১৯৬৭ সালের ৯ই অক্টোবর বলিভিয়ার লা হিগুয়েরা গ্রামের এক স্কুলবাড়িতে নিরস্ত্র অবস্থায় নয়টি গুলি করে হত্যা করা হয় বন্দী চে গেভারাকে। হেলিকপ্টারে বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে আসা হয় তার শবদেহ কাছের ভিলে গ্রান্দে শহরে। তাঁর হাত দুটি কেটে তাঁর মৃত্যুর প্রমাণ স্বরূপ পাঠিয়ে দেওয়া হয় কিউবায়। তারপর ভ্যানিশ করে দেওয়া হয় তাঁর দেহাবশেষ। মৃত্যুর তিরিশ বছর পরে তা খুঁজে পাওয়া যায় শহরের উপকন্ঠে এক গণকবরে। ইদানিংকালে (২০১৭) গুস্তাভ ভিললদো নামে সিআইএর এক গুরুত্ব পূর্ণ এজেন্ট যে বলিভিয়ার দায়িত্বে ছিল জানিয়েছে, যে প্রথমে বলিভিয়ার সৈন