চলে গেলেন মুক্তিসংগ্রামের আরেক মহীরুহ মোজাফফর আহমদ

Comments
মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
গুরুতর অসুস্থ অধ্যাপক মোজাফফর রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। শুক্রবার, ২৩ আগষ্ট, ২০১৯, সন্ধ্যা ৭টা ৪৯ মিনিটে তিনি মারা যান।

উপমহাদেশে প্রগতিশীল রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ও বাংলাদেশের বাম ধারার রাজনীতির অন্যতম পথিকৃৎ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ফুসফুসের সংক্রমণসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন এবং ১৪ আগষ্ট, ২০১৯, হাসপাতালে ভর্তি হন। তার বয়স হয়েছে ৯৭ বছর।

শনিবার, ২৪ আগষ্ট, ২০১৯ সকাল ১১টায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মরদেহ জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এবং সেখান থেকে ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেটে দলীয় কার্যালয়ের সামনে নেওয়া হবে।

সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বেলা ১২টায় মোজাফফর আহমেদের মরদেহ নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

যোহর নামজের পর বায়তুল মোকাররমে তার জানাজা হবে। সেখান থেকে অধ্যাপক মোজাফফরের মরদেহ নেওয়া হবে কুমিল্লায় তার নিজের এলাকায়। রোববার সকালে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

Muzaffar Ahmed

মোজাফফর আহমদ

মোজাফফর আহমদ ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল, কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আলহাজ কেয়াম উদ্দিন ভূঁইয়া স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মায়ের নাম আফজারুন্নেছা। মোজাফফর আহমদ হোসেনতলা স্কুল, জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশন, দেবীদ্বার রেয়াজউদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও ভিক্টোরিয়া কলেজে পর্যায়ক্রমে পড়ালেখা করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং ইউনেসকোর ডিপ্লোমা লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কৃতী ছাত্র দীর্ঘদিন বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকতা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন।

মোজাফফর আহমদের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ১৯৩৭ সালে। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৫৪ সালে চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে দেবীদ্বার আসনে মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রীকে পরাজিত করেন। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করে। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। তিনি আত্মগোপনে থেকে আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। আট বছর আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৬৬ সালে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন। তিনি অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন। ষাটের দশকের শেষ ভাগে বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থি এই দুই ধারার মতবিরোধ থেকে ন্যাপ দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। মাওলানা ভাসানী থেকে আলাদা হয়ে যান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাপ চীনপন্থি আর ন্যাপ মোজাফফর হয় মস্কোপন্থি।

১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। তিনি আইয়ুব খান আহুত রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে মূল নেতৃত্বের একজন ছিলেন তিনি। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তাজউদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী গঠন করে। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদক ছিলেন এই উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের নিজস্ব ১৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধা গঠনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়।

১৯৭৯ সালে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে ন্যাপ, সিপিবি ও প্রগতিশীল শক্তির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শুরুতে কারারুদ্ধ হন।

স্বাধীনতার পরে মন্ত্রিত্ব নিতে অস্বীকার করেন মোজাফফর আহমদ। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারও তিনি নেননি।

১৯৫২ সালের ২৪ অক্টোবর আমিনা আহমেদকে বিয়ে করেন। আর একমাত্র মেয়ে আইভির জন্ম হয় ১৯৫৫ সালে।

বাঙালীয়ানা/এসএল

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.