ঘোরঘুম ভাঙুক এবার । লুৎফুল হোসেন

Comments
প্রকৃত সৃষ্টিশীল মানুষ ধ্যানস্থ থাকতে চায় সৃষ্টিশীলতায়, নির্মাণে। দিনে দিনে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর লোক কমে আসছে। যুগ এখন বনের মোষ ধরে এনে ঘরে খাওয়ার। যুগের হাওয়া যেদিকেই যাক, তবু কিছু লোক সৃষ্টিশীলতার পাগলামিতে মেতেই থাকে। এই রকম পাগলের একটা ছোটোখাটো সংখ্যা সম্ভবত সমাজের স্বার্থে অনেকটা দরকারি। সত্য বলার, মানুষের জন্য ভাবার ও করার এই মানুষ যাঁরা, তাঁদেরই একাংশ কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকর, চিত্রগ্রাহক, নাট্যকার, নাট্যকর্মী, গীতিকার, চিন্তক এমন আরো অনেক সৃষ্টিশীল মানুষেরা। এঁরা যার যার অবস্থান থেকে মূলত মানুষের কথা বলেন, ভালোর কথা বলেন, আলোর কথা বলেন, সত্য ও সঠিকের দিক নির্দেশনা বা ইঙ্গিত দেন। ইনারা শুদ্ধ বিবেচনায় নমস্য।
আজকাল সময় বদলেছে। শিক্ষক হওয়ার চেয়ে এক অর্থে কালোবাজারি হতেই উদগ্রীব অধিকাংশ মানুষ। সমাজটাই যে এমন চিন্তা-চেতনার স্রোতে আবর্তিত। অর্থ-কড়ি বা অর্জনের মাপেই আজ সমাজ সম্মান করে মানুষকে, ত্যাগের পাল্লায় মেপে নয়। তবে এই সমাজটা আমরাই গড়ে তুলেছি দিনে দিনে। ভিনগ্রহের মানুষ এসে করে দিয়ে যায়নি।
নিরেট-নিখাদ নির্মাতা যিনি, তিনি পুরষ্কার কিংবা বাহবার তেষ্টায় নির্মাণটি করেন না। তিনি নির্মাণ করেন অন্তর্গত তাগিদে ও যাতনায়। তাঁর সৃষ্টি মানুষের মন ভরাবে, ভালো লাগবে মানুষের, ভালোবাসবে মানুষ তাঁর সৃষ্টিকে; মানুষের অন্তরে সেই আলোড়ন তুলতে বা সেই ভালোলাগা-ভালোবাসায় স্নাত হবার তেষ্টাটুকুই থাকে তাঁর খুব জোর।
প্রতিযোগিতাহীন এমন সৃষ্টিশীলতাকেও আমরা ঠেলে দিয়েছি পুরস্কার-পদকের স্বীকৃতি তকমায়। এক অর্থে বিষয়টা ভালো, এতে করে গুণীজনকে সম্মাননা জানাবার একটা রীতি চর্চিত হয়, পরবর্তী প্রজন্মে এরকম ত্যাগী ভাবনায় প্রাণিত হয়ে জাগতিক অর্জনের দিকে না তাকিয়ে সৃষ্টিশীলতায় বুঁদ হবার একটা প্রেরণা জুটানো যায় পুরস্কার-পদক দিয়ে। তবে তা যদি নিখাদ ও নিরপেক্ষ হয়। হ্যাঁ, নিরপেক্ষ শব্দটি অনেক ক্ষেত্রেই বা প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আপেক্ষিক। ওইটুকু সকলেই কমবেশি বুঝতে পারে এবং মেনে নিতে পারে অকপটে। কিন্তু প্রক্রিয়াগত কারণে এই পুরস্কার-পদক প্রশ্নবিদ্ধ পন্থায় চর্চিত হলে প্রেক্ষিত পালটে যায় অনবধানে।
এমনকি অনবধানের বিপরীতে পদ্ধতিটা আরো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়, যদি নির্মাতাজন বা সৃষ্টিশীল মানুষটাকেই আবেদন করতে হয় কোনো পুরস্কার-পদকের জন্য। আয়োজনটা গোড়াতেই শতভাগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে তখন। সম্মান সম্মাননা চেয়ে নেবার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় কখন, কোন বিবেচনায়, কার কাছে? সম্মান শ্রদ্ধা কিংবা পুরস্কারের স্বীকৃতি চেয়ে নেয়ার সংস্কৃতিটা কখন গ্রাহ্য হয়, কখন চর্চিত হয়, কার কাছে হয়? তাতে সম্মান জানাবার প্রক্রিয়াটা কতখানি সম্মানের থাকে আর? এইটুকু বুঝবার মতো, উপলব্ধি করবার মতো মনন যদি হারিয়ে যায় সমাজ-সমষ্টি থেকে তখন প্রকৃত সম্মান প্রাপ্য লোকের তা পেয়ে যাওয়া অনেকটা দৈব ঘটনার ফ্রেমে কিংনা গণক টিয়া পাখির ঠোঁটে বন্দি হয়ে পড়ে। আর যদি মাঝেসাঝে দুয়েকজন প্রকৃত প্রাপ্যজন পেয়েও যান সেই সম্মান-সম্মাননা-পুরস্কার তো ওই গুণীজনের চেয়ে সম্মান-সম্মাননা-পুরস্কারটিই সম্মানিত হয়ে ওঠে।
ডিনামাইট আর যুদ্ধাস্ত্রের রক্তরঞ্জিত নোবেল পুরস্কারের মতো কালিমা লেগে যায় তখন ওইসব পুরস্কার-সম্মাননার গায়ে। তথাপি আজ নোবেল বিশ্বজুড়ে সর্বোচ্চ সম্মাননার একটি পুরস্কার। হ্যাঁ, পুরস্কারের বিষয়টা প্রদান প্রক্রিয়ার জন্য আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপিত হবার বিষয় নয়। দরকার শুধু এই প্রক্রিয়াটাকে তার যথাযথ সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতার অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। এটাকে বানিজ্যিক উপকরণ কিংবা ইচ্ছে খুশিমতো কেনাবেচার বৃত্ত থেকে বাইরে নিয়ে আসতে সক্রিয় হতে হবে আমাদের বোদ্ধাজনদের, সমাজে চালকের আসনে বসা মানুষদের। সৃষ্টিসেরা প্রাণীর হাজার বছরের সভ্যতার স্মারকসম সম্যক চর্চা ও রীতিতে ফিরে আসুক সকল পুরস্কার-সম্মাননার প্রক্রিয়া। রাষ্ট্র সেই প্রক্রিয়াকে ঋজু ও সবল করে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে অগ্রণী হোক এটাই আমাদের সকলের কাম্য। সমাজের গায়ে ধরা ঘুণ-গ্যাংগ্রিন সারাতে করণীয়গুলোর মধ্যে এটা সম্ভবত প্রথম সারির একটা কর্তব্য বলেই বিবেচিত হওয়া উচিত।
তবে অমন ঋদ্ধ রীতি ফিরে পাওয়ার দিনের অপেক্ষায় ঠায় বসে না থেকে সর্বস্তরে সবাইকে এর পেছনে ক্রিয়াশীল হতে হবে। প্রয়োজনে যোগ্য ব্যক্তিকে এমন পুরস্কার-সম্মাননা বর্জন করতে হবে আপামরের ও চলমান চর্চার ঘোরঘুম ভাঙাতে।
সমাজ-বিবেক গুণীজনেরা আপামরের ইচ্ছেডানায় উড়বার সাধ্য দিক। আমাদের ঘোরঘুম ভাঙুক দ্রুত।
২৫ মার্চ ২০২২

লেখক:
Lutful Hossain
লুৎফুল হোসেন, কথাসাহিত্যিক

*এই বিভাগে প্রকাশিত লেখার মতামত ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট