‘চিকিৎসককে যখন মঞ্জুরের “ক্ষত ব্যান্ডেজ” করতে বলা হয়, তখন তিনি দেখতে পেলেন, একটিমাত্র গুলির আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। গুলিটি তাঁর মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর জন্য একঝাঁক বুলেট দরকার হয়নি…ঢাকা থেকে আসা এক সেনা কর্মকর্তা মঞ্জুরকে হত্যা করেন, বিক্ষুব্ধ সৈন্যরা নয়। তাঁকে কেন হত্যা করা হবে? কেন বিচারের মুখোমুখি করা হবে না? তিনি কি এমন কিছু জানতেন, সেনাবাহিনী যা প্রকাশিত হতে দিতে চায়নি?’
১৯৮১ সালে জিয়াউদ্দীন চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। জিয়াউদ্দীন চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, চট্টগ্রামে অবস্থিত সেনাবাহিনীর ২৪তম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুর, বীর উত্তমের গ্রেপ্তার হওয়া থেকে শুরু করে হাটহাজারী থানায় সেনাবাহিনীর হাতে তাঁকে সোপর্দ করা পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এমনকি মঞ্জুর নিরাপদে ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছালেন কি না, সেটিও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ারের কাছ থেকে তিনি শুনে নিশ্চিত হয়েছিলেন। তারই Assassination of Ziaur Rahman and the Aftermath বইয়ে তিনি এভাবেই বর্ণনা করেছেন।
তিনি আরও লেখেন, ‘ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পথে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়নি। ব্রিগেডিয়ার আজিজ পুলিশের ডিআইজিকে বলেছিলেন, ২ জুন সকালবেলা মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয়। আজিজ এ কথা বলেননি যে মঞ্জুর বিক্ষুব্ধ সৈন্যদের হাতে মারা পড়েছেন… এদিকে এরশাদ এবং তার দোসরেরা বারংবার বলে এসেছে, ‘কিছু বিক্ষুব্ধ মানুষ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে মঞ্জুরকে নেওয়ার পথে তাঁকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এতে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে তাদের গুলিবিনিময় হয়। একপর্যায়ে মঞ্জুরের গায়ে বুলেট বিঁধে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।’
অথচ এই তথাকথিত ‘নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে তাদের গুলিবিনিময়’ –এ শুধুমাত্র একটি বুলেট জেনারেল মঞ্জুরের মাথার ডান দিকের পেছনের অংশে এসে লাগে এবং অদ্ভুত ঘটনা বর্তমানে প্রচলিত ‘ক্রশফায়ার’-এর মতই নিরাপত্তারক্ষীদের বা ‘বিক্ষুব্ধ মানুষ’দের কারই আর একটিও বুলেটের আঘাত লাগলো না।
এ প্রসঙ্গে মার্কিন সাংবাদিক ও Bangladesh: The Unfinished Revolution এর লেখক লরেন্স লিফশুলজ লিখেছেন, এ ধরনের মিথ্যা ও প্রচ্ছদকাহিনীর সমস্যা হচ্ছে, এর প্রণেতারা অনেক সময় নিজেদের লেখা চিত্রনাট্য নিজেরাই ভুলে যান। নিজেদের গা বাঁচাতে ‘বিক্ষুব্ধ সৈন্য’দের হাতে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের যেসব গল্প এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা ফেঁদেছেন, তার প্রতিটিতে বলা হয়েছে যে পুলিশ তাঁকে সেনাবাহিনীর বিশেষ ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করার পর চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ‘নেওয়ার পথে’ তাঁকে হত্যা করা হয়।
