গিভ পিস আ চান্স

Comments

‘ইমাজিন’ গানের মাধ্যমে যিনি স্বপ্নের শান্তির পৃথিবীর কথা জানিয়েছিলেন তিনি জন উইনস্টন ওনো লেনন ওরফে জন লেনন। ১৯৪০ সালে ৯ অক্টোবর জন লেনন যখন জন্ম নেন, অক্সফোর্ড ম্যাটারনিটি হাসপাতালের আশপাশ জুড়ে তখন চলছে জার্মান বিমান হামলা। আকাশ থেকে ক্রমাগত বোমাবর্ষণের মধ্যেই জন্ম হয় ইতিহাসের অন্যতম সেরা সংগীত তারকার।

তাঁর প্রথম ব্যান্ড ছিল ‘দ্য কোয়ারিমেন’। এরপর ১৯৬০ সালে বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘বিটলস’। কিন্তু ১০ বছর পর ১৯৭০ সালে ভেঙে যায় বিটলস। এরপর গায়ক হিসেবে সলো ক্যারিয়ার শুরু করেন লেনন। ষাটের দশকেই প্রথমে জড়িয়ে যান প্রগতিশীল ধারার সঙ্গে যা বজায় ছিল সত্তরের দশকেও। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ইয়োকো ওনোকে বিয়ে করেন।

বিয়ের পরপরই ১৯৬৯ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে তারা দুজন ‘বেড-ইন ফর পিস’ (bed-in for peace) গ্রহণ করেন। এরপর জুন মাসে তারা দ্বিতীয় বারের মত বেড-ইন গ্রহণ করেন এবং সেখানেই গাইলেন সেই বিখ্যাত গান ‘গিভ পিস আ চান্স’। গানটি ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হতে অগণিত মানুষকে উৎসাহ যোগায় যার ফলাফলে ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে ওয়াশিংটনে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের মুখে একসাথে উচ্চারিত হয় গানটি। এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে  ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্রিটিশদের সম্মতির প্রতিবাদে মাঠে নামেন।

জন-লেনন-john-lenon-bangalianaa

বেড-ইন ফর পিস

জন-লেনন-john-lenon-bangalianaa

অক্টোবরে ওয়াশিংটনে বিশাল জনসমুদ্র

জন লেনন - john lenon - bangalianaa (5)

যুক্তরাষ্ট্রে লেননের যুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় ক্ষুব্ধ হয় নিক্সন প্রশাসন। নানাভাবে হয়রানি করার পাশাপাশি তাকে জোর করে নিজ দেশ ব্রিটেনে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। দীর্ঘ এক আইনি লড়াই শেষে মার্কিন সরকারের সব অপচেষ্টা বিফল করে দিয়ে ১৯৭৬ সালে যুক্ত্ররাষ্ট্রের গ্রীন কার্ড লাভ করেন লেনন।জন লেনন - john lenon - bangalianaa (2)

১৯৬৯ সালে বিটলসের ‘রেভল্যুশন’ অ্যালবাম বের হওয়ার পর লেনন বামপন্থী হিসেবে যোগদান করতে চেয়েছিলেন। লেননের সঙ্গে সে সময় তারিক আলীর বেশ ওঠাবসা ছিল। তারিক আলী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বাম ঘরানার একজন প্রভাবশালী ব্রিটিশ নাগরিক। লেখক, সাংবাদিক এবং চলচ্চিত্রকার আলী অতি বাম ঘরানার চিন্তা-চেতনা এবং ভাবনা নিয়ে লেননের একটি সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারের পরই লেনন বাম আন্দোলন নিয়ে একটি গান লিখেছিলেন এবং গেয়েছিলেন, যে গানের প্রথম লাইন ছিল ‘পাওয়ার টু দ্য পিপল’।

১৯৭২ সালে ব্রিটিশদের থেকে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবিতে চালানো আন্দোলন লেননকে আলোড়িত করে। তিনি এই প্রতিবাদে সতীর্থ ছিলেন। স্ত্রী ইওকো ওনোকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন আয়ারল্যান্ডে। লাল টি-শার্ট পরা লেননের উঁচু হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘আয়ারল্যান্ডের জন্য, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে।’

জন লেনন - john lenon - bangalianaa (8)

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আয়ারল্যান্ডে জন ও ওনো

লেননের ইংল্যান্ড ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল, মূলত ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থা। এ ছাড়া ওনোকে ঘিরে সৃষ্ট হওয়া বর্ণবাদী সমালোচনা।

জন লেনন - john lenon - bangalianaa (14)

