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আবদুল আলীমের অবদান অনস্বীকার্য।
টেলিভিশন সেন্টার চালু হলে তিনি টেলিভিশনে সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এ কণ্ঠ দেন। এছাড়া ‘আজান’, ‘রূপবান’, ‘জোয়ার এলো’, ‘শীত বিকেল’, ‘এদেশ তোমার আমার’, ‘কাগজের নৌকা’, নবাব সিরাউদ্দৌলা’ (বাংলা ও উর্দু), ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘দস্যুরাণী’, ‘সুজন সখি’ প্রভৃতি অসংখ্য ছবিতে কণ্ঠ দেন।
১৯৬০ সালে ঢাকায় গ্রামোফোন কোম্পানী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁর প্রথম গান ‘প্রেমের মরা জলে ডুবে না’ ও ‘অসময় বাঁশী বাজায়’ এবং পরবর্তীতে ‘হলুদিয়া পাখী’, ‘দুয়রে আইসাছে পাল্কি’, ‘নাইয়ারে নায়ে বাদাম তুইলা’, ‘এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া’, ‘পরের জাগা পরের জমিন’ প্রভৃতি গান অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে।
তিনি দেশের প্রথিতযশা গীতিকার ও সুরকারদের গান গেয়েছেন, তাদের মধ্যে লালনশাহ, হাসন রাজা, জসীমউদ্দিন, আবদুল লতিফ, মমতাজ আলী খান, শমশের আলী, সিরাজুল ইসলাম, কানাইশীল, মন মোহন দত্ত প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
তাঁর প্রায় ৫০০ গান রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া বেতারে স্টুডিও রেকর্ডে ও প্রচুর গান আছে। বাংলাদেশ গ্রামোফোন কোম্পানী (ঢাকা রেকর্ড) শিল্পীর একখানা লংপ্লে রেকর্ড বের করেছে। তাঁর অবিস্মরণীয় জনপ্রিয় গানগুলোর কয়েকটি হল-
‘যার আপন খবর আপনার হয় না’
‘নাইয়া রে নায়ের বাদাম তুইলা’
‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’
‘হলুদিয়া পাখী সোনার বরণ’
‘মেঘনার কুলে ঘর বাঁধিলাম’
‘এই যে দুনিয়া, কিসের লাগিয়া’
‘পরের জায়গা পরের জমি’
‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না’
‘দোল দোল দুলনি’
‘দুয়ারে আইসাছে পালকি নায়ওরি গাও তোল’
‘কেনবা তারে সঁপে দিলাম দেহ মন প্রাণ’
‘মনে বড় আশা ছিল যাবো মদীনায়’
‘কেহ করে বেচা কেনা কেহ কান্দে’
‘সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা’
‘পাখিটি ছাড়িল কে’
‘আল্লাহ মেঘ দে, আল্লাহ পানি দে’
তিনি পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে বেশ কিছুদিন চাকুরীও করেন। আবদুল আলীম ঢাকায় পন্ডিত বারীণ মজুমদার প্রতিষ্ঠিত “সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়”-র লোকগীতি বিভাগের শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি অনেক ছাত্র/ছাত্রী রেখে গেছেন, তাঁদের মধ্যে মো. আবদুল হাশেম (অধ্যাপক, বেতার, টিভি শিল্পী বাংলা বিভাগ, কবীর হাট কলেজ), ইন্দ্রমোহন রাজবংশী (বেতার, টেলিভিশনের কণ্ঠশিল্পী), আবদুল করিম খান (বেতার ও টেলিভিশনের কন্ঠ শিল্পী), মোশতাক তালুকদার ( বেতার ও টেলিভিশনের কন্ঠ শিল্পী), শহীদুজ্জামান ও রুকশানা হক উল্লেখযোগ্য।
তাঁর ৪ মেয়ে ও ৩ ছেলে। তাঁরা হলেন- আকতার জাবান আলীম, জহির আলীম, আসিয়া আলীম, আজগর আলীম, হায়দার আলীম, নূরজাহান আলীম ও জোহরা আলীম।
সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আব্দুল আলীম বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন; এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার। পাকিস্তান মিউজিক কনফারেন্স, লাহোরে সঙ্গীত পরিবেশন করে আব্দুল আলীম পাঁচটি স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে সম্মানিত করে।
১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: gunijan.org.bd
বাঙালীয়ানা/এসএল