সিআইডির কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে পুলিশের তৎকালীন আইজি এ বি এম জি কিবরিয়া জানিয়েছেন, তিনি এরশাদকে সরাসরি প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আনার পরই মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়।’কিবরিয়া ১ জুন বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সামনে মঞ্জুরকে পুলিশের কাছ থেকে সেনা হেফাজতে আনার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি পরদিন এরশাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়? মঞ্জুর হত্যা মামলার সাক্ষ্যে কিবরিয়া বলেন, ‘২ জুন বিকেলবেলা বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আমি চিফ অব আর্মি স্টাফের কাছে জানতে চাই, মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে? আদতে তো তাঁর প্ররোচনায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে নেওয়ার নির্দেশ দেন, যাঁদের হাতে—এক অর্থে তাঁরই হেফাজতে—মঞ্জুরের মৃত্যু হলো। এরশাদের জবাব ছিল, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পরপরই বিক্ষুব্ধ সেনাদের গুলিবর্ষণে মঞ্জুর নিহত হন। সেদিন এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের মতো কিবরিয়াও এরশাদের ‘বিক্ষুব্ধ সেনা’দের হাতে মঞ্জুর হত্যার গল্প বিশ্বাস করেননি।
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী লিখেছেন, “এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা যে গল্প ফেঁদেছেন এবং ৩০ বছর ধরে ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজিয়ে চলেছেন, তার প্রধান দুর্বলতা হলো বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। সে সময় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন বা এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা কেউই কখনো বলেননি যে তাঁরা ‘বিক্ষুব্ধ মানুষ’ বা ‘বিক্ষুব্ধ অস্ত্রধারী’ ব্যক্তিদের দেখেছেন, যাঁরা মঞ্জুরকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে গোলাগুলি হয়; আর মঞ্জুর এই ‘টানাহ্যাঁচড়া’র কারণে গুলিবিদ্ধ হন। কেউ কেউ বলেছেন, মঞ্জুরের ‘নিরাপত্তারক্ষীরা’ গুলি করেছিল; আর কেউ বলেছেন, ‘হাসপাতালে নেওয়ার পথে মঞ্জুর মারা যান।’ কিন্তু কোনো হাসপাতালেই মঞ্জুরকে সেদিন জীবিত বা মৃত বা আহত অবস্থায় দেখা যায়নি। “
পাঠক, জিয়া হত্যার পর অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেননি। তিনিও তার পূর্বসূরি জিয়ার মতই চাতুরতার পরিচয় দিয়েছেন। জেনারেল জিয়া যেমন শেখ মুজিব হত্যার পর আসল রাষ্ট্রপতি হননি মোশতাক, সায়েমের ঘাড়ে বন্দুক রেখে চালিয়েছেন থিক একইভাবে জিয়া হত্যার পর বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও পরে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি করে মূল ক্ষমতার দন্ডটি হাতেই রেখেছিলেন সেনাপ্রধান এরশাদ। রাষ্ট্রপতি হত্যার পর ধুরন্ধর এরশাদ তার ক্ষমতা দখলের পথে বাধাগুলো অপসারণ করেন। সেই লক্ষ্যে প্রথমে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। এরপর জিয়া হত্যার সময় বিদ্রোহের অভিযোগে সাজানো ও ভুয়া বিচারে ১৩ জনকে ফাঁসি, ৭ জনকে যাবজ্জীবন ও ৬ জনকে ৭ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তদের প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান ছিলেন। ফাঁসি দেয়া ১৩ জনের মধ্যে অন্তত ১০-১১ জন জিয়া হত্যার বিষয়ে কিছুই জানত না। এরপর পাকিস্তানপন্থি সেনাকর্মকর্তাদের সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়। জিয়া হত্যার ১০ মাস পর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
তবে জিয়া হত্যার জন্য এরশাদগং মঞ্জুরকে দায়ী করলেও জানা যায় মঞ্জুর নাকি ওই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। জিয়া হত্যাকে কেন্দ্র করে ১৩ জন সেনাকর্মকর্তাকে ফাঁসি দেয়ার গোপন বিচারটি যদি উচ্চ আদালতে পুনঃবিচার করা হতো তাহলে বহু ঐতিহাসিক তথ্য ও অজানা ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটিত হতে পারত। শোনা যায়, জেনারেল মঞ্জুর খুবই ঘৃণার চোখে দেখতেন এরশাদকে। মঞ্জুর সেনাপ্রধানের নামটিও উচ্চারণ করতেন না। তাকে বলতেন ‘থিফ’।
জিয়া হত্যা অপারেশনে নেতৃত্ব দেয় লে. কর্নেল মতিউর রহমান। প্রকৃতপক্ষে লে. কর্নেল মতিউর এবং লে. মাহবুবই ছিল জিয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রের মূল হোতা। কোনো কোনো সূত্র মতে, জে. এরশাদের সঙ্গে মতিউর-মাহবুবের গভীর সখ্য ছিল। অদ্ভুতভাবে দু’জনই আর বেঁচে নেই। জানা যায়, জিয়া হত্যার ২ দিন পর ৩১ মে রাতে সেনানিবাস থেকে অন্যত্র যাওয়ার পথে সরকারি সৈন্যরা এদের আক্রমণ করে। এ সময় মতিউর চেঁচিয়ে বলে, ‘শুট মি মাহবুব শুট মি।’ দু’জনের স্টেনগান থেকেই গুলি বের হয় এবং চিরতরে শেষ হয়ে যায় ওই দু’জন। এ দু’জনই ভালোভাবে বলতে পারত জিয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রের মূল কথা। জিয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রে এ দুই হোতা মতিউর-মাহবুবকে কারা হত্যা করল, কোথায় করল, কিভাবে করল তার কোন হদিস কী পাওয়া যায়? তাদের হত্যার প্রধান উদ্দেশ্য মূল হত্যাকারী বা আদেশদাতাকে আড়াল করা নয়তো? এদের রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড নিয়েও তদন্ত হওয়া উচিত।
এদিকে জে. জিয়াকে হত্যার সময় যেসব সেনা সদস্য সার্কিট হাউসে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই জানত না যে, রাষ্ট্রপতিকে খুন করা হবে। পাকিস্তানের সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লেখা Bangladesh: A Legacy of Blood গ্রন্থে জিয়া হত্যার ঘটনাবলী রয়েছে। ঘাতক দলের নেতৃত্বে ছিল লে. কর্নেল মতিউর রহমান। গ্রন্থে বলা হয়, ১৬ জন অফিসারকে নিয়ে একটি পিকআপে উঠে মতিউর। মতিউর সঙ্গীদের বলে, ‘আমরা আজ প্রেসিডেন্টকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি।’ ঘাতক বাহিনী দুটি দলে বিভক্ত হয়। ৯ নম্বর কক্ষে রাষ্ট্রপতির ওপর আঘাত হানার দায়িত্ব দেয়া হয় লে. কর্নেল ফজলে হোসেনকে। মতি নিজে থাকল দ্বিতীয় দলে।
বৃষ্টির মধ্যে কালুরঘাট থেকে রাত সাড়ে ৩টার দিকে রওনা হওয়ার পর লে. রফিক প্রথম দলের পিকআপে বসে ফজলেকে কম্পিত স্বরে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনারা কি প্রেসিডেন্টকে খুন করতে যাচ্ছেন?’ কর্নেল ফজলে জানান, ‘না, আমরা শুধুই তাকে তুলে আনতে যাচ্ছি।’ এ নির্দোষ তরুণ যুবক রফিককেও হত্যা করা হয়। রফিক মাত্র ১৩ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ৪ সদস্যের পেছনের দলে কর্নেল মতিউরসহ অন্যরা ৯ নম্বর কক্ষ খুঁজতে থাকে। ক্যাপ্টেন সাত্তার লাথি মেরে দরজা ভেঙে ওই কক্ষে ড. আমিনা রহমানকে দেখতে পায়।
এই হুড়োহুড়ির মধ্যে ৪ নম্বর কক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়া বের হয়ে আসেন। সাদা পায়জামা পরা উস্কোখুস্কো চুলে রাষ্ট্রপতি তার হাত দুটি সামনের দিকে সামান্য উঁচিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন- ‘তোমরা কি চাও?’ রাষ্ট্রপতির সবচেয়ে কাছে ছিল মেজর মোজাফফর ও ক্যাপ্টেন মোসলেহ উদ্দিন। মোজাফফর দৃশ্যত ভয়ে কাঁপছিল। মোসলেহ উদ্দিন রাষ্ট্রপতিকে আশ্বস্ত করে বলছিল- ‘স্যার আপনি ঘাবড়াবেন না। এখানে ভয়ের কিছু নেই।’ ওই দু’জন অফিসার তখন বিশ্বাস করছিল, তারা রাষ্ট্রপতিকে উঠিয়ে নিতেই এসেছে, হত্যা করতে নয়। মতি কাছেই ছিল। রাষ্ট্রপতির প্রতি তার বিন্দুমাত্রও দয়ামায়া ছিল না।
রাষ্ট্রপতির প্রতি মোসলেহ উদ্দিনের আশ্বাসের বাণী মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ঘাতক লে. কর্নেল মতিউর তার এসএমজি থেকে গুলি করেন। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে জিয়ার শরীর একেবারে ঝাঁঝরা করে ফেলে। দরজার কাছেই মেঝেতে জিয়া লুটিয়ে পড়েন। মতিউর বন্দুকের নল দিয়ে জিয়ার প্রাণহীন দেহ উল্টিয়ে নেয়। এরপর জিয়ার মুখমণ্ডল আর বুকের ওপর মতিউর এসএমজির ট্রিগার টিপে ম্যাগাজিন খালি করে তার খুনের নেশা মিটিয়ে নেয়। জিপে চড়ে সেনানিবাসের দিকে যাওয়ার পথে মেজর মোজাফফর ক্ষোভ-দুঃখে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘আমি জানতাম না, আমরা রাষ্ট্রপতিকে খুন করতে যাচ্ছি।’
জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. কর্নেল মাহতাবুল ইসলাম গুলি থেমে গেলে তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। তার ভাষ্য হচ্ছে, ‘আমি দরজার কাছে রাষ্ট্রপতির প্রাণহীন দেহ পড়ে থাকতে দেখি। গুলির আঘাতে তার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তার একটা চোখ সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে যায়। ঘাড়ের মাংসগুলো কোথাও যেন উড়ে চলে গেছে। তার বুকে, পেটে আর গায়ে অগণিত গুলির চিহ্ন ফুটে রয়েছে।’
তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, দু’দফায় খালেদা জিয়া ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলেও স্বামী হত্যার বিচার করেননি। তবে স্বামী হত্যার ৩৩ বছর পর খুনি এরশাদের বিচারের কথা উচ্চারণ করেন খালেদা জিয়া। ২০১৪ সালের ৪ মে ঢাকায় প্রেসক্লাবে দলের গণঅনশন কর্মসূচিতে বক্তৃতাকালে খালেদা জিয়া আকস্মিকভাবে জিয়া-মঞ্জুর হত্যার জন্য এরশাদকে সরাসরি দায়ী করে বলেন- ‘মঞ্জুর ও জিয়াউর রহমানের খুনি এরশাদ। খুনি এরশাদের বিচার করতে হবে। তার বিচার করা হবে।’ খালেদার অভিযোগের ৫ দিন পর ১০ মে এরশাদ দলীয় অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জিয়া হত্যা নিয়ে ব্লেম গেম চলছে। উনি (খালেদা জিয়া) বলেন, আমি খুনি। আমি খুনি নই। আমি জানি জিয়ার খুনি কে।’ এরশাদ তার বক্তব্যে জিয়া হত্যার জন্য বদরুদ্দোজা চৌধুরী কে দায়ী করেন।
এরশাদের এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ‘এরশাদ একজন কম্পালসিভ লায়ার’। সাংবাদিক লিফশুলজের লেখা উল্লেখ করে বি. চৌধুরী বলেন, ‘মঞ্জুর হত্যাকান্ডের বিবরণীতে স্পষ্ট বোঝা যায়, মঞ্জুরকে যারা হত্যা করেছে, সেই চক্রে প্রথম নাম জেনারেল এরশাদ। একটি মাত্র কারণেই জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছে। আর সেই কারণটি হচ্ছে মঞ্জুর বেঁচে থাকলে জিয়া হত্যাকান্ডের সঙ্গে এরশাদের সংশ্লিষ্টতা নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে যেত।’
বিএনপি আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম মোস্তাফিজুর রহমান তার ‘রণ থেকে জন’ গ্রন্থে লিখছেন, ‘জেনারেল মঞ্জুর পালাতে চাননি। তাকে পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে। জিয়া হত্যার নেপথ্য রহস্য উদ্ঘাটনে বাধা প্রদানই ছিল এ হত্যাকান্ডের মূল উদ্দেশ্য।’ জিয়া হত্যা মামলার আসামীদের সাক্ষ্য ও বর্ণনা উল্লেখ করে গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্টকে হত্যাসংক্রান্ত পরিকল্পনার কথা দু-একজন ছাড়া চট্টগ্রাম বিদ্রোহের লোকজনদের কারোই জানা ছিল না। সব মিলিয়ে অনুমিত হয়, মঞ্জুর শেষ পর্যন্ত ঘটনার শিকার হয়েছেন।’
১ জুন ১৯৮১ রাতে সেনাবাহিনীর ২৪তম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর বীর উত্তমকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় গুলি করে হত্যার ১৪ বছর পর ১৯৯৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী জেনারেল মঞ্জুরের বড় ভাই ব্যারিস্টার আবুল মনসুর আহমেদ বাদী হয়ে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় মঞ্জুর হত্যা মামলা দায়ের করেন। ১৯৯৫ সালের ১ মার্চ আসামী এমদাদুল হক, ১২ মার্চ মোহাম্মদ আবদুল লতিফ ও শামসুর রহমান এবং ১৮ জুন মোস্তফা কামালকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছরের ১১ জুন কারাগারে থাকা এরশাদকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ১৫ জুলাই আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ।
মঞ্জুর হত্যা মামলায় মোট ৪৯ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হওয়ার পর ২০১২ সালের ২ অক্টোবর আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এরশাদ।
এ মামলায় পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন দায়িত্বশীল ও সংশ্লিষ্ট ২৮ জন কর্মকর্তা ও সদস্যকে সাক্ষী করা হয়। এদের প্রায় সকলের জবানবন্দিতে এসেছে, এরশাদের নির্দেশেই মঞ্জুরকে হাটহাজারী থানার পুলিশ হেফাজত থেকে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। তাঁকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে ১৯৮১ সালের ১ জুন মধ্যরাতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা করা হয়।
মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, মঞ্জুর হত্যার দুই দিন আগে, ৩০ মে (১৯৮১) ভোররাতে চট্টগ্রামে এক সেনা অভ্যুত্থানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও সেনাশাসক জিয়াউর রহমান হত্যাকান্ডের সময় চট্টগ্রামে অবস্থিত সেনাবাহিনীর ২৪তম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) ছিলেন এম এ মঞ্জুর। তিনি ১ জুন স্ত্রী-সন্তান এবং অনুগত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যান। তার সঙ্গে ছিলেন তার নিরাপত্তা কর্মকর্তা মেজর মো. রেজাউল করিম। মঞ্জুরের সঙ্গে তিনিও আটক হয়েছিলেন। মেজর রেজার জবানবন্দি অনুযায়ী, সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে তারা ফটিকছড়ির রাস্তার দিকে রওনা হন। একপর্যায়ে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে এক চা-বাগানের ভেতরে একটি বাড়িতে ওঠেন। পরে ওই বাড়িটি পুলিশ ঘেরাও করলে মঞ্জুর ও মেজর রেজা আত্মসমর্পণ করেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ তাদের হাটহাজারী থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
আসামী মেজর (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) কাজী এমদাদুল হক, সাক্ষী মেজর রেজা ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের জবানবন্দি ও সাক্ষ্য অনুযায়ী ১ জুন সন্ধ্যার পরে মঞ্জুরকে হাটহাজারী থানায় নেওয়া হয়। পরে ব্রিগেডিয়ার আবদুল লতিফ (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল ও ডিজিএফআইয়ের প্রধান হন) ও ব্রিগেডিয়ার এ কে এম আজিজুল ইসলামের নির্দেশে ক্যাপ্টেন এমদাদ রাত সাড়ে আটটার দিকে হাটহাজারী থানায় যান। ক্যাপ্টেন এমদাদ জেনারেল মঞ্জুর, তাঁর স্ত্রী-সন্তান ও মেজর রেজাকে পৃথক পৃথক গাড়িতে তুলে সেনানিবাসে নিয়ে যান। জেনারেল মঞ্জুরকে হাত ও চোখ বেঁধে মেজর এমদাদের গাড়িতে তোলা হয়।
ওই গাড়িতে থাকা সুবেদার আশরাফ উদ্দীনসহ আরও কয়েকজন সেনাসদস্য জবানবন্দিতে বলেন, মঞ্জুরকে নিয়ে রাত সাড়ে নয়টার দিকে তারা সেনানিবাসে প্রবেশ করেন। পরে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
মঞ্জুরের লাশের ময়নাতদন্ত করেন চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসক কর্নেল এ জেড তোফায়েল আহমদ। সাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ময়নাতদন্তে মঞ্জুরের মাথার ডান দিকে পেছনে একটি বুলেটের আঘাত দেখতে পান। তাঁর শরীরে আর কোনো জখমের চিহ্ন ছিল না।
এ মামলার সাক্ষী চট্টগ্রাম পুলিশের তৎকালীন উপকমিশনার আলী মোহাম্মদ ইকবাল জবানবন্দিতে বলেছেন, হাটহাজারী থানা থেকে সেনাসদস্যরা মঞ্জুরকে নিতে গেলে তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডেন্ট ব্রিগেডিয়ার আজিজকে টেলিফোন করেন। তখন আজিজ জানান, সেনাপ্রধানের (এরশাদ) নির্দেশক্রমে মঞ্জুরসহ আটক করা ব্যক্তিদের সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের জন্য তিনি ও ব্রিগেডিয়ার লতিফ ক্যাপ্টেন এমদাদকে পাঠিয়েছেন।
পরে আসামী এমদাদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ব্রিগেডিয়ার লতিফ ও আজিজের নির্দেশে তিনি মঞ্জুরকে পুলিশ হেফাজত থেকে নিয়ে আসেন এবং পরে হত্যা করা হয়।
মঞ্জুরকে হত্যার পর প্রচার করা হয় যে সেনানিবাসে নেওয়ার পর একদল উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্য তাঁকে হত্যা করেছে। কিন্তু এ মামলায় যেসব সেনাসদস্য জবানবন্দি দিয়েছেন, তাঁদের কেউ উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্যের কথা বলেননি।
বিমানবাহিনীর তৎকালীন প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দিন পরবর্তী সময়ে এ মামলায় সাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দিতে মঞ্জুরকে হত্যার জন্য সরাসরি এরশাদকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ১ জুন বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে তিনি বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের অফিসে ছিলেন। তখন সেখানে জেনারেল এরশাদও ছিলেন। এ সময় টেলিফোন আসে। রাষ্ট্রপতি টেলিফোন রেখে জানান যে মেজর জেনারেল মঞ্জুর পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। এ খবর শুনে জেনারেল এরশাদ চেয়ার থেকে উঠে রাষ্ট্রপতির লাল টেলিফোন দিয়ে কাউকে ফোন করে বলেন, ‘মঞ্জুরকে পুলিশ আটক করেছে। তাকে শিগগির নিয়ে আসো এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করো’। তখন সদরউদ্দিন পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে এরশাদ বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘এয়ার চিফ, আপনি কিছুই বোঝেন না।’
সদরউদ্দিন বলেন, তিনি ও তৎকালীন আইজিপি এ বি এম জি কিবরিয়া অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে বলেন, যেন মঞ্জুরকে বেসামরিক হেফাজতে রাখা হয় এবং বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে এরশাদের দীর্ঘ বাদানুবাদ হয়। পরে এরশাদের পরামর্শে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার জেনারেল মঞ্জুরকে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত দেন।
সদরউদ্দিন আরও বলেন, ২ জুন রাত দেড়টা থেকে দুইটায় তিনি মঞ্জুরকে হত্যার খবর পান। পরদিন সকালে তিনি এরশাদকে টেলিফোন করে বলেন, ‘এরশাদ সাহেব, আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন? এইটা কিন্তু ভালো করলেন না।’ জবাবে এরশাদ বলেছেন, ‘বিক্ষুব্ধ সৈনিকেরা তাকে হত্যা করেছে।’
জিয়া হত্যার প্রহসনের বিচারের রায়ে ফাঁসিতে নিহত ব্রিগেডিয়ার মোহসীন ও কর্নেল মাহফুজ দু’জনই জিয়া হত্যার জন্য এরশাদকে দায়ী করেছে।
মঞ্জুর হত্যা মামলা দায়েরের দীর্ঘসময় পর ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারী এ মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বিচারক হোসনে আরা আকতার ওই বছরের ১০ ফেব্রুয়ারী রায়ের জন্য দিন ধার্য করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই মামলার রায়ের মাত্র ১৩ দিন আগে কোন এক অজানা কারণে ২৯ জানুয়ারী বিচারক হোসনে আরা আকতারকে বিচারকের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এর আগের ১৯ বছরে বিভিন্ন সময়ে ২২ জন বিচারক এ মামলাটিতে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আসাদুজ্জামান খান রচি মামলাটি অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন। আবেদনের শুনানিতে তিনি বলেন, “এ মামলায় সঠিকভাবে তদন্ত হয়নি। ফলে আরও অনেককে সাক্ষী করা যায়নি। প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের জন্য মামলাটি অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন”। আদালতও রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন মঞ্জুর করে মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন।
এবছর ১২ জানুয়ারী মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ সুপার কুতুবউদ্দিন ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এ প্রতিবেদন দাখিল করেন।
২৫ জানুয়ারী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত অস্থায়ী প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক দিলারা আলো চন্দনা সম্পূরক অভিযোগপত্র (চার্জশিট) গ্রহণ করেন।
মৃত্যুর কারণে জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর হত্যা মামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ ও তার অন্যতম সাথী মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল লতিফকে দায় থেকে অব্যাহতি দেয় আদালত।
মেজর (অব.) কাজী এমদাদুল হক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোস্তফা কামাল উদ্দিন ভূইঞা ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) শামসুর রহমান শামসের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই মামলার বিচার আবার শুরু হলেও তারিখের পর তারিখ ধার্য হলো কিন্তু ৪০ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও মঞ্জুর হত্যার বিচার হলো না।
তৎকালীন মেজর মঞ্জুর স্ত্রী-সন্তানসহ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের দোসর, পাকিস্তানের প্রেতাত্মা ঘাতকদের বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানি বীর উত্তম জেনারেল মঞ্জুর হত্যার বিচার করলো না বিএনপি কিম্বা আওয়ামী লীগ, খালেদা জিয়া কিম্বা শেখ হাসিনা, কোন সরকারই। কাকে বা কাদেরকে বাঁচাতে, কোন রাজনীতিক খেলার বলি হতে হলো ‘মঞ্জুর হত্যা মামলা’কে তার জবাব রাষ্ট্রকে দিতেই হবে একদিন ইতিহাসের পাতায়।
লেখক: সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা