কুঠিবাড়ি ও রবীন্দ্রনাথ

Comments

।। অজুফা আখতার ।।

এপার বাংলা ওপার বাংলায় ছড়ানো ছিটানো নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের নিষ্ঠুর স্মৃতি বিজড়িত কুঠিবাড়ির ধ্বংসাবশেষগুলোকেই আমরা কুঠিবাড়ি বলে জানি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে শিল্প বিপ্লবের স্রোতে দ্রুত বিকাশমান ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পে বস্ত্র রঞ্জনে নীলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। তখন জোর জবরদস্তি করে বাংলার কৃষকদেরকে নীল চাষে বাধ্য করত ব্রিটিশ শোষকরা। নীল রং নিষ্কাশন করাতে এমন কোন অত্যাচার ছিল না যা করত না এসব নীলকর সাহেবরা। নীল রং নিষ্কাশনের সেসব কেন্দ্রই ‘কুঠি’ নামে পরিচিত ছিল, আর নীলকর সাহেবরাই ছিল কুঠিয়াল।

নীলকুঠির কয়েদখানায় অবাধ্য প্রজাকে আটকে রেখে চাবকে আধমরা করা, নীল চাষ না করার অপরাধে গুলি করে মেরে ফেলে ত্রাস সৃষ্টি করা, বাড়িঘরে আগুন দেয়া, স্ত্রী লোকের ওপর অত্যাচার – এই ছিল নীল কুঠির রুটিন ওয়ার্ক। কিন্তু বিক্ষোভের স্ফুরণ হয় একদিন। যশোর জেলায় ১৮৬০ সালে বিক্ষুব্ধ কৃষকরা আক্রমণ করে থানা, ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয় নীলকুঠি। ব্যাপক আন্দোলনে আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয় নীল চাষ।  এই ছিল নীল কর সাহেবদের কুঠি বাড়ির পেছনের কথা যা এখন গল্পের মত মনে হয়।

কুঠিবাড়ি

সংগৃহীত ছবি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য যে কুঠিবাড়ি আমরা চিনি, তা-ও এক নীলকরেরই কুঠিবাড়ি। নীল কুঠি বাড়িই ছিল ঠাকুর পরিবারের জমিদারী দেখা শোনার কর্মস্থল ও আবাসস্থল। তবে রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য এই ‘কুঠি বাড়ি’ জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের নির্মাণ করা। নীলকর শেলী সাহেবের কাছ থেকে দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৩৩ সালে কুঠি বাড়িটি ক্রয় করেন। নদীভাঙ্গনের মুখে পড়েছিল বাড়িটি, তাই তখন এর মাল মসলা ব্যবহার করে ১৮৯২ সালে বর্তমান স্থানে নতুন করে বাড়িটি নির্মান করা হয়। শাহজাদপুর, পতিসর আর শিলাইদহ বিস্তৃত ঠাকুর পরিবারের জমিদারী দেখাশোনার উদ্দেশ্যেই এই পুনঃনির্মাণ। পূর্বতন নীলকুঠির ধারাবাহিকতায় শুরু থেকেই এই বাড়িটিও ‘কুঠি বাড়ি’ নাম বহন করছে।

বাল্যে ও কৈশোরে দু’বার, দশ বছর ও চৌদ্দ বছর বয়সে কবি আসেন শিলাইদহে।  পনেরো বছর বয়সে বড় ভাই জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে শিলাইদহ আসেন পদ্মা-গড়াই দিয়ে বিশাল পানশিতে করে। উত্তরে পদ্মা, পশ্চিমে গড়াই নদী বেষ্টিত অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শিলাইদহ নজরে আসে কবির। তার স্মৃতিতে নীলকর সাহেবদের মূল বাড়িটির নীচ তলায় ছিল কাছারী, উপর তলায় থাকার জায়গা।

কুঠিবাড়ি

সংগৃহীত ছবি

তৃতীয়বার যখন শিলাইদহে আসেন, কবি তখন আটাশ বছরের যুবক। ১৮৮৯’র ২৫ নভেম্বরের এ যাত্রায় সাথে ছিলেন পত্নী মৃণালিনী দেবী, পত্নী-সখী অমলা দাশ, কন্যা বেলা, পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং ভ্রাতৃষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ । এবার আর আগের মত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে নয়, জমিদারি দেখা শোনার দায়িত্বেই এসেছিলেন কবি। শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, ঠাকুর পরিবারের সবাই আসতেন শিলাইদহের আকর্ষণে, বেড়াতে বা কার্যোপলক্ষ্যে। তাই এই পরিবারের রুচির সাথে সঙ্গতি রেখেই নির্মিত হয়েছিল নুতন কুঠি বাড়ি।

জার্মানি থেকে মিস্ত্রি এনে তিনতলার কাঠের সিঁড়ি করা হয়। বাইরে থেকে সরাসরি ওঠার জন্য পেছনে লোহার গোল প্যাঁচানো সিড়ি, রান্না ঘর থেকে খাবার আনার জন্য। ছাদে লাগানো হয় জাপান থেকে আনা টালি। ছাদ থেকে দেখা যেত সূর্যোদয়, সূর্য্যাস্ত। আরো দেখা যেত জ্যোৎস্না প্লাবিত প্রকৃতি। ঘরে বসেই শোনা যেতো নদীর ডাক।

ইটকাঠের কোলকাতার জোড়াসাঁকোতে গণ্ডিবদ্ধ সমাজ থেকে সরাসরি অকূল পদ্মা আর গড়াই বেষ্টিত দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ শ্যামলিমার শিলাইদহে জমিদারির প্রয়োজনে আসেন কবি। শিলাইদহ-শাজাদপুর-পতিসরে যাতায়াতে পদ্মার পাশাপাশি কবির পরিচয় ঘটেছিল আত্রাই, গড়াই প্রভৃতি নদীর সঙ্গে। সেই সাথে ‘পদ্মা’ নামের তাঁর নিজের বোট থেকে পদ্মাপাড়ের পল্লী জীবনের ছোট ছোট গ্রামীণ গৃহস্থালি দেখেন কবি, যা তার লেখায় বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। ১৮৯১ থেকে ১৯০১-এর শিলাইদহ পর্বেই রচিত হয়েছে সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালীর মতো কাব্য।

কুঠিবাড়ি

সংগৃহীত ছবি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোষ্ট মাষ্টার’ গল্পটিও এখানেই লেখা হয়। এ সম্পর্কে কবি বলেন, ‘যখন আমাদের কুঠিবাড়ির একতলাতে পোষ্ট অপিস ছিল এবং আমি এঁকে প্রতিদিন দেখতে পেতুম তখনই আমি একদিন দুপুর বেলায় দোতলায় বসে সেই পোষ্ট মাষ্টার গল্পটি লিখেছিলুম।’ পদ্মা নদীতে ‘পদ্মা’ বোটে বসেই রচনা করা হয় ‘সোনার তরী’। তাঁর নিজের জবানী থেকেই দেখা যায় পল্লীর ঘাটে বোট ভিড়িয়ে আগ্রহ সহকারে পল্লী জনজীবনের চিত্র অবলোকন ছিল তাঁর অন্যতম সখ। যদিও কবির নিকট আগ্রহের পল্লীজীবনের এই কল-কাকলীকে তাঁর পাইক পেয়াদারা ‘বেয়াদপী’ ভেবে বাদ সাধতো তাঁর এই পর্যবেক্ষণে। এভাবেই পদ্মা পাড়েই দেখা মেলে ‘ছুটি’ গল্পের ফটিকের, মাখন নামে যাকে চিত্রিত করা হয়েছে, সে ছিল একটি বালিকা, যাকে বোট থেকে কবি দেখতে পান গম্ভীরভাবে গাছের গুড়ির উপর বসে ছেলেদের খেলায় বাদ সাধতে।

সংগৃহীত ছবি

আরেকদিন আরেক ঘাটে দেখেন বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় বালিকা কান্নাকাটি করছে না মোটেই। বিদায়লগ্নে ঘাটে আসা রমনীদের কথাবার্তা থেকে এই বালিকার দুরন্ত পনার কথা জানতে পেরেই তাঁর মনে জন্ম নেয় ‘সমাপ্তি’ গল্পের ‘মৃন্ময়ী’। গেরুয়া শাড়ি পড়ে আঁচল ভরা ফুল নিয়ে খঞ্জনী বাজিয়ে দ্বিপ্রহরে যে বোষ্টমী মাঠের মাঝের আল দিয়ে হাঁটত, সেই বোষ্টমী কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের জন্য নিয়ে যেতো ফুলে গাঁথা মালা।  এর থেকেই সৃষ্টি ‘বোষ্টমী’ গল্পের। ‘শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে প্রমথনাথ বিশী তাই বলেন, ‘পদ্মাকে যে দেখেনি বাংলাদেশকে দেখেনি সে, পদ্মাকে যে জানে না বাংলাদেশকে জানে না সে, পদ্মাকে যে বোঝেনি, বাংলাদেশকে বোঝেনি সে; যা কিছু দেখা জানা বোঝা সমস্ত সংহত এই নদীটির মধ্যে।’

বর্তমানে প্রায় ষোল একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই বাড়ির ঢেউ খেলানো প্রাচীরের বেষ্টনীতে উত্তর পূর্ব পাশে আছে কয়েকটি প্রাচীন আম গাছ যাতে ট্যাগ লাগানো আছে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত’। উত্তর পূর্ব কোনের আম বাগানের জায়গাটি স্থানীয়ভাবে ‘উপেনের ভিটা’ বলেই পরিচিত। সেই ‘দু বিঘা জমি’র উপেন, ‘শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে। বাবু বলিলেন, বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।’

কথিত আমগাছ

শিলাইদহবাসীদের ধারণা সেই জমিদার বাবুটি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই কোনার জায়গাটি অর্থাৎ আম বাগান ছাড়া কুঠিবাড়ির আকার যে অপূর্ণ থেকে যেত তা বলাই বাহুল্য।

পশ্চিমের পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটের প্রবেশপথে কবি নিজ হাতে দু’টি বকুল গাছ লাগান। এই বকুল গাছের তলেই রচিত হয়, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ণ এই বাটে’ আর ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি।

শিলাইদহ সম্পর্কে ছিন্নপত্রে আছে, ‘বেলায় উঠে দেখলুম, চমৎকার রোদদুর উঠেছে এবং শরতের পরিপূর্ণ নদীর জল তল তল থৈ থৈ করছে। নদীর জল এবং তীর প্রায় সমতল, ধানের খেত সুন্দর সবুজ এবং গ্রামের গাছপালাগুলি বর্ষাবসানে সতেজ এবং নিবিড় হয়ে উঠেছে। পৃথিবী যে কী আশ্চর্য সুন্দরী এবং কী প্রশস্ত প্রাণে এবং গভীর ভাবে পরিপূর্ণ তা এইখানে না এলে মনে পড়ে না। যখন সন্ধ্যাবেলা বোটের উপর চুপ করে বসে— আকাশের প্রান্তে সূর্যাস্তের দীপ্তি ক্রমে ক্রমে ম্লান হয়ে যায়, — কী শাস্তি, কী স্নেহ, কী মহত্ত্ব, কী অসীম করুণাপূর্ণ বিষাদ!’

আমরা জানি ‘ছিন্নপত্র’ হল কবির পত্রাবলীর সংকলন, অধিকাংশই ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লিখা। তাই এই পত্রে যা লেখা, তা কবির অকৃত্রিম উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ।

শেষ জীবনে (১৯৪০ সালে) এক পত্রে তিনি লিখেন, ‘আমার যৌবনের ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্য–রস-সাধনায় তীর্থস্থান ছিল পদ্মা প্রবাহ চুম্বিত শিলাইদহ পল্লীতে।…সেই পল্লীর স্নিগ্ধ আমন্ত্রণ সরস হয়ে আছে আজও আমার নিভৃত স্মৃতিলোকে।’

প্রমত্তা পদ্মা

এখানেই তিনি সংস্পর্শে আসেন বাউল সম্রাট লালন শাহ, কাঙাল হরিনাথ, গগন হরকরা, সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেনের সাহিত্যকর্মের। গগন হরকরার গান কবিকে বিমুগ্ধ করেছিল। একজন ডাকপিওন আপন মনে গান বাঁধছেন, তাতে সুর দিচ্ছেন, যে সুর, যে কথা হৃদয়মূলে নাড়া দিয়ে যায়। কবি প্রভাবিত হন সেসব গানের কথা আর সুরে। গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে….’ গানের সুরেই রচিত হয় ‘আমার সোনার বাংলা….আমি তোমায় ভালোবাসি‌’, যা এখন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে লালনের যথেষ্ঠ সখ্যতা ছিলো। ফকির লালনের সাথে যখন তাঁর পরিচয় ঘটে তখন তিনি বয়সে তরুণ। তিনি একবার লালনের আখড়ায় এসেছিলেন, গভীর অথচ সহজ ভাষায় বাঁধা লালনের গান তাঁকে মুগ্ধ করেছিলো, সেই থেকেই তাঁদের মধ্যে ভাবের লেনদেন। রবীন্দ্রনাথ কোথাও যেতে হলে পালকি ব্যবহার করতেন, লালন ফকির ঘোড়ায় চড়তেন। লালন ফকির ঘোড়ায় চড়েই কুঠি বাড়ি দু-একবার এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝেই ফকির লালন শাহসহ তাঁর বোট নিয়ে পদ্মায় ঘুরে বেড়াতেন। রবীন্দ্রনাথ এর সেজদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই বোটে বসা ভ্রমণরত ফকির লালনের একটি স্কেচ এঁকে ফেলেন যার একটি কপি এখনো লালন একাডেমীর মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই বলেছিলেন, ‘আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অনেক গানে আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি।’

সংগৃহীত ছবি

কবি শেষবারের মতো শিলাইদহ আসেন ১৯২৩ সালে। পদ্মা ততদিনে সরে গেছে দূরে। তিনি লিখেন, ‘শিলাইদহ ঘুরে এলুম। পদ্মা তাঁকে ত্যাগ করছে, তাই মনে হল বীণা আছে তার নেই, তার না থাকুক অনেক গানের স্মৃতি আছে। ভালো লাগলো, সেই সাথে মন উদাস হলো।’

সংগৃহীত ছবি

১৯৫৮ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ব্যবস্হাপনায় শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়িটি গৌরবময় স্মৃতিরূপে সংরক্ষিত আছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুঠিবাড়িটির গুরুত্ব অনুধাবন করে কবির বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংগ্রহপূর্বক একে একটি জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় ।

সূত্র: রবীন্দ্র কুঠি বাড়ির ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

বাঙালীয়ানা/এজে/এসএল

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.