ক্ষুদ্রশিল্পের বৃহৎ মানব জাহানারা বেগম

Comments

“আড়ং” প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৭৮ সালে আর “জাহানারা কটেজ ইন্ড্রাটিজ” প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৫২ সালে কুমিল্লা শহরের নানুয়া’র দীঘির পাড়ে। মাত্র ৭৫ পয়সা পুঁজি নিয়ে জাহানারা বেগম তার হস্ত ও কারুশিল্প প্রতিষ্ঠান “জাহানারা কটেজ ইন্ড্রাটিজ” শুরু করেন। লক্ষ্য নারীর ক্ষমতায়ন।

জাহানারা বেগম কারো ভাষায় কুটিরশিল্পের অগ্রসৈনিক, কারো কাছে কুটির শিল্পের রানী, কারো কাছে দিন বদলের সারথী, কারো কাছে পথ প্রর্দশক, কারোবা কাছে ছোট শিল্পের বড় মানুষ, কারো দৃষ্টিতে তিনি মানুষ গড়ার কারিগর।

অথচ সারা দেশের কথা বাদ দিলাম তার শহর কুমিল্লার বর্তমান প্রজন্মের কয়জনই বা জানেন কুমিল্লার গর্ব বাংলাদেশের জাতীয় এবং সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার “স্বাধীনতা পুরস্কার” এ ভূষিত এই মহীয়সী নারী সম্বন্ধে ।

Jahanara Begum_Husband
স্বামীর সঙ্গে জাহানারা বেগম

বাংলাদেশের কুটির শিল্প আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা, সমাজ উন্নয়নকর্মী জাহানারা বেগম নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কুটির শিল্পের কাজে হাত লাগিয়ে এ শিল্পকে নিয়ে গেছেন বিশ্ব দরবারে। দেশের কুটির শিল্পের বিকাশ ও অগ্রগতিতে তাঁর অসামান্য অবদান সর্বজন স্বীকৃত।

তাঁর এই মহতী অবদানের জন্যে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অজস্র পুরস্কার, স্বীকৃতি ও সম্মান পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য – রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা ” স্বাধীনতা পদক”, ১৯৬২ সালে রানী এলিজাবেথ গর্ভনর স্বর্ণপদক, জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ সমবায়ী পুরস্কার, পল্লী উন্নয়নে শ্রেষ্ঠ কর্ম হিসেবে বার্ড (BARD ) সম্মাননা পদক, ইত্যাদি।

সমাজসেবী ও নারী সংগঠক হিসেবে জীবনে প্রায় ১২৬টি পদক লাভ করেন তিনি।

এছাড়া দুঃস্থ ও অসহায় মানুষ বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অসমান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জাহানারা বেগমকে ”সাদা মনের মানুষ” সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।

এতসব সম্মাননা তিনি গ্রহণ করেছেন নীরবে। এ সম্মাননা তাঁকে করেছে বিনম্র।

স্বশিক্ষায় শিক্ষিত এই মহীয়সী নারী প্রতিষ্ঠান ও কর্মমুখী শিক্ষা বিস্তারে কাজ করেছেন অবিরামভাবে। গড়ে তুলেছেন জাহানারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয, জাহানারা কটেজ ইন্ডাষ্টিজ, মনির কটেজ ইন্ডাষ্টিজ এবং ট্রেনিং সেন্টার, বরুড়া উপজেলার আড্ডা গ্রামে আড্ডা ওমেন্স ইন্ডাষ্ট্রিযাল স্কুল, বজ্রপুর মহিলা সমবায় সমিতি লি., কুমিল্লা সদর (দ.) কেন্দ্রীয সমবায় সমিতি লি., জাহানারা ফিমেল এডাল্ট স্কুল এন্ড হ্যান্ডিক্রাফটস ট্রেনিং সেন্টার (JFASAHTC)এর মতো অনেক প্রতিষ্ঠান।

Jahanara Begum_02
প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে।

জাহানারা বেগম বলতেন, মানুষকে শক্তিশালী করতে কর্ম শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্র বিস্তারে প্রতিষ্ঠান গড়া প্রয়োজন। আর এই বিশ্বাসকে ধারণ করে তিনি নিরন্তর কাজ করেছেন দুঃস্থ ও অসহায় মানুষ বিশেষ করে নারীর জীবন সাজাতে। অজস্র দুঃস্থ ও অসহায় নারীর হাতকে তিনি পরিণত করেছেন কর্মীর শক্তিশালী হাতে।

জাহানারা কটেজ ইন্ড্রাটিজ নামটি শুনে শিল্প প্রতিষ্ঠান মনে হলেও, মূলত এই প্রতিষ্ঠানে মানুষদের কর্মমুখী শিক্ষা প্রদান করা হয়। টাকার অংকে এই প্রতিষ্ঠানের মূলধণ স্বল্প হলেও, এই শিল্প প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ লক্ষ কোটিতে। হাজার হাজার নারী ও পুরুষকে তিনি কর্মক্ষম করেছেন। গড়ে দিয়েছেন জীবন ধারণের পথ। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ মরে যায়, মানুষের কর্ম ধ্বংস হয় না।

দেশীয় উপকরণকে যথাযথ সম্পদে রূপান্তরে তাঁর ছিল সিদ্ধ হাত। একটি বাঁশের ১২ ইঞ্চি টুকরা হতে তিনি ৬টি স্কেল, গ্লাস প্লেট এবং টুথপিক তৈরি করতে পারতেন। সম্পদের যথাযথ ব্যবহারে এ ধরনের অনেক যাদু তিনি শিখিয়েছেন তার অগণিত শিক্ষার্থীদের।

Jahanara Begum_01
দাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সাথে।

তিনি বিশ্বাস করতেন অর্থ মুখ্য কোন ব্যাপার নয়, প্রয়োজন চিন্তা, ইচ্ছা ও কাজের মনোবল।

জাহানারা বেগমের মতে, নারীদের অগ্রগতির জন্য শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তবে সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য শিক্ষা নয় বরং নিজকে আলোকিত করে এমন ধরনের শিক্ষা প্রয়োজন, যে শিক্ষা নারীকে আত্মবিশ্বাসী করে সেই কর্মমুখী শিক্ষা। নারীর বিকাশের জন্য সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।

পর্দানশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও, তাঁর সমাজ তাঁর কাজে কখনো বাধা হয়নি। পিতা মৌলভী নাসির উদ্দিন ও মাতা সুলতানা রেজিয়া বেগমের সহযোগিতায় কিশোরী বয়সে তিনি বাড়িতে গড়ে তোলেন মেয়েদের শিক্ষালয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পিতামাতাকে উদ্বুদ্ধ করতেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের পাঠাতে।

কোন কাজকেই তিনি ছোট মনে করতেন না। ছোট বড় সকল কাজেই তিনি সক্রিয়ভাবে এগিয়ে যেতেন। যাতে অন্য মানুষও কাজের প্রতি উৎসাহী হন। কাজ শেখার প্রতি ছিল তাঁর অফুরন্ত আগ্রহ, কাজ শেখার জন্য ছুটে গেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

অনেক মানুষকে বিভিন্ন কাজ করে দিয়েছেন নতুন একটি কাজ শেখার জন্য। নির্মাণের নেশায় নিজের হাতে বাড়ির মসজিদের দেয়ালের ইট গেঁথেছেন। নিজের বাড়ির ও স্কুলের দেয়াল গড়তে নিজেও কাজ করেছেন একজন নির্মাণ শ্রমিকের মতো।

Jahanara Begum_03
জাহানারা বেগম।

আজীবন কাজ করেও কাজের নেশা থামেনি জাহানারার । অসুস্থ হয়েও হুইল চেয়ারে বসে মেয়েদের কাজ শিখিয়েছেন। বার্ধক্য ও অসুস্থ্যতা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, মানুষ গড়ার এই কারিগর মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত মেয়েদেরকে কাজ শিখিয়েছেন।

তিনি বলতেন আমি শারিরীকভাবে অসুস্থ কিন্তু আমার মন ও চিন্তা অসুস্থ নয়, আমি মানুষের জন্য চিন্তা করতে পারি। বলতেন, নেতিবাচক নয় বরং ইতিবাচক ও দিকনির্দেশনামূলক কাজের সর্ম্পকে আলোচনা করা উচিত।

কুমিল্লা শহরের গাংচর এলাকায় জন্মগ্রহণকারী এই মহিয়সী নারী ২০১০ সালে ১৭ জানুয়ারী মানবতার তরে অর্পিত দায়িত্ব পালন শেষে ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

আজও দেশী বিদেশী গণ্যমান্য অগণিত ব্যক্তি কুমিল্লা শহরের নানুয়া’র দীঘির পাড়ের “জাহানারা কটেজ ইন্ড্রাটিজ” পরিদর্শন করেন।

লেখক:
M K Zakaria

এম কে জাকারিয়া, সাবেক বীমা কর্মকর্তা, লেখক

*প্রকাশিত এ লেখার তথ্য, মতামত, ভাষা ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই প্রকাশিত এ লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট