কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের কবিতা

Comments

বুঝিবে সে কিসে

চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে।
কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে
কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে।
যতদিন ভবে, না হবে না হবে,
তোমার অবস্থা আমার সম।
ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে
বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।

দুখের তুলনা

একদা ছিল না ‘জুতো’ চরণ-যুগলে
দহিল হৃদয় মম সেই ক্ষোভানলে।
ধীরে ধীরে চুপি চুপি দুঃখাকুল মনে,
গেলাম ভজনালয়ে ভজন কারণে !
দেখি তথা এক জন, পদ নাহি তার,
অমনি ‘জুতো’র খেদ ঘুচিল আমার,
পরের অভাব মনে করিলে চিন্তন
নিজের অভাব ক্ষোভ রহে কতক্ষণ ?

 অপব্যয়ের ফল

যে জন দিবসে,
মনের হরষে
জ্বালায় মোমের বাতি;
আশু গৃহে তার
দেখিবে না আর,
নিশীথে প্রদীপ ভাতি।

পাপ-কেতকী

একদিন ধীরে ধীরে মনের উল্লাসে
উপনিত কেতকী-কুশুমশ্রেণী পাশে।
হেরিলাম কত শত শত মধুকর,
সুসৌরভে হয়ে তারা বিমুগ্ধ-অন্তর,
মধুপূর্ণ কমল করিয়া পরিহার,
মধু-আশে কেতকীতে করিছে বিহার;
কিন্তু মধু কোথা পাবে সে কেতকীফুলে!
শুধু হয় ছিন্নপক্ষ কন্টকের হুলে।
তথাপি সে বিমুঢ় অবোধ অলিগণ,
উড়িয়া কমসদলে না করে গমন।
ভাবিলাম এইরূপ মানব সকল,
ত্যজি পরিমলপূর্ণ তত্ত্ব-শতদল;
সুখ-সুধা আশে সদা প্রফুল্ল অন্তরে,
বিষয়-কেতকীবনে অনুক্ষণ চরে।
কোথা পাবে সে অমিয়, ব্যর্থ আকিঞ্চন,
সার দুঃখ কন্টকের যাতনা ভীষণ।
তবু তত্ত্ব-সরসিজে না করে বিহার;
ধিক রে মানব তোরে ধিক শতবার।

দুঃখ বিনা সুখ হয় না

কি কারণ, দীন! তব মলিন বদন?
যতন করহ লাভ হইবে রতন।
কেন পান্থ! ক্ষান্ত হও হেরে দীর্ঘ পথ?
উদ্যম বিহনে কার পুরে মনোরথ?
কাটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে,
দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?
মনে ভেবে বিষম-ইন্দ্রিয়-রিপু ভয়,
হাফেজ! বিমুখ কেন করিতে প্রণয়?

নিন্দুক

পর দোষ তোমার নিকটে যেই কয়
বলে সে তোমার দোষ অপরে নিশ্চয়।

বাগাড়ম্বর

যেরূপ করিবে কাজ কর্য্যেতে দেখাও,
বৃথা গর্ব্বে কেন তাহা কহিয়া বেড়াও?
না পার করিতে যদি কর যাহা গান,
কোথায় পাইবে লজ্জা রাখিবার স্থান?

(যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতার কারণে কবিকর্তৃক নির্ধারিত কাব্যকাঠামো সংরক্ষণ করা গেল না বিধায় আমরা দুঃখিত। – সম্পাদক)

লেখক:
Krishna Chandra Majumder01
কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার (১৮৩৪-১৯০৭), শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক

( সংক্ষিপ্ত জীবনী: ১৮৩৪ সালের ১০ জুন (মতান্তরে ৩১ মে, ১৮৩৭) খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামে এক বৈদ্য পরিবারে তাঁর জন্ম। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তাঁর পক্ষে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। মূলত কীর্তিপাশার জমিদারের অর্থানুকূল্যে তিনি জীবনযাপন করেন।

কৈশোরে কৃষ্ণচন্দ্র এক সময় কুসংসর্গে পতিত হন। তখন বন্ধুদের পরামর্শে তিনি একবার কলকাতার কালীঘাটে পলায়ন করেন, কিন্তু ধৃত হয়ে সেখান থেকে গৃহে প্রেরিত হন। পরে তাঁর মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে। জমিদার-পুত্রের সঙ্গে তিনি ঢাকা আসেন এবং তাঁর এক জ্ঞাতি ঢাকা জজকোর্টের উকিল গৌরবচন্দ্র দাসের আশ্রয়ে থেকে ঢাকার নর্মাল স্কুলে শিক্ষালাভ করেন। এখানে তিনি সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা শেখেন। এ সময় থেকেই তাঁর কাব্যচর্চা শুরু হয়। ঈশ্বর গুপ্তের উৎসাহে সংবাদ সাধুরঞ্জন ও সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। কৃষ্ণচন্দ্র এক সময় স্বধর্ম ও ঈশ্বরের বিরোধিতা শুরু করেছিলেন; পরে আবার শাক্ত, বৈষ্ণব ও ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন।

কৃষ্ণচন্দ্র ১৮৫৪ সালে বরিশালের কীর্তিপাশা বাংলা বিদ্যালয়ের প্রধান পন্ডিতপদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি ঢাকার নর্মাল স্কুলে যোগদান করেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় চাকরি ছেড়ে তিনি মডেল স্কুলে (১৮৬০) যোগ দেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন স্কুলে দীর্ঘ উনিশ বছর শিক্ষকতা করেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন খুবই নিষ্ঠাবান। অনেক কীর্তিমান ব্যক্তি তাঁর ছাত্র ছিলেন। মাঝখানে কিছুদিন তাঁর স্মৃতিবিভ্রম ঘটে; পরে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।

কৃষ্ণচন্দ্রের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সদ্ভাবশতক প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে। নীতি ও উপদেশমূলক এ কাব্যটি পারস্য কবি হাফিজ ও সাদীর কাব্যাদর্শে রচিত। বাল্যকালে তাঁর একটি ছদ্মনাম ছিল রামচন্দ্র দাস, সংক্ষেপে রাম। তাই পরিণত বয়সে তিনি রামের ইতিবৃত্ত (১৮৬৮) নামে একটি আত্মচরিত রচনা করেন। মহাভারতের ‘বাসব-নহুষ-সংবাদ’ অবলম্বনে রচিত তাঁর অপর গ্রন্থ হলো মোহভোগ (১৮৭১)। কৈবল্যতত্ত্ব (১৮৮৩) তাঁর একটি দর্শনবিষয়ক গ্রন্থ। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় তাঁর নাটক রাবণবধ। এ ছাড়া তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পনেরো। তাঁর রচনা প্রসাদগুণসম্পন্ন এবং তাঁর কবিতার অনেক পঙ্ক্তি প্রবাদবাক্যস্বরূপ, যেমন: ‘চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে’ ইত্যাদি। এ পঙ্ক্তিধারী কবিতাটি এক সময় স্কুলপাঠ্য বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

কৃষ্ণচন্দ্র ১৮৬০ সালে মাসিক মনোরঞ্জিকা ও কবিতাকুসুমাবলী নামক পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৮৬১ সালে ঢাকা প্রকাশ প্রকাশিত হলে তিনি তার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু এর মালিকের সঙ্গে মতানৈক্য হলে তিনি পদত্যাগ করেন এবং ১৮৬৫ সালে বিজ্ঞাপনী নামক পত্রিকার সম্পাদক হন। দেড় বছর পর তিনি আবার ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার সম্পাদক পদে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় অসুস্থতার কারণে সাংবাদিকতা ছেড়ে তিনি কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। এর দীর্ঘকাল পরে ১৮৮৬ সালে যশোর থেকে তিনি সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় দ্বৈভাষিকী নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। কবিতাকুসুমাবলী ছিল পদ্যবহুল মাসিক পত্রিকা। তাঁর সদ্ভাবশতক কাব্যের অধিকাংশ কবিতাই এ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। শেষ জীবনে কৃষ্ণচন্দ্র সেনহাটিতে বসবাস করেন এবং বিবিধ রকমের সঙ্গীত রচনা করে অবসর জীবন কাটান। ১৯০৭ সালের ১৩ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। – বাংলাপিডিয়া)

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট