‘ভাব এক্কে ভাব, ভাব দুগুণে ধোঁয়া
তিন ভাবে ডিসপেপসিয়া ঢেঁকুর উঠবে চোঁয়া’
এমন নামতা শুনেছেন আগে? কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা আর রসবোধের এমন মিশ্রণ কে করতে পারে? ঠিক ধরেছেন। তিনি ছড়ার রাজা সুকুমার রায়। যার রচনা কখনো পুরনো হয় না, কখনো আবেদন হারায় না। বাঙালী ঘরের সন্তান মানেই শৈশবে হাত নেড়ে নেড়ে বলবে,
‘ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না
সত্যি বলছি কুস্তি ক’রে তোমার সঙ্গে পারব না।
মনটা আমার বড্ড নরম, হাড়ে আমার রাগটি নেই,
তোমায় আমি চিবিয়ে খাব, এমন আমার সাধ্যি নেই!’
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, ছড়াকার ও নাট্যকার হিসেবে সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত নামটি হল সুকুমার রায়। সাহিত্যানুরাগী পারিবারিক পরিবেশ সুকুমারের সাহিত্য প্রতিভা বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল।
‘ঠাস্ ঠাস্ দ্রুম্ দ্রাম্, শুনে লাগে খটকা-
ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পটকা!
শাঁই শাঁই পন্ পন্ ভয়ে কান্ বন্ধ-
ওই বুঝি ছুটে যায় সে-ফুলের গন্ধ?’
সুকুমার রায়ের শৈশব ও পারিবারিক পরিবেশ বুঝতে হলে তার পিতা, বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী উপেন্দ্রকিশোর রায়কে জানতে হবে। উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন একাধারে শিশু-সাহিত্যিক, মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ, চিত্রশিল্পী ও সংগীতজ্ঞ। তার হাত ধরে ছোটদের মাসিক পত্রিকা ‘সন্দেশে’র আবির্ভাব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সূত্র ধরে বাল্যকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুকুমারের পরিচয়। বিশ্বকবি সুকুমারকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, দীর্ঘদিন সুকুমার তার সান্নিধ্য পেয়েছেন। এছাড়াও তাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মত গুণীজনেরা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের শিশু চরিত্রের নামানুসারে সুকুমারের ডাক নাম হয় ‘তাতা’।

