বাসনার দ্বীপ
এতসব চিৎকার, চেঁচামেচি আর দৌড়ঝাঁপ
এতকিছুর মাঝখানে বসেও
কী করে নিঃসঙ্গ জীবনতরী
নিস্তরঙ্গ বেয়ে চলতে হয়, তা শিখে নাও।
মনে রেখো, নিকষ কালো অন্ধকার
তারও আছে এক নিঃসীম শান্ত হৃদয়।
নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পিত না করেও
কী ক’রে চারপাশের জীবন্ত শরীরগুলোর সাথে
যথাসম্ভব সদ্ভাব বজায় রেখে চলতে হয়,
সেইটিও শিখে নিও।
যাকে সত্য বলে জানো ও মানো,
তাকে নিরুত্তাপ-অকপট স্পষ্ট উচ্চারণে বলে ফেলো।
অন্যদেরকেও শোনো উৎকর্ণ-মনসংযোগে,
এমনকি নির্বোধ অর্বাচীনদেরকেও-
তাদেরও তো এক একটা নিজস্ব গল্পের ঝাঁপি আছে খোলা।
অহেতুক চিৎকারপ্রবণ বা দাপুটে-রূঢ় মানুষদের
এড়িয়ে চলতে শেখো।
এঁরাও এক ধরণের নাশকতাকারী –
তোমার অমল ধবল আত্মা ও আয়ু
দুইয়েরই বিনাস সাধন করে!
নিজেকে নিরঙ্কুশ মেলে ধরো
চারপাশের জগতের মাঝখানে,
দেখবে ধোওয়া তুলসীপাতা নও তুমি নিজেও –
অমধুর বা অম্লমধুর স্বাদ তোমাতেও পাবে তুমি;
তোমার চেয়েও ঢের অগ্রসর এবং
নিশ্চিত অনগ্রসর মানুষে লোকারণ্য দশদিক।
যতটুকু অর্জন তোমার তাকে উপভোগ করো-
সঙ্গে তোমার আর সব পরিকল্পনাগুলিকেও
আমলে নিও।
আত্ম-অনুসন্ধানে আর পেশাগত উন্নয়নে
মনযোগী থাকো, যতটা সম্ভব বিনয়কে সাথে নিয়ে –
কারণ সৌভাগ্যের যাঁতাকলে ঘূর্ণায়মান
নিয়ত পরিবর্তনশীল এই ধূর্ত সময়কালে
বিনয় এক পরম সম্পদ।
ব্যবসাপাতি আর বাণিজ্যনীতিতে সতর্কতা
নিত্যসঙ্গী হোক তোমার-
মনে রেখো, এই দুনিয়া এক ধূর্ত-বেনিয়া,
ফেরেববাজ আর কুলাংগারে ভরা-
তারপরেও ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’
কিংবা ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই,
পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন’ তত্বকে ভুলে যেও না।
মনে রেখো, এই পৃথিবী স্বপ্নদ্রষ্টা আর স্বপ্নাবিষ্ট
বীর-বীরাঙ্গনাদের দখলেই ফিরে যাবে একদিন,
যাদের রক্তের লোহিত কণিকায় সতত বহমান
মহৎ জীবন আর উন্নত জীবনের অমোঘ নেশা।
নিজেকে মিথ্যা জাহির করবার
কোনোই দরকার নাই তোমার;
মমতা মাখানো রঙ্গমঞ্চে
লোক দেখানো স্নেহ আর প্রেম-ভালবাসার
মনগড়া মিথ্যা অনুভব ইত্যাদিকে
তড়িৎ বর্জন করো;
এইগুলি কেবলই পতিত শুষ্ক-অনুর্বর জমিতে
অবাঞ্চিত বাড়ন্ত ঘাস,
কিংবা ব্যাঙের ছাতার মতই গজিয়ে ওঠা
স্বপ্নভঙ্গ-বেদনার নীল বাষ্প।
জীবনকে অতীত অভিজ্ঞতার মূলমন্ত্রে
দীক্ষিত ক’রে তোলো;
যৌবনের গ্লানিমাখা অধ্যায়গুলিতে
ছড়িয়ে দাও পুষ্পের সুবাস।
আত্মার শক্তিতে বলীয়ান হও,
আকস্মিক দুর্ভাগ্যকে তখনই জয় করতে শিখবে;
অযথাই অন্ধ-কল্পনার দৌরাত্ম্যে
নিজের সত্তাকে কলংকিত ক’রো না;
মনে রেখো, ক্লান্তি-অবসাদ আর ভয়ঙ্কর একাকীত্ব
থেকেই জন্ম নেয় সীমাহীন ভয়।
কড়া নিরাপত্তা বলয় বা শৃঙ্খলিত বেষ্টনীকে ভেদ ক’রে
নিজেকে এক পশলা স্বস্তি এনে দাও,
তুমি এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডেরই এক নিঃসঙ্গ সন্তান-
একটি বৃক্ষ বা একটি নক্ষত্রের চেয়ে
কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নও তুমি,
এই ধরাধামে তোমারও রয়েছে সমান অংশীদারিত্ব।
জীবনের এই সহজ সমীকরণটুকু
তোমার বোধ-সীমার ভেতরে থাকুক বা নাই থাকুক,
বিশ্বপ্রকৃতির তাতে কিচ্ছু এসে যায় না;
অবারিত তার গবাক্ষ ও দ্বার।
স্রষ্টা – তাঁকে যে রূপেই দেখতে ভালবাসো তুমি,
তাঁর সাথে তোমার বোঝাপড়াটাও হোক শান্তিময়-
সরল উপপাদ্যের মতো।
জীবনের দুর্বোধ্য কর্কশ ব্যঞ্জনার মাঝেও
তোমার সকল শ্রম-সাধনা আর বাসনার বিপরীতে
আত্মার শান্তি প্রতিষ্ঠিত করো;
জীবনের সকল ভ্রান্তি-প্রতারণা,
পন্ডশ্রম আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনার ভেতরেও
পৃথিবী অকাতরেই বিলিয়ে যায় তার
আলোকিত সৌন্দর্য, বিরামহীন আনন্দধারা।
ফূর্তিতে, স্ফূর্তিতে সেই আনন্দ বিউগল-ধ্বনি
কান পেতে শোনো,
নিমেষেই পৌঁছে যাও
তোমার সেই কাঙ্ক্ষিত বাসনার দ্বীপে।।
[‘Desiderata’ – Original Poem by Max Ehrmann (1872-1945)]

হে মৃত্যুঞ্জয়ী
যখন তোমার মৃত্যু হলো
যখন তোমার কফিন কাঁধে
আমরা এগিয়ে গেলাম তোমার সমাধির পানে-
আমাদের ভুলেও মনে হয়নি
এই পৃথিবীর একবিন্দু মায়াও তোমাকে
জড়িয়ে আছে তখনো।
আমরা তো কাঁদিনি, বিলাপ করিনি,
কষ্টে আড়ষ্ট হয়েও পড়িনি;
তুমি তো আর পতনশীল ছিলে না
বিভীষিকাময় কোনো মৃত্যু গহবরে।
তোমার শবযাত্রায় সামিল হয়ে
তোমাকে হারানোর বেদনায়
আমরা কান্না আর শোকে মুষড়ে পড়িনি।
তোমার প্রস্থান রহিত হয়ে গিয়েছিলো সেইদিনই চিরতরে-
যখন মৃত্যু তোমাকে পৌঁছে দিলো এক অনন্ত প্রেমের দ্বারে।
সাদা কাফনে জড়ানো তোমার নিশ্চিত নিশ্চিন্ত কফিন,
আমরা কোনো বিদায় সম্ভাষণ জানাতে আসিনি সেদিন;
তোমার কফিনের ওপাশেই পর্দার আড়ালে অপেক্ষমান
দেখেছি জান্নাতের পাদদেশ বেয়ে বহমান চকচকে নহর।
কবরের নিঃসীম নিরবতার মাঝে
তুমি দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গিয়েও
সগর্বে সদর্প উত্থানে জেগে ওঠো বারবার;
যেমন করে চাঁদ আর সূর্য অস্তাচলে হারিয়ে গিয়েও
প্রতিদিন আলোকসজ্জায় মাতিয়ে রাখে দশদিক।
নিয়ত উদীয়মান দোর্দন্ড প্রতাপশীল সূর্যের মতোই
তোমারও শুরু আছে শেষ নেই;
তুমি সততই অনাবিল প্রত্যুষের মহিমা।
কেবল সাড়ে তিন হাত ভেজা মাটির চৌহদ্দিতে বন্দী,
অথচ প্রাণশক্তিতে ভরপুর
মুক্ত বিশুদ্ধ অক্ষয় এক বিহঙ্গ-আত্মা।
দো-আঁশ আর পলিমাটির পরম মমতায়
নিঃসঙ্গ পতিত একটি বীজদানাও
যেমন করে আলোর মুখ দেখে বেড়ে ওঠে,
সমাধির ভাঁজে ভাঁজে তেমনি এক মনুষ্য-বীজকণা তুমি;
তোমার সফল উত্থানকে তবে অস্বীকার করি কিসের জোরে।
দড়ি সমেত কূপের তলদেশে নামিয়ে দিলে
যেমনি করে নিশ্চিত ভরে ওঠে শূন্য বালতি,
তেমনি পূনঃপ্রত্যাবর্তনশীল তোমার বিদেহী আত্মা-
তার শোকে তবে কেনো মাতম ছড়িয়ে
মূহ্যমান হতে হবে আমাদের।
মুখে কপাটিকা লাগিয়ে এসো
রুদ্ধদ্বার করে ফেলি যতসব নিস্ফল বয়ানের ঝাঁপি-
আমাদের অবিনশ্বর আত্মারা তখন
তোমার চিরন্তন বাণীতে নির্নিমেষ
বাঙ্ময় করে তুলবে এই বিশ্বচরাচর।
[‘When You Die’ – An adaptation from the Persian Poet Jalal Uddin Rumi.]

লেখক:
খন্দকার ওমর আনোয়ার, কবি