গণমানুষের হৃদয়ে যার আবাস তিনি নাজিম হিকমত

Comments

বাম আদর্শের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বাংলাদেশে এমন কোনো লোককে খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের কবিতা পড়েননি বা শোনেননি। বিপ্লবী কবিতা লিখে দেশে দেশে যারা গণমানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন, নাজিম হিকমত তাদের অন্যতম।

Nazim Hikmet_05A

নাজিম হিকমত রন

জেলখানার কবি তিনি। সারাটা জীবন তিনি সাধারণ মানুষের জন্য লড়েছেন, জ্বালাময়ী সব কবিতা লিখেছেন, আন্দোলন করেছেন। মানুষের অধিকার আদায় আর শ্রেণী-বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জীবনের বেশিরভাগ সময় তাঁকে কাটাতে হয়েছে জেলে। নাজিম হিকমত শুধু তুরস্কের কবি নন, তিনি পৃথিবীর কবি, সমস্ত শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কবি। তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে পৃথিবীর নানা দেশে, নানা ভাষায়। বাংলা ভাষায়ও ব্যতিক্রম নয়।

বাংলাদেশে নাজিম হিকমতের জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। কবিতা ভক্তদের অসম্ভব প্রিয় তিনি। তাঁর ‘জেলখানার চিঠি’ কবিতাটিতো মনে হয় অনেক কবিতাপ্রেমীরই মুখস্ত। প্রায় সব আবৃত্তিকারই তাঁর কবিতা আবৃত্তি করার জন্য রীতিমত মুখিয়ে থাকেন। বাংলাতে নাজিমের শ্রেষ্ঠ কিছু কবিতার অনুবাদ করেছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সাহিত্যের যে কোনো শাখার অনুবাদই অসম্ভব রকমের দুরূহ এক কাজ। এক ভাষায় যে জিনিস অসম্ভব আকর্ষণীয়, কুড়কুড়ে বা মুড়মুড়ে, অন্য ভাষায় রূপান্তরের পরেই তা প্রায়শই হয়ে পড়ে একেবারে ম্যাড়মেড়ে পানসে। সাহিত্যের অন্য যে কোনো শাখার চেয়ে কবিতার ক্ষেত্রে এই অবনমন হয় সবচেয়ে বেশি। অনুবাদ দিয়ে আসল কবিতার আসল রূপ-রস ছন্দের সামান্য একটু অংশই পাওয়া যেতে পারে মাত্র। তার বেশি আশা করাটা একেবারে বাতুলতা মাত্র। বিভিন্ন লোকজনের করা হিকমতের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে দেখেছি। বড়ই বিবর্ণ সেগুলো। সেই তুলনায় নাজিমের কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে সুভাষ মুখোপাধ্যায় সকল আশা-প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। নিজে বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন কবি হবার কারণে তাঁর অনুবাদ, অনুবাদের নিরস জলো জলো পর্যায় ছাড়িয়ে মৌলিক কবিতার অসামান্য শৈল্পিক স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ নিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। এরকম উত্তুঙ্গ মানের অনুবাদ করতে শুধুমাত্র একজন শ্রেষ্ঠ কবিই পারেন আরেকজন শ্রেষ্ঠ কবির কবিতার ক্ষেত্রে। আশ্চর্য হতে হয় যখন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন যে, ‘নাজিমের কবিতা দিয়েই শুরু হয়েছিল আমার কবিতার অনুবাদের হাতেখড়ি’।

Nazim Hikmet_04

নাজিম হিকমত

১৯০২ সালে তুরস্কের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে নাজিম হিকমতের জন্ম। অল্প বয়সেই কবিতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। মাত্র সতের বছর বয়সে তাঁর লিখা কবিতা প্রকাশিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে মিত্রবাহিনী অধ্যুষিত তুরস্ক ছেড়ে মস্কো চলে যান তিনি। এ সময়ে রুশ কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। হিকমত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর কবিতা আরো জোরালো ও প্রতিবাদী হয়ে উঠতে থাকে। ১৯২৪ সালে তুরস্কের স্বাধীনতার পর তিনি ফিরে আসেন। একটি বামপন্থি পত্রিকায় কাজ করার অপরাধে তিনি গ্রেফতার হন। কিন্তু হিকমত মস্কোয় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং সেখানে কবিতা এবং নাটক লিখতে থাকেন।

নাজিম হিকমতের কবিতা
আমি জেলে যাবার পর – পড়ুন এখানে

নাজিম হিকমতের কবিতা
জেলখানার চিঠি – পড়ুন এখানে

১৯২৮ সালের এক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কারণে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন কবি। কমিউনিস্ট পার্টি ততদিনে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়ে গিয়েছে। সারাক্ষণই সাদা পোশাকের পুলিশের লোকজন তাকে নজরদারিতে রাখতো। পরের দশ বছরের পাঁচ বছরই তিনি নানা ধরনের বিচিত্র সব হাস্যকর অপরাধের অভিযোগে জেলখানায় কাটান। কিন্তু এই দশ বছরেই তিনি সুদীর্ঘ কবিতাসমৃদ্ধ চারটি বইসহ সর্বমোট ৯টি কবিতার বই প্রকাশ করেন। এই সমস্ত কবিতা তুরস্কের কবিতায় বিপ্লব সাধন করে। তুরস্কের প্রধানতম কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান তিনি।

Nazim Hikmet_03

নাজিম হিকমত

১৯৩৮ সালে তুরস্কের সামরিকবাহিনীকে বিপ্লবে উস্কানি দেবার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাকে। তার অপরাধ ছিল তার দীর্ঘ কবিতাগুলো মিলিটারি ক্যাডেটরা পড়ছে এবং এতে করে তাদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা জন্ম নিচ্ছে। ২৮ বছরের জেল সাজা দেয়া হয় তাকে। ১৯৪৯ সালে পাবলো নেরুদা, পল রবসন এবং জ্যা পল সার্ত্রে প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করেন। উদ্দেশ্য ছিল হিকমতের মুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা। ১৯৫০ সালে পাবলো নেরুদার সাথে যৌথভাবে বিশ্ব শান্তি পুরস্কার লাভ করেন হিকমত। এই বছরেই আঠারো দিনের আমরণ অনশনে যান তিনি।

তুরস্কে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসায় মুক্তি পান ঠিকই, কিন্তু তার যন্ত্রণার অবসান ঘটে না। দুই দুইবার তাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। পঞ্চাশ বছর বয়সে রাশিয়ান সীমান্তে সামরিক দায়িত্ব পালন করানোর চেষ্টা করা হয় তাকে দিয়ে। এইসব যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাবার জন্য ছোট্ট একটা মোটর বোটে করে বসফরাস পাড়ি দিয়ে বুলগেরিয়া হয়ে রাশিয়াতে পালিয়ে যান তিনি। পরের বছরই তুরস্ক সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে। ১৯৬৩ সালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মস্কোয় মৃত্যুবরণ করেন এই মহান কবি।

Nazim Hikmet_07

নাজিম হিকমত

ইতিহাসের কী চরম লীলাখেলা। পঞ্চাশ বছর আগে যাকে বিশ্বাসঘাতক বলে রায় দিয়ে নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল তুরস্ক সরকার, সেই তাকেই আবার সসম্মানে মরণোত্তর নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়ে ধন্য হয়েছে তুরস্ক সরকার। ২০০০ সালে পাঁচ লাখ তুর্কি নাগরিক সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিল নাজিম হিকমতের নাগরিকত্ব পুনর্বহালের জন্য এবং তার দেহাবশেষ মস্কো থেকে তুরস্কে ফিরিয়ে আনার জন্য। তখন সে আবেদনে সাড়া দেয়া ছাড়া তুরস্ক সরকারের কিছু করারও ছিল না। নাজিম হিকমতের তুরস্ককে কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু তুরস্কের নাজিম হিকমতকে যে বড়ই প্রয়োজন। নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেবার প্রতিক্রিয়া হিসাবে তুরস্কের ডেপুটি মিনিস্টার কেমিল সিচেক বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাজিম হিকমতের বিষয়ে সরকারের মনোভাব পরিবর্তনের এটাই সময়। যে অপরাধের জন্য সরকার তাঁর নাগরিকত্ব সেই সময়ে বাতিল করেছিল, সেই অপরাধ এখনকার যুগে আর কোনো ধরনের অপরাধের পর্যায়েই পড়ে না।’

নাজিম হিকমত শিল্পকে জীবন থেকে আলাদা করেননি। জীবন আর শিল্পের মাঝে কোন ফারাকও করেননি তিনি। বরং যে শিল্প জীবনকে প্রতিনিধিত্ব করে, জীবনকে প্রতিফলিত করে সেই শিল্পই আসল শিল্প বলে মনে করেছেন তিনি। ফলে তার কবিতায় মানুষের জীবন উঠে এসেছে শৈল্পিকসমৃদ্ধতায়। নাজিমের নিজের ভাষাতেই, ‘সেই শিল্পই খাঁটি শিল্প, যার দর্পণে জীবন প্রতিফলিত। তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে যা কিছু সংঘাত, সংগ্রাম, প্রেরণা, জয়-পরাজয় আর জীবনের ভালবাসা। খুঁজে পাওয়া যাবে একটি মানুষের সব কটি দিক। সেই হচ্ছে খাঁটি শিল্প, যা জীবন সম্পর্কে মানুষকে মিথ্যা ধারণা দেয় না।’

Nazim Hikmet_Signature

কবির স্বাক্ষর

লেখক:
মাহবুবুর রহমান শিপন, লেখক, মানবাধিকার কর্মী
সৌজন্য: সাপ্তাহিক একতা

নাজিম হিকমতের কবিতা
আমি জেলে যাবার পর – পড়ুন এখানে

নাজিম হিকমতের কবিতা
জেলখানার চিঠি – পড়ুন এখানে

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.