সুকুমার রায় (সংগৃহীত ছবি)
ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশ সুকুমারের জ্ঞানোন্মেষ ঘটার পথ প্রশস্ত করে।
‘হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)
হয়ে গেল “হাঁসজারু” কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে- বাহবা কি ফুর্তি!
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।’
তিনি গান গাইতেন, নাটক করতেন, কবিতা লিখতেন, মুখে মুখে তৈরি করে ফেলতেন নানা ধরণের ছড়া। পড়াশোনায় মেধাবী সুকুমার স্বাভাবিক ভাবেই ভাইবোনদের নেতৃত্ব দিতেন, গান ও মজাদার ছড়ায় বাড়ির সবাইকে মাতিয়ে। তার খুড়তুতো বোন লীলা মজুমদার লিখেছেন, বড়দা’র (সুকুমার) চেহারার মধ্যে কি যেন একটা ছিল, যা তার সর্বাঙ্গ থেকে আলোর মত ঝরে পড়ত।
‘এমন যদি হতো
ইচ্ছে হলে আমি হতাম
প্রজাপতির মতো
নানান রঙের ফুলের পরে
বসে যেতাম চুপটি করে
খেয়াল মতো নানান ফুলের
সুবাস নিতাম কতো।’
১৮৯৫ সালে মাত্র আট বছর বয়সে সুকুমারের প্রথম কবিতা ‘নদী’ প্রকাশিত হয় ‘মুকুল’ পত্রিকায়। এরপর ন’বছর বয়সে ‘টিক্ টিক্ টং’ লেখেন ইংরেজি শিশুপাঠ ‘Hickory,Dickory,Dock’-এর অনুবাদ হিসাবে।
নদী
হে পর্বত, যত নদী করি নিরীক্ষণ,
তোমাতেই করে তারা জনম গ্রহণ।
ছোট বড় ঢেউ সব তাদের উপরে,
কল্কল্ শব্দ করি সদা ক্রীড়া করে,
সেই নদী বেঁকে চুরে যায় দেশে দেশে,
সাগরেতে পড়ে গিয়া সকলের শেষে।
পথে যেতে যেতে নদী দেখে কত শোভা,
কি সুন্দর সেই সব কিবা মনোলোভা।
কোথাও কোকিলে দেখে বসি সাথী সনে,
কি সুন্দর কুহু গান গায় নিজ মনে।
কোথাও ময়ূরে দেখে পাখা প্রসারিয়া
বনধারে দলে দলে আছে দাঁড়াইয়া!
নদীতীরে কত লোক শ্রান্তি নাশ করে,
কত শত পক্ষী আসি তথায় বিচরে।
দেখিতে দেখিতে নদী মহাবেগে ধায়,
কভুও সে পশ্চাতেতে ফিরে নাহি চায়।
১৯০৪ সালের নভেম্বর মাসে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ‘বয়েজ ওন পেপার’-এর দ্বারা শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রী হিসাবে পুরস্কৃত হন তিনি। এরপর ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বি.এস.সি (অনার্স) পাশ করেন কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে এবং তারপরেই প্রতিষ্ঠা করেন ‘ননসেন্স ক্লাব’ ১৯০৭-এ। এর মুখপাত্র ছিল ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ নামের একটি পত্রিকা। এই সময় থেকেই তাঁর আবোল-তাবোল ছড়ার আত্মপ্রকাশ। ননসেন্স ক্লাবের সভ্যদের নিয়ে অভিনয় করার জন্য দু’টি নাটক লিখেছিলেন সুকুমার– ‘ঝালাপালা’ ও ‘লক্ষণের শক্তিশেল’। ঝালাপালা’র কেষ্টার কথা মনে আছে? সেই ‘সলিলং বারি অর্থাৎ জল’?
পণ্ডিত: এতক্ষণে পড়তে এসেছিস ?
কেষ্টা:‘ আই গো আপ্ , ইউ গো ডাউন ‘- সেই কখন এসেছি – এতক্ষন কত পড়ে ফেললাম ! ‘ আই গো আপ্ , ইউ গো ডাউন্ ‘-
পণ্ডিত: যা, যা, আমি যেন আর দেখিনি, কাল আসিস্ নি কেন ?
কেষ্টা: কালকে, কাল কি করে আসব ? ঝড় বৃষ্টি বজ্রাঘাত-
পণ্ডিত: ঝড় বৃষ্টি কিরে ? কাল ত দিব্যি পরিষ্কার ছিল !
কেষ্টা: আজ্ঞে, শুক্কুরবারের আকাশ, কিচ্ছু বিশ্বাস নেই কখন কি হয়ে পড়ে !
পণ্ডিত: বটে ! তোর বাড়ি কদ্দুর ?
কেষ্টা: আজ্ঞে, ঐ তালতলায়- ‘আই গো আপ্ , ইউ গো ডাউন্ –‘ মানে কি?
পণ্ডিত: ‘আই‘- ‘আই‘ কিনা চক্ষুঃ, ‘গো- গয়ে ওকারে গো গৌ গাবৌ গাবঃ, ইত্যমরঃ ‘আপ্‘ কিনা আপঃ সলিলং বারি অর্থাৎ জল- গরুর চক্ষে জল- অর্থাৎ কিনা গরু কাঁদিতেছে- কেন কাঁদিতেছে- না উই গো ডাউন‘, কিনা ‘উই‘ অর্থাৎ যাকে বলে উইপোকা- ‘গো ডাউন‘, অর্থাৎ গুদোমখানা- গুদোমঘরে উই ধরে আর কিছু রাখলে না- তাই না দেখে, ‘আই গো আপ্ ‘ গরু কেবলি কান্দিতেছে।
সুকুমার রায়ের সঙ্গে সুপ্রভা দাশের বিয়ে হয় ১৯১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমার রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। কিন্তু কবি চিঠি দিয়ে জানান শিলাইদহে জমিদারীর কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন।

সুকুমার রায় ও সুপ্রভা দাশ
সুকুমার রায় ও সুপ্রভা দাশের একমাত্র পুত্র সত্যজিতের জন্ম হয় ১৯২১-এর ২ মে তারিখে। সে বছরই নিতান্তই শিশু চার মাসের সত্যজিৎ বাবা ও মায়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে যান। এ সময়ে সুপ্রভা বেশ কিছু গান শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে।
‘রামগরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা,
হাসির কথা শুনলে বলে,
“হাসব না-না, না-না!”
সদাই মরে ত্রাসে— ওই বুঝি কেউ হাসে!
এক চোখে তাই মিটমিটিয়ে
তাকায় আশে পাশে’
১৯১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর ‘সন্দেশ’ সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন সুকুমার। ১৯২৩ সালে তার অকাল মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মোট তেত্রিশটি সংখ্যা সম্পাদনা করে গেছেন উপেন্দ্রকিশোর। সুকুমারের পর পরের ভাই সুবিনয় রায়ের সম্পাদনায় ‘সন্দেশ’ চলেছিল দু’বছর। সব মিলিয়ে প্রথম পর্যায়ের ‘সন্দেশ’ বারো বছরের সামান্য বেশি চলেছিল। বারো বছরের মধ্যে সুকুমার সম্পাদক ছিলেন আট বছর। ‘সন্দেশ’ তাই সুকুমারময়।

উপেন্দ্রকিশোর রায়
‘দ্রিঘাংচু’ নামে সুকুমারের একটি গল্প বেরোয় ‘সন্দেশে’র ১৩২৩-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায়। সত্যজিৎ রায় লিখেছেন, ‘সুকুমার সম্পাদক হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই একটি ছোট গল্প সন্দেশে বেরোয় যেটি আমার মতে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। গল্পের নাম ‘দ্রিঘাংচু’। এক রাজসভায় অকস্মাৎ একটি দাঁড়কাক প্রবেশ করে গম্ভীর কণ্ঠে ‘কঃ’ শব্দটি উচ্চারণ করার ফলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তাই নিয়েই গল্প।
গল্পের শেষে রাজামশাইকে রাজপ্রাসাদের ছাতে একটি দাঁড়কাকের সামনে দাঁড়িয়ে চার লাইনের একটি মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়।
মন্ত্রটি হ’ল –
‘হলদে সবুজ ওরাং ওটাং
ইঁট পাটকেল চিৎ পটাং
গন্ধ গোকুল হিজিবিজি
নো অ্যাডমিশন ভেরি বিজি…’
‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক হবার আগেই সুকুমারের কিছু প্রবন্ধ ও দুটি নাটক-‘শব্দকল্পদ্রুম’ ও ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’ প্রকাশিত হয়েছে। ‘প্রবাসী’-তে লেখা এসব রচনা ঠিক ছোটদের জন্য নয়। ‘নাটক দুটি প্রধানত আইডিয়ার আধার।

সত্যজিতের সন্দেশ
১৯২১ সালে সুকুমার রায় আক্রান্ত হন তখন অবধি দুরারোগ্য কালা জ্বরে। মৃত্যুর প্রহর গুণতে গুণতেই শয্যাশায়ী অবস্থায় সুকুমার তাঁর অদম্য মানসিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে লিখেছিলেন ‘আবোল তাবোল’ বা ‘পাগলা দাশু’-র মত তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টিগুলো।

সুকুমার রায়ের আঁকা
‘আবোল তাবোল’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩-এর ১৯ সেপ্টেম্বর, সুকুমারের মৃত্যুর ন’দিন পর। অন্যান্য বই বেরিয়েছে অনেক পরে। ‘পাগলা দাশু’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৪০-এর ২২ নভেম্বর, এম. সি. সরকার এন্ড সন্স থেকে। সিগনেট প্রেস থেকে ‘বহুরূপী’র প্রকাশ ১৯৪৪ সালে। ‘পাগলা দাশু’ প্রকাশের সময় সুপ্রভা রায় রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন একটি ‘ভূমিকা’ লিখে দিতে। কালিম্পঙ থেকে ১৯৪০-এর ১ জুন তারিখে লেখা ‘ভূমিকা’টি ছিল,
‘সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়। তাঁর সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছন্দ গতি, তার ভাব সমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে। তাঁর স্বভাবে মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল, সেই জন্যই তিনি তাঁর বৈপরীত্য এমন খেলাচ্ছলে দেখাতে পেরেছিলেন। বঙ্গসাহিত্যে ব্যঙ্গ রসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আরো কয়েকটি দেখা গিয়েছে কিন্তু সুকুমারের অজস্র হাস্যোচ্ছ্বাসের বিশেষত্ব তাঁর প্রতিভার যে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে তার ঠিক সমশ্রেণীর রচনা দেখা যায় না। তাঁর এই বিশুদ্ধ হাসির দানের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অকাল মৃত্যুর সকরুণতা পাঠকদের মনে চিরকালের জন্য জড়িত হয়ে রইল।’
এই মুদ্রণটি এখন দুষ্প্রাপ্য। পরবর্তী সিগনেট প্রেসের সংস্করণে রবীন্দ্রনাথের ‘ভূমিকা’টি বর্জিত হয়েছে।
অসুস্থ থাকাকালে রবি ঠাকুর প্রায়ই তাঁর যুবক বন্ধু সুকুমারকে দেখতে যেতেন। একবার প্রায় শেষদিকে সুকুমার আবদার করেছিলেন কবি কন্ঠে গান শোনার, রবীন্দ্রনাথ সে আবদার রেখেছিলেন। বন্ধুর শয্যাপাশে বসে শুনিয়েছিলেন একের পর এক গান। সুকুমার রায় সেই প্রশান্ত মন নিয়েই ১৯২৩ সালে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে অন্যলোকে পাড়ি জমান।
বাঙালীয়ানা/এজে/এসএল