বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম নৃশংস সহিংসতার ঘটনা হচ্ছে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। ঐ ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শনিবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে মঞ্চ ও তার আশেপাশে জমায়েত হয়েছিলেন দলের সিনিয়র নেতা আর সামনে ছিলেন শতশত মধ্যসারির নেতা আর কর্মী। দলটির সভানেত্রী এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন ঐ সমাবেশের প্রধান অতিথি।
আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে রাস্তায় একটি ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। বিকেল তিনটা থেকে দলটির কিছু মধ্যম সারির নেতা বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। বিকেল চারটার দিকে শুরু হয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের বক্তব্য দেয়ার পালা। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা তখনও এসে পৌঁছোননি। দলের নেতা-কর্মী এবং সমর্থকরা শেখ হাসিনার বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় ছিলেন।
আওয়ামী লীগ নেত্রী এলেন, কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি বক্তব্য দেয়া শুরু করলেন। বক্তব্য শেষ হবার সাথে সাথে হঠাৎ করে বিকট শব্দ। চারপাশে চিৎকার। দফায়-দফায় বিস্ফোরণের শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে উঠল।
সমাবেশে উপস্থিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা প্রথমে বুঝতেই পারেননি যে এটি ছিল গ্রেনেড হামলা। অনেকেই ভেবেছিলেন বোমা হামলা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে আঁচ করেছিলেন।
যখন গ্রেনেড হামলা শুরু হয়, তখন মঞ্চে বসা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা শেখ হাসিনার চারপাশ ঘিরে মানব ঢাল তৈরি করেন – যাতে তাঁর গায়ে কোন আঘাত না লাগে। নেতা-কর্মীরা জীবন দিয়ে তাঁর জীবন রক্ষা করেছিলেন সেদিন। শেখ হাসিনাকে ঘিরে যারা মানব ঢাল তৈরি করেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। মোহাম্মদ হানিফের মাথায় গ্রেনেডের আঘাত লেগেছিল। পরবর্তীতে ২০০৬ সালের শেষ দিকে তিনি মারা যান।
২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলার পর বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউতে পরে ছিল শুধু ছেড়া কাগজ, জুতা, স্যন্ডেল আর অবিস্ফোরিত গ্রেনেড। ১২টির বেশি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়েছিল। আরো কয়েকটি গ্রেনেড অবিস্ফোরিত অবস্থায় পড়ে ছিল। ঐ গ্রেনেড হামলায় সেদিন আইভী রহমানসহ ২৪জন নিহত হয়েছিলেন আর আহত হয়েছিলেন আরও অনেকে।

আওয়ামী লীগের ঐ সমাবেশের খবর সংগ্রহ করতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন সংবাদকর্মী হাসান মাসুদ। ঘটনার ভয়াবহতায় রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যাওয়া হাসান মাসুদ গ্রেনেড হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন: “আমি প্রথম যে দৃশ্যটা সেখানে দেখেছিলাম তা আইভি রহমানের। আমি ওনাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। উনি বসা, চোখ দুটো খোলা, নির্বাক। ঠিক মঞ্চের সামনে দু’পাশে দু’জন লোক তাকে ধরে রেখেছে।” “আইভী রহমানকে দেখে আমি ঘটনার ভয়াবহতা বুঝে গেলাম। মঞ্চের চারপাশে প্রচুর স্যান্ডেল-জুতা পড়ে ছিল। প্রচুর নিহত ও আহত মানুষ ছিল চারপাশে। কারো হাত নাই, কারো পা নাই।”
গ্রেনেড হামলায় আহত অনেকেই এখনও শরীরে আঘাত নিয়ে বেঁচে আছেন। আহতদের অনেকের শরীরে এখনও গ্রেনেডের শতশত স্প্লিনটার রয়েছে। শরীরের ভেতর এসব স্প্লিনটার নিয়ে যন্ত্রণা-কাতর জীবন পার করছেন তারা। দীর্ঘ চিকিৎসার পর অনেকেই এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি।
২১ আগস্টের হামলার সময় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আহতদের সাহায্যে এগিয়ে না এসে পুলিশ উল্টো তাদের হেনস্থা করেছে। আওয়ামী নেতা-কর্মীরা যখন আহতদের সাহায্য করছে, ঠিক সে সময় পুলিশ টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ ও তাদের গ্রেফতার করতে শুরু করে।
গ্রেনেড হামলার সেই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে দুই প্রধান দলের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ততর হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যকার রাজনৈতিক সম্পর্ক অবনতির একটি বড় কারণ হচ্ছে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। গ্রেনেড হামলার ঘটনা দুই দলকে আরও বেশি বিপরীত মেরুতে ঠেলে দিয়েছে।
গ্রেনেড হামলার সময় এবং তারপরের তদন্ত নিয়ে পুলিশের নিস্ক্রিয়তায় প্রশ্ন উঠেছিল তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে। জজ মিয়া নামের এক সাধারণ ব্যক্তিকে দিয়ে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার বিষয়টি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।
২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এবং ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে পুনরায় তদন্ত হয়।
১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সংঘটিত বিভিন্ন হামলা মামলার প্রধান আসামি হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী (হুজি-বি)-র নেতা মুফতি হান্নান পুলিশ রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এবং পরবর্তীতে জবানবন্দীতে বলেছে, শেখ হাসিনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা অনেক বড় জায়গা থেকে এসেছে। সে কেবল তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে। ‘বড় জায়গা’ সম্পর্কে আদালতে বলে, ২০০০ সালের জুলাই মাসে হুজির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে শেখ হাসিনাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। আর, ২১ আগস্ট হামলার ঘটনায় তৎকালীন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপির নেতা তারেক রহমানের সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছে বলেও উল্লেখ করে।
ঐসব তদন্তে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে ও বিএনপি’র অন্যতম শীর্ষ নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ বেশ কয়েকজন পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা এবং পুলিশের সাবেক তিনজন আইজিপি’র নাম প্রকাশ্যে আসে।
২০১৮ সালে ১০ অক্টোবর, ২০০৪ সালে ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। মোট ৪৯ জন আসামীর মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক সাংসদ কায়কোবাদসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ৩১ জন কারাগারে রয়েছে। এছাড়া তারেক রহমান এবং হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জনকে মামলার নথিতে পলাতক হিসেবে দেখানো হয়েছে। বাকি তিনজনের অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় গ্রেনেড হামলা মামলা থেকে তাদের বাদ দেয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করে দেশে অস্থিতিশীল একটা পরিস্থিতি তৈরি এবং রাষ্ট্রকাঠামোকে দুর্বল করে তোলাই ছিল এ হামলার মুখ্য উদ্দেশ্য। এর পেছনে যে, অন্য বিভিন্ন শক্তির নানান উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা ছিল তা পরবর্তী বিভিন্ন তদন্তে দিবালোকের মতই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলেই মনে করে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা।
ছবিসূত্র: GETTY IMAGES
বাঙালীয়ানা/এসএল