চিরঞ্জীব কমরেড রতন সেন হত্যার বিচার চাই

Comments

আজীবন সংগ্রামী, সর্বস্ব ত্যাগী, গরিব মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু কমরেড রতন সেনকে ১৯৯২ সালের ৩১ জুলাই খুলনা ডিসি অফিসের সামনে ঘাতকরা নির্মমভাবে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।

কমরেড রতন সেনের ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ২২ বছর কেটেছে জেল ও আত্মগোপনে। জীবনের মূল্যবান সময় যৌবনের ১৭টি বছর কেটেছে পাকিস্তানের কারাগারে। দেশ বিভাগের পর মা-বাবা, ভাইয়েরা দেশত্যাগ করলেও রতন সেন রয়ে গেছেন দেশে নাড়ীর টানে। থেকে গেছেন মাটির টানে। জেল থেকে মুচলেকা দিয়ে অনেকে দেশত্যাগ করলেও তিনি তা করেননি।

খুলনা পার্টির নেতাকর্মীরা যখন মাওবাদের অনুসারী হয়ে দল ভেঙ্গেছে, তখন রতন সেন সে পথ অবলম্বন করেননি। জেল থেকে বের হয়ে কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে আবার পার্টির কাজ শুরু করেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় খুলনা পার্টিকে একটা মর্যাদার অবস্থানে দাঁড় করতে পেরেছিলেন।

কমরেড রতন সেনের জন্ম ১৯২৩ সালের ৩ এপ্রিল বৃহত্তর বরিশালের উজিরপুরে। পিতা নরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ছিলেন দৌলতপুর বি এল কলেজের প্রধান অফিস সহকারী। তিনি সপরিবারে কলেজের কোয়ার্টারে থাকতেন। সে সুবাদে রতন সেনের শৈশব-কৈশোর কেটেছে দৌলতপুরে। তিনি দৌলতপুর মহসীন স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে দৌলতপুর একাডেমিতে (বি এল কলেজ) ভর্তি হন। বি এল কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বিএ অনার্স (ইংরেজি)-তে ভর্তি হন। ছাত্র আন্দোলনের কারণে গ্রেফতার হওয়ায় তিনি জেলে বসে ১৯৪২ সালে ডিস্টিংশনসহ বি এ পাস করেন।

রতন সেন রাজনীতিতে প্রবেশ করেন বড়ভাই বিপ্লবী মোহিত লাল সেনগুপ্তের হাত ধরে। তিনি ছিলেন যশোর-খুলনা যুব সংঘের নেতৃস্থানীয় কর্মী। সন্ত্রাসবাদের পথে ইংরেজদের বিতাড়িত করার নীতিতে বিশ্বাসী এ সংগঠনটি গড়ে তুলেছিলেন ভবানী সেন, প্রমথ ভৌমিক, শচীন বোস, সন্তোষ ঘোষ, অজিত ঘোষ, সুধীর চ্যাটার্জী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ, যাঁরা ১৯৩৭ সালে মার্কসবাদে দীক্ষা নিয়ে খুলনা অঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলেছিলেন। মহসীন স্কুলের ছাত্রাবস্থায় রতন সেন নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতিতে যোগ দেন। পরবর্তীতে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছাত্রদের সংগঠন ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হলে তিনি ফেডারেশনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। তিনি ছিলেন বি এল কলেজের অন্যতম ছাত্রনেতা।

Ratan Sen02

কমরেড রতন সেন

কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের সংস্পর্শে এসে তিনি মার্কসবাদে দীক্ষা নেন। ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। প্রথমে শ্রমিক আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৪৫ সালে পার্টির সিদ্ধান্তে বটিয়াঘাটার বয়ারভাঙ্গা বিশ্বম্ভর হাই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। উদ্দেশ্য গ্রামের কৃষকদের সংগঠিত করা। প্রতি শনিবার ১০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে তিনি খুলনা শহরে আসতেন এবং রবিবার খুলনায় থেকে পার্টি ও পার্টির পত্রিকা ‘স্বাধীনতা’র জন্য কাজ করে সোমবার সকালে গিয়ে স্কুলে ক্লাস করতেন। তিনি ছিলেন ‘স্বাধীনতা’র খুলনা প্রতিনিধি। বটিয়াঘাটায় কৃষকদের নিয়ে তেভাগা আন্দোলন ও জমিদারীপ্রথা উচ্ছেদের আন্দোলন গড়ে তোলেন।

১৯৪৬ সালে খুলনা জেলার মৌভোগে প্রাদেশিক কিষাণ সভার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সারা প্রদেশ থেকে পাঁচশত প্রতিনিধি এবং প্রকাশ্য অধিবেশনে ত্রিশ হাজার কৃষক যোগ দেন। প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মোজাফফর আহমেদ, ভবানী সেন, সাজ্জাদ জহির, মনসুর হাবিুল্লাহ, গোপাল হালদার সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন সফল করতে যাঁরা সামনের কাতারে ছিলেন তারা হলেন শচীন বোস, সন্তোষ ঘোষ, অনিল ঘোষ, বিষ্ণু চ্যাটার্জী, রতন সেন প্রমুখ। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পার্টি ‘ইয়া আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখ ইনসান ভূখা হ্যায়’ স্লোগান দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম শুরু করলে পার্টির নেতা-কর্মীদের উপর নেমে আসে দমন-পীড়ন। ১৯৪৮ সালে রতন সেন খুলনার প্রখ্যাত দন্ত চিকিৎসক ডা. অতুল দাসের চেম্বার থেকে গ্রেফতার হন। ১৯৫৬ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে চলে যান রূপসার মৈশাঘুনি গ্রামে জেলসাথী কৃষকনেতা শান্তি ঘোষের বাড়িতে। এলাকাবাসীর অনুরোধে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন আজগড়া হাই স্কুলে এবং পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। অল্প দিনে এলাকার মানুষের প্রিয় মাস্টার মশাই হয়ে ওঠেন।

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে কিছু দিনের মধ্যে দৌলতপুর রেল স্টেশন থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে খুলনা রেল স্টেশনে আনা হয় এবং সেখান থেকে অত্যন্ত অমানবিকভাবে পুলিশের জিপ গাড়ির পিছনে বেঁধে টানতে টানতে খুলনা থানায় নিয়ে আসা হয়। মুক্তি পান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী। ইতোমধ্যে পার্টির নেতাকর্মীরা মাওবাদের অনুসারি হয়ে পার্টি ত্যাগ করেন। রতন সেন মাত্র ৬ জন ছাত্রনেতাকে নিয়ে কমরেড বিষ্ণু চ্যাটার্জী রূপসার খানকার বাড়িতে পার্টি গ্রুপ গঠন করেন। এ ছাত্রনেতারাই পরে খুলনা জেলা পার্টির নেতা হয়েছেন। তিনি নতুন করে খুলনা শহর, খালিশপুর, বটিয়াঘাটা, চিতলমারী, ডুমুরিয়া এলাকায় পার্টির কাজ শুরু করেন।

রতন সেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চের দিনগুলো তিনি খুলনা অঞ্চলের পার্টি কমরেডদের সংগঠিত করে ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে পাঠাতে থাকেন। ১১ এপ্রিল সহযোদ্ধা অমর কৃষকনেতা বিষ্ণু চ্যাটার্জী ঘাতক-দালালদের হাতে নিহত হওয়ার পর তিনি ভারতে চলে যান। প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাটে পানতোড়, পরে টাকী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থান করেন। আশেপাশের শরণার্থী ক্যাম্প থেকে ছাত্র, যুবকদের সংগঠিত করে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দিতেন। তাছাড়া ১৮৪৭ সালে দেশত্যাগ করা সহযোদ্ধা স্বদেশ বসু, কুমার মিত্র, কৃষ্ণ বিনোদ রায়, ধনঞ্জয় দাস প্রমুখের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন-ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ গেরিলাবাহিনী গড়ে তোলার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে পার্টির দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তিনি ছিলেন খুলনা জেলা কমিটির সম্পাদক। ১৯৭৩ সাল থেকে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। ১৯৮৯ সালে সভাপতির পদ সৃষ্টি হলে তিনি খুলনা জেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য থাকাকালে তিনি বেশকিছু দিন ঢাকায় অবস্থান করেন। সে সময় পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ, দলিল, ইস্তেহার রচনা করেন। কিন্তু বেশিদিন তাঁকে ঢাকায় ধরে রাখা যায়নি, ফিরে আসেন খুলনায়। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘ঢাকায় অনেক নেতা আছেন, প্রয়োজন গ্রামে থেকে কাজ করা’।

স্বাধীনতার পর খুলনার হাট-ঘাট-নদীখাল, খাস জমি নিয়ে অসংখ্য আন্দোলনের তিনি নেতৃত্ব দেন। এক সময় দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি চাষের নামে চলতে থাকে অত্যাচার-নিপীড়ন। শুরু হয় এলাকায় প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। তিনি পার্টি-কৃষক সমিতি-জনগণকে সংগঠিত করে শুরু করেন আন্দোলন। দাকোপ-বটিয়াঘাটা-পাইকগাছায় কিছু সাফল্য অর্জিত হয়। এ আন্দোলন দেশের বিবেকবান মানুষের নজর কাড়ে। জাতীয় সংসদে চিংড়ি চাষের নীতিমালা প্রণয়নের দাবি ওঠে। রতন সেন বলতেন, ‘চিংড়ি চাষে এ মুহূর্তে হয়তো কৃষক লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু এক সময় আসবে যখন চিংড়িও হবে না, ফসলও হবে না এবং পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে’।

আজ রতন সেনের কথা সত্য হয়েছে। মানুষ আজ লবণ পানির ঘের বিরোধী আন্দোলনে স্বোচ্চার হচ্ছে। রতন সেন ছিলেন স্বাধীনতার পর থেকে কৃষক সমিতির জেলা সভাপতি। তিনি ছিলেন একজন মার্কসবাদী পণ্ডিত। সাপ্তাহিক একতা, মুক্তির দিগন্তসহ অনেক পত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত ছাপা হতো। চিরায়ত মার্কসবাদ ছাড়া চলতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী নিয়ে তিনি পত্রিকায় লিখতেন। ইংরেজিতে প্রচণ্ড দখল ছিল তাঁর। মুক্তির দিগন্তের লেখা তিনি ইংরেজি পত্রিকা থেকে অনুবাদ করতেন। তিনি ‘প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী’ ও ‘জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন’ নামে দুটি বই অনুবাদ করেন।

ব্যক্তিজীবনে ছিলেন চিরকুমার। অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন। তাঁর সংগ্রহে অনেক বই ছিল কিন্তু রাখার কোনো সেলফ ছিল না। নিজে দু’বেলা রান্না করে খেতেন। ১০ কি.মি. পথ একসময় হেঁটে, পরবর্তীতে সাইকেল ও ভ্যানে করে পার্টি অফিসে আসতেন। ১৯৯২ সালে দেশে গড়ে ওঠে একাত্তরের ঘাতক-দালাল বিরোধী আন্দোলন। ২৬ মার্চ গোলাম আযমের বিচার করা হয় গণ-আদালতে। এ সময়ে সরকার ২৪ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে। খুলনায় ২৪ জনের বিরুদ্ধে দেয়া হয় মিথ্যা মামলা। এর মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তির মুখপত্র দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবীতে সোচ্চার খুলনার ৩৫ জন নেতৃবৃন্দকে কটাক্ষ করে ‘ভারতের দালাল’ নামে পত্রিকায় তালিকা প্রকাশ করে। রতন সেন ছিলেন সেই তালিকার শীর্ষে। এর দু’মাসের মধ্যে ১৯৯২ সালের ৩১ জুলাই খুলনা ডিসি-এসপি অফিসের সামনে কমরেড রতন সেনকে নির্মমভাবে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।

সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। হরতাল, মিছিল, সমাবেশ চলে দেশ জুড়ে। সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে কেন্দ্রীয় নেতাসহ হাজার হাজার মানুষ শেষ বিদায় জানাতে হাজির হয় রূপসা মহাশ্মশানে। জাতীয় নেতৃবৃন্দ যোগ দেন শহীদ হাদিস পার্কের বিশাল শোকসভায়। পুলিশী তদন্তে খুনীদের আদালতে স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পরিকল্পনাকারীদের অনেকে গ্রেফতার হয়। কিন্তু শেষ অবধি তিনবার রায় ঘোষণার তারিখ পরিবর্তন করার পর ক্ষমতাসীনদের প্রভাবে আসামীদের বেকসুর খালাস দেয়া হয়। ১৯৯৬ সালে সরকার পরিবর্তনের পর মামলাটি হাই কোর্টে বিচারের জন্য গ্রহণ করা হলেও অজ্ঞাত কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়। আমরা কমরেড রতন সেন হত্যা মামলা পুনঃতদন্তসহ বিচার দাবি করছি।

কমরেড রতন সেন লাল সালাম।

লেখক:
এস এ রশীদ, সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিবি

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.