(১)
রাসেল পারভেজের সাথে কখনো সামনাসামনি সাক্ষাৎ হয়নি। ওদের চারজনের কারো সাথেই আমার সাক্ষাৎ হয়নি- চারজনই আমার কাছে ভার্চুয়াল জগতের লোক ছিলেন সবসময়। কারা এই চারজন? রাসেল পারভেজ, সুব্রত অধিকারী শুভ, আসিফ মহিউদ্দিন আর মশিউর রহমান বিপ্লব। চারজনের কথা আসছে কেন? কারণ এই চারজন একসাথে কথা বলার জন্যে বন্দী হয়েছিলেন ২০১৩ সনে। হেফাজতে ইসলাম ও ওদের সহচরদের দেওয়া তালিকা ধরে সরকার এই চারজনকে গ্রেফতার করেছিল। ওদের অপরাধ ছিল ওরা স্বাধীনভাবে নিজেদের মত প্রকাশ করছিল। লিখছিল অনলাইন গণমাধ্যমগুলিতে- ব্লগে।
ওদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায়। সেই মামলায় রাসেল পারভেজ দেড় মাসের মতো জেলে ছিলেন। সুব্রত শুভ আর রাসেল পারভেজ জামিন পেয়ে যান দেড় মাসের মাথায়। আসিফ আর বিপ্লব ছাড়া পান আরও কিছুদিন পর। ওদের জেলে যাওয়ার কয়েক বছর পর এই অধমের নামেও ঐ একই ধারায় এক পিস মামলা হয়। আপনাদের হয়তো মানে আছে, ২০১৯ সনে এসে সেই মামলায় আমারও একবার জেলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেই সূত্রে একটা নৈকট্য তো আছেই ওদের সাথে আমার।
দুই হাতে লিখতেন রাসেল পারভেজ- বাংলা ব্লগের দুনিয়ায় খুবই পরিচিত এবং জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। কোন বই বের করেছেন কিনা জানিনা, কিন্তু ওঁর ব্লগগুলি নিয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করলে চমৎকার কিছু বই হবে বলে আমার ধারনা। কি নিয়ে লিখতেন তিনি? সেসময়ে ব্লগের যেসব জনপ্রিয় ও উত্তপ্ত বিষয় ছিল, ধর্মবিশ্বাস, নাস্তিকতা, বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, লিবার্টি- সব বিষয়েই লিখেছেন তিনি। মেধাবী লেখক ছিলেন, তীক্ষ্ণ যুক্তি তর্ক তো থাকতোই, সেই সাথে চমৎকার মানবিক আবেগ যুক্ত করতে পারতেন তিনি যেটা রাসেলকে ওঁর অন্য বন্ধুদের চেয়ে আলাদা করতো।
চমৎকার এই লেখকটি আজ (১৯/০২/২০২০) দুপুরে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ঢাকার একটি হাসপাতালে। ২০১৩ সনের সেই মামলার পর ওদের জন্যে দেশে থাকাটাই কঠিন ছিল। রাসেল পারভেজও দেশত্যাগ করেছিলেন। বিদেশে পড়াশুনা করতেন। যতদূর জানি পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। শেষদিকে জাপানে পিএইচডির জন্যে কাজ করছিলেন। ঢাকায় কেন এসেছিলেন কবে এসেছিলেন জানি না। অসুস্থ ছিলেন। আমার ধারনা ছিল যে তিনি জাপানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। আজকে জানলাম যে শেষনিঃশ্বাসটা তিনি দেশের মাটিতেই নিয়েছিলেন।
রাসেলের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছি। ওঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর ভাষা আমার নেই। ওঁর ঘনিষ্ঠদের স্মৃতিচারণ থেকে জেনেছি ওঁর সন্তানদের নিয়ে রাসেল পারভেজের অনুভূতির কথা। সেই সন্তানদেরকে আপনি কি করে সান্ত্বনা জানাবেন? কিন্তু রাসেলের মৃত্যু নিয়ে শুধু শোক করাটাই তো খুব গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ নয় আরকি। এই যে রাসেল এবং সেই সময়ে ব্লগারদের উপর নির্যাতন আর পরবর্তীতে আরও অন্যান্য সব লেখক ব্লগার এদের উপর হামলা মামলা নির্যাতন এইসব করে আমরা আমাদের দেশের ও সমাজের কতো বড় ক্ষতি করেছি সেটা যদি আপনি উপলব্ধি না করেন তাহলে তো হবে না।
(২)
আপনি বলতে পারেন যে রাসেল আসিফ শুভ বিপ্লব বা ওদের সাথের অন্য লেখকরা যারা ব্লগে লিখতেন ওরা তো লেখক হিসাবে সেরকম খুব বড় কেউ না। তাহলে ওদের উপর নির্যাতন বা ওদেরকে লিখতে বাধা দিলে দেশের বা সমাজের এমন কি ক্ষতি হবে?
দেখেন কে কত বড় লেখক বা সমাজে কার লেখার কতোটুকু অভিঘাত হয় সেইসব আলোচনায় না হয় না গেলাম। ধরে নিলাম যে এইসব ব্লগাররা খুবই তুচ্ছ ছোটখাটো ইনসিগনিফিকেন্ট লেখক। কিন্তু আপনি যখন এইরকম একদল লেখকে এবং সেই সাথে মাঝে মাঝেই অন্যান্য লেখকদেরকে ওদের লেখার কন্টেন্টের জন্যে নির্যাতন করতে থাকবেন, ওদেরকে মারধোর করতে থাকবেন বা কোপাতে থাকবেন তাহলে কি হয়? তাহলে সাধারণভাবে সব লেখকরা একটা সংকেত পায়, সব পাঠকের কাছে একটা সংকেত যায়। সঙ্কেতটা হচ্ছে যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনঃপুত হবে না এমন কিছু লিখলে আপনার খবর আছে।
এর ফলাফলটা কি? একজন লেখক, হোক সে প্রতিষ্ঠিত লেখক বা নয়া লেখক- বয়স্ক বা তরুণ যেই হোন- ওদের মনে আপনি একটা স্থায়ী ট্যাব্যু স্থাপন করে দিলেন। ওদের মধ্যে আপনি একটা চিরস্থায়ী ভীতি ঢুকিয়ে দিলেন। ওদেরকে আপনি চোখে গুতো দিয়ে জানিয়ে দিলেন যে তুমি যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারবে না। যে, তুমি প্রচলিত কোন প্রথা বিশ্বাস বা প্রতিষ্ঠানের কোন সমালোচনা করতে পারবে না। যে, তুমি বর্তমান সমাজকে ভাঙার কথা বা পাল্টানোর কথা বলতে পারবে না। যদি কেউ এইসব না মানে? তাহলে রাষ্ট্র তোমাকে জেলে পুরে রাখবে। পুলিশ তোমাকে পেটাবে। রক্ষণশীলরা তোমার ঘাড় বরাবর এসে কোপ মারবে- বইমেলার বাইরে প্রকাশ্য রাস্তায় উজ্জ্বল আলোর নীচে তোমার ক্ষতবিক্ষত দেহ পরে থাকবে।
এখন আমাকে বলেন, এইরকম ভীতির মধ্যে কোন লেখক তাঁর নিজের মনের কথাটা লিখতে পারবেন? পারবেন না। বলতে পারেন যে, ভাই ধর্ম বিশ্বাস ঈশ্বর প্রফেট এইসব নিয়ে না লিখলেই তো হয়। না জনাব। আপনি যখন ভয় দেখাবেন, সেই ভয়ের তো কোন পরিমিত মাত্রা থাকে না। ভয় তো লো ডোজ বা হাই ডোজ হয় না। এই ভীতির ফলাফল হচ্ছে যে সকল লেখকের মাথায় একটা সেন্সর বসে যায়। এমনকি নিতান্ত প্রেমের কবিতা লিখতে গেলেও একজন কবির মাথায় ভয় কাজ করতে থাকে- এমন কিছু না আবার লিখে ফেলি যে ‘উনারা’ রেগে যায়! ফুল পাখি লতা পাতা নিয়ে লিখতে গেলেও মনে হয়, ঐ বইটার সাথে না আবার কোন কথার অমিল হয়ে যায়।
এই ভীতিগুলি আবার আপনাদের ক্ষমতার শীর্ষে যারা আছেন তারা রিইনফোর্স কোরতে থাকেন। পুলিশ প্রধান বক্তৃতা দেন, সরকার প্রধান বক্তৃতা দেন, বক্তৃতা দিয়ে লেখকদেরকে মনে করিয়ে দেন, ‘সহ্য করা হবে না।’
এই ভীতির মধ্যে যারা লিখবেন ওরা আর কিই বা লিখবেন? বলেন।
(৩)
এইখানেই রাসেল আর আসিফদের স্বাধীনতা জরুরী। আপনি ওদেরকে গুরুত্বহীন লেখক মনে করতে পারেন, বিরক্তিকর লেখক মনে করতে পারেন- সে আপনার ইচ্ছা আপনার পছন্দ ও বিচার বিবেচনার বিষয়। কিন্তু ওদের লেখার স্বাধীনতা যদি নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে আমরা কোন না কোনোভাবে জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বাধা তৈরি করছি। লেখকদের যেমন ইচ্ছা লেখার স্বাধীনতা যদি নিশ্চিত করতে না পারেন তাহলে পরবর্তী প্রজন্মকে আপনারা জোর করে বামন বানিয়ে দিচ্ছেন। শৃঙ্খলিত যৌবন কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। অন্ধকারে তরতাজা বৃক্ষের বিকাশ হয় না।
শোনেন, একই কথা বারবার বলতে বলতে ঘেন্না ধরে যায়, তবুও বলি। এই যে একদল ছেলেমেয়েকে শুধু লেখালেখির জন্যে আপনারা দেশান্তরী করে দিলেন। কতজনকে খুন করলেন। এটার জন্যে এই হতভাগা জাতিকে মূল্য দিতে হবে। অনেক বড় মূল্য। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে একদল বামনের দেশে পরিণত হবে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি। ছোটদেরকে শেখাচ্ছেন স্বাধীনভাবে চিন্তা করা যাবে না, প্রশ্ন করা যাবে না, বেঁচে থাকতেও ভয়, মরে গেলেও ভয়, এতো ভয়ের মধ্যে শিশুরা বড় হতে পারে? পারে না। বামন হবে একেকটা।
রাসেল তো মরে গেল। আমিও একদিন মরে যাব। কিন্তু আমার মেয়েরা তো থাকবে এই দেশে। রাসেলের বাচ্চারা তো বেঁচে থাকবে। আর থাকবে আমাদের প্রিয় স্বদেশ। কিরকম একটা দেশ রেখে যাচ্ছি আমরা আমাদের সন্তানদের জন্যে? ভেবেছেন?
লেখক:
ইমতিয়াজ মাহমুদ, মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী