এই অঞ্চলে চলচ্চিত্র সংসদের গোড়াপত্তন করে আধুনিক এই শিল্পমাধ্যমটিকে চর্চার বিষয়ে পরিণত করেছিলেন মুহম্মদ খসরু। চলচ্চিত্র সংসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ছায়ানটের প্রথম সভাপতি, বিশিষ্ট সাংবাদিক, রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হক খসরু সম্পর্কে লিখেছেন,
খসরুর প্রচেষ্টায় চলচ্চিত্র সংসদ নিয়মিতভাবে সৎ ও শিল্পমানসম্পন্ন চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে শুরু করে। তখন বিদেশি সিনেমা যোগাড় করা ছিলো বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আর বিদেশি সিনেমা বলতে তখনকার শুধুমাত্র কিছু ভারতীয় এবং হলিউডের সিনেমার সাথে সাধারণ দর্শকদের পরিচয় ছিলো। খসরুর বাহিনী তখন বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সহযোগিতায় ল্যাটিন আমেরিকা, ইউরোপ থেকে শুরু করে আফ্রিকার অচেনা সব বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন। মুহম্মদ খসরুর রচনায় তাঁর বইতে লিখেছেন,
আর্থিক অসচ্ছলতা এবং নানাবিধ বাস্তব অসুবিধার দরুন সোসাইটি অন্যান্য কাজে সক্রিয় হতে না পারলেও এ পর্যন্ত (আগস্ট ১৯৬৮) সদস্যদের ৪৩টি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে পেরেছে।
মুহম্মদ খসরু সুস্থ চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য আন্দোলন এবং চলচ্চিত্রের রুচিশীল দর্শক তৈরীতে কাজ করেছেন নিরলসভাবে। সেই চেষ্টা তিনি ধরে রেখেছিলেন প্রায় অর্ধশত বছর ধরে।
মুহম্মদ খসরু একক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের তত্ত্বাবধানে নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন চলচ্চিত্র বিষয়ক সাহিত্যের বিশাল পাঠাগার। এই লাইব্রেরিতে চলচ্চিত্রবিষয়ক সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রকাশনা ছাড়াও রয়েছে দুষ্প্রাপ্য বই, ম্যাগাজিন, জার্নাল ইত্যাদি। তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন ঢাকার আজিজ মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোতে, সংগ্রহ করতেন দরকারি বইপুস্তক। চলচ্চিত্রকে বড় পরিসরে চর্চার স্বপ্ন নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফিল্ম স্টাডি সেন্টার।
এই পাঠাগারের প্রারম্ভ সম্পর্কে চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী ফারুক আলমগীর লিখেছেন যে ফিল্ম সোসাইটি গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা আনোয়ারুল হক খান ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পেশাগত কারণে সংসদের কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং
পয়ষট্টির প্রারম্ভকালেই তাঁর স্ত্রী-বিয়োগ ঘটে। তিনি নিজেও খুব ভেঙ্গে পড়েন। তবে সেই সময়ে সুপিরিয়র সার্ভিসের সদস্যরূপে প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক কমিশনে তাঁর পদোন্নতি ঘটলে তিনি তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তান চলে যান। চলচ্চিত্র সংসদের সঙ্গে তিনি আর যোগাযোগ রাখেননি। তবে চলচ্চিত্র সংক্রান্ত তাঁর সমস্ত সংগ্রহ ও লাইব্রেরি তিনি সংসদকে দিয়ে যান যা মুহম্মদ খসরু গ্রহণ করে মগবাজারের একটি বাসায় রাখার বন্দোবস্ত করে।
মুহম্মদ খসরুর চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ফলে অসংখ্য চলচ্চিত্র সংসদের পাশাপাশি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ‘বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ’। যা সম্ভব হয়েছে খসরুদের আন্দোলনের ফলেই।