জন ও ওনো সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখা

বিতর্ক ছিল লেননের নিত্যসঙ্গী। একবার মন্তব্য করে বসলেন, ‘জনপ্রিয়তায় বিটলস যীশু খ্রীস্টকেও ছাড়িয়ে গেছে’। সমালোচনার ঝড় ওঠে পশ্চিমা বিশ্বে। পরিস্থিতি সামাল দিতে লেনন বলেন, তিনি কোনো সম্প্রদায়কে আঘাত করতে এমন মন্তব্য করেননি। তাতেও নেভানো যায়নি ক্ষোভের আগুন। বিটলসকে নিষিদ্ধ করার জন্য আন্দোলন হয়। লেননের গানের রেকর্ড কিনে জনসমক্ষে পোড়ানোর ঘটনাও ঘটে। এ নিয়েও জন লেননের মন্তব্য ছিল ‘অন্তত পোড়ানোর জন্য হলেও, তারা আমার রেকর্ড কিনছে।’জন লেনন - john lenon - bangalianaa (9)

জন লেনন - john lenon - bangalianaa (1)

বিটলসের বিরুদ্ধে আন্দোলন

জন লেনন - john lenon - bangalianaa (6)

বিটলসের অ্যালবাম  পোড়ানো হচ্ছে

লেননের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে অনেক সময় কথা উঠলেও তাঁর ছায়াসঙ্গী ইওকো ওনোর মতাদর্শ কিন্তু সে তুলনায় আড়ালেই রয়ে গেছে। শিল্পচর্চা এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ওনো প্রগতিশীলতার ছাপ রেখে গেছেন। লেননকে বুঝতে হলে ওনো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সত্তরের দশকে লেননের চিন্তা-ভাবনায় স্পষ্টভাবেই ছায়া ফেলেছিলেন ওনো।

ব্রিটেন থেকে ২০০৫ সালে প্রকাশিত ‘জন’ গ্রন্থে লেননকে নিয়ে বিভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম স্ত্রী সিনথিয়া। লিভারপুল কলেজ অব আর্টে পড়াশোনা করতে গিয়ে সহপাঠী জন লেননের সঙ্গে পরিচয়, প্রেম, বিয়ে, সংসার, সন্তান ও বিবাহ-বিচ্ছেদ। সিনথিয়ার চোখের সামনেই বেড়ে উঠেছেন লেনন। সিনথিয়া তার বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন; “জন বলেছিল, ‘আমার যদি কখনও কিছু হয়ে যায়, তুমি তাহলে সাদা পালকের উড়াল দেখো, আর বুঝে নিও আমিই সেটা, তোমাকে দেখতে এসেছি।’  জনের কথা যখন ভাবি, তখনই একটা সাদা পালক দেখি আমি। আজব এক মানুষ ছিল সে; গুণী, দ্বিধাগ্রস্ত, সৃষ্টিশীল এক মেধাবী যে গেয়ে গেছে ভালোবাসার গান; আর নিজের ঘনিষ্ঠ মানুষগুলোকে অহরহ করে গেছে ক্ষত-বিক্ষত।”

জন লেনন - john lenon - bangalianaa (4)

জনের সাথে প্রথম স্ত্রী সিনথিয়া

প্রগতিশীলতার সাথে নিজেকে জড়ানোর প্রসঙ্গে জন বলেন, অল্প বয়সে সাফল্য জুটে গেছে বলে আমি বেঁচে গেছি। তারমানে বাদবাকি জীবনে সত্যি সত্যি যা আমি করতে চাই, তা-ই করতে পারি।  শুধু সাফল্যের জন্য গোটা জীবন বরবাদ হয়ে যাওয়াটা সাংঘাতিক।’

সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর মন্তব্য ছিল, “আমাদের সমাজ কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষের দ্বারা পরিচালিত। কিছু পাগলের নেতৃত্বে আমরা চলছি। আমি মনে করি আমার এই মন্তব্যের জন্য সমাজ আমাকেই উদ্ভট বলবে।”

গিটার হাতে যারা পৃথিবীতে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে গানকে হাতিয়ার করে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর সঙ্গীতকে নিয়ে গেছেন মানবিকতার ভিন্নমাত্রায়, তাদেরই একজন জন লেনন। যার স্বপ্ন ছিল যুদ্ধহীন, বর্ণহীন, বৈষম্যহীন এক সুন্দর পৃথিবীর। মানুষকে স্বপ্ন দেখার আহ্বান করা, নিজে স্বপ্ন দেখাই লেননের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। নিউইয়র্কে লেননের এপার্টমেন্টের বাইরে সেন্ট্রাল পার্ক ওয়েস্ট এক পাগল ভক্তের পরপর চারবার গুলিতে অকাল মৃত্যু হয় তাঁর।

তথ্যসুত্র :

  • John Lennon and the Mercy Street Cafe
  • জন লেননের রাজনৈতিক পরিচয়, ntvbd.com
  • আমার জন লেনন, রুদ্র আরিফ 

বাঙালীয়ানা/এমএ/এসএল

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.