সবাই সিনেমা বানায় আর মুহম্মদ খসরু বানিয়েছেন বিকল্প ধারার নির্মাতা। মুহম্মদ খসরু চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহীদের অনুপ্রেরণা উৎস ছিলেন। তিনি কোনো কিছুকে অযথা প্রশ্রয় দিতেন না, প্রচন্ড গালিগালাজ করতেন। তবে তাঁর গালিমন্দ সবকিছু ছিলো এই সিনেমাকে নিয়েই। মুখের উপর কঠোর-কঠিন সত্য বলতে পারা এই মানুষটি আমাদের দেশের বহু মেধাবী তরুণকে চলচ্চিত্রে ধরে এনেছেন যারা এখন জাতীয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোচিত। এখনকার চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে সামনের সারির কর্মী রয়েছেন যারা তাদের সবাই মুহম্মদ খসরুর শিষ্য।
এ প্রসঙ্গে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের এক মন্তব্যকে উদ্ধৃত করে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান লিখেছেন,
রুশ লেখকরা যেমন গোগলের ওভারকোট থেকে বেরিয়েছে, তেমনি আমরা সব বেরিয়েছি খসরু ভাইয়ের পকেট থেকে।
মুহম্মদ খসরু ছিলেন একজন ক্ষ্যাপাটে চলচ্চিত্রপ্রেমী, সিরিয়াস চলচ্চিত্রবোদ্ধা যা একদিনের একটি ঘটনায় প্রকাশ পায়। তারেক মাসুদকে একটা লেখা লিখতে দিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা মেরে দিয়েছিলেন। দরজার বাইরে থেকে বলেছিলেন, ‘’লেখা শেষ হলে তালা খুলে দেবো’’।
তিনি চলচ্চিত্র সংসদের কর্মীদের কখনও কখনও জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখাতেন। আবার গেটে দাঁড়িয়ে থাকতেন যাতে তারা সিনেমা দেখা ছেড়ে পালিয়ে না যায়। মূলত এই দেশে শিল্পগুণসম্মত চলচ্চিত্রের দর্শক এবং নির্মাতা তৈরির নেপথ্য কারিগর ছিলেন মুহম্মদ খসরু। তরুণদের উদ্দেশ্যে মুহম্মদ খসরু বলেছিলেন,
ফিল্মকে ভালোবেসে তবেই এই আন্দোলনে আসতে হবে। এখানে হিপোক্রেসির কোনো অবকাশ নেই।
মুহম্মদ খসরুর বাবার বাড়ি ঢাকার নিকটবর্তী কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরের মোহনপুর গ্রামে হলেও তিনি জন্মেছিলেন ১৯৪৬ সালে ভারতের হুগলী জেলায়। তাঁর বাবা ছিলেন হুগলী জুট মিলের কর্মকর্তা। পঞ্চাশের দশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে তাদের পরিবার ঢাকায় চলে আসেন। মুহম্মদ খসরু তাঁর শেষজীবন কাটিয়েছেন নিভৃতে, কেরানীগঞ্জের মোহনপুর গ্রামে। সংসারজীবনকে একেবারে বাতিলের খাতায় রেখে সারাজীবন সিরিয়াস চলচ্চিত্রচর্চাকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন।
মুহম্মদ খসরু বিসিকের ফটোগ্রাফার হিসেবে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানদের হাতে গড়া বিসিকে তাঁকে এক রকম জোর করেই ফটোগ্রাফার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু তাঁর ধ্যানজ্ঞান সবকিছু ছিলো চলচ্চিত্রকে ঘিরে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে তাঁর ছিলো অগাধ পড়ালেখা। লেখক, সম্পাদক, চলচ্চিত্রবোদ্ধা, আলোকচিত্রকর- এসব পরিচয় ছাপিয়ে তাঁর বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ চলচ্চিত্র সংগঠক।

ধ্রপদী ও চলচ্চিত্রপত্র। ছবি: কামরুল মিথুন
চলচ্চিত্র নিয়ে পত্র-পত্রিকায় সিরিয়াস লেখালেখি, গবেষণার কাজ শুরু হয়েছিলো ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি থেকে মুহম্মদ খসরু সম্পাদিত ‘ধ্রুপদী’ নামে চলচ্চিত্রের কাগজ প্রকাশের মাধ্যমে। চলচ্চিত্র মহলে নন্দিত ধ্রুপদী’কে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পত্রিকা বলা হয়ে থাকে। সর্বশেষ ২০০৬ সালে ধ্রুপদী ষষ্ঠ সংকলন হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। সেই পত্রিকাগুলোই এখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস হিসাবে সর্বজনস্বীকৃত। বাংলা চলচ্চিত্রের অপর পত্রিকা ‘চলচ্চিত্রপত্র’-ও বের করেন সম্পাদক মুহম্মদ খসরু। এছাড়াও বেশ কয়েকটি গ্রন্থের প্রণেতা তিনি।
মুহম্মদ খসরুর লেখা বই:
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন
বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ভূমিকা
সাক্ষাৎকার চতুষ্টয়
মুহম্মদ খসরু সম্পাদিত চলচ্চিত্রের পত্রিকা:
ধ্রুপদী
চলচ্চিত্রপত্র
ক্যামেরা যখন রাইফেল
‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ বিশেষ সংখ্যা
বাংলাদেশের প্রথম ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠারও অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন মুহম্মদ খসরু। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কাঠখড় পুড়িয়ে। আর্কাইভের প্রতিষ্ঠাতা কিউরেটর হিসেবে তাঁকে নিযুক্ত করতে সবাই একমত হয়ে তাঁর নাম প্রস্তাব করলেও শেষপর্যন্ত সেটা বাতিল হয়ে যায়, কারণ তাঁর নাকি কিউরেটর হওয়ার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই! এরপর তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের প্রশিক্ষক হিসেবেও কিছুকাল কাজ করেছেন।

মুহম্মদ খসরুর বই। ছবি: কামরুল মিথুন
ভারতের কেরালার চিত্রলেখা এবং ওডেসা ফিল্ম কো-অপারেটিভের অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগে ফিল্ম কো-অপারেটিভ গঠিত হয়েছিলো। এই কো-অপারেটিভের অর্থ দিয়েই বাংলাদেশের প্রথম স্বল্পদৈঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। মুহম্মদ খসরু চেয়েছিলেন ভারতের পুনের মতো ঢাকাতেও একটি চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। এজন্য তিনি পুনে থেকে বিখ্যাত বোদ্ধা সতীশ বাহাদুরকে বাংলাদেশে ডেকে এনেছিলেন এক প্রোগ্রামে। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও এমন কোনো ইন্সটিটিউট গড়ে তুলতে পারেননি। এরপরও বিভিন্ন সময়ে অন্য দেশ থেকে চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের ডেকে এনে আয়োজন করেছেন সেমিনার, ওয়ার্কশপের।
তার প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননা
চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশে দীর্ঘ ৫০ বছরের অবদানের জন্য হীরালাল সেন আজীবন সম্মাননা
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সুবর্ণ জয়ন্তী পদক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ-এর আজীবন সম্মাননা
চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন করতে গিয়ে তাঁর সাথে পরিচয় হয়েছিলো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রকারের। এর মধ্যে অনেকের সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন। ২০০৮ সালে ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার, শামা জায়েদী ও আদুর গোপাল কৃষ্ণানের সাথে তাঁর কথোপকথন ‘সাক্ষাৎকার চতুষ্টয়’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিলো।
১৯৭৫ সালে ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার রাজেন তরফদার পরিচালিত ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র ‘পালঙ্ক’-তে মুহম্মদ খসরু সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। নিজের চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন, হাসান আজিজুল হকের লেখা ‘নামহীন গোত্রহীন’ অবলম্বনে একটি চিত্রনাট্যও তৈরি করেছিলেন অনেকদিন আগে। রাষ্ট্রীয় অনুদানের জন্য জমাও দিয়েছেন দুবার, কিন্তু অনুদান পাননি। তাই শেষপর্যন্ত অর্থাভাবে নির্মাণ হয়নি তাঁর বহুল প্রতিক্ষিত সিনেমাটির।

নিজের লাইব্রেরিতে মগ্ন। ছবি: কামরুল মিথুন
বাংলাদেশে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণেও অবদান রাখা মুহম্মদ খসরু কখনও প্রাপ্তির আকাংখ্যায় নয় তাঁর কাছে চলচ্চিত্র ছিল তার প্রেয়সী যাকে তিনি শুধুই ভালোবেসে গেছেন নিশর্ত। তাই আজও তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র চর্চার ইতিহাসে অমর হয়ে রয়ে গেছেন। বেঁচে রয়েছেন এদেশের শত চলচ্চিত্র সংসদকর্মী ও চলচ্চিত্র যোদ্ধাদের অন্তরে।
ফিচার ইমেজ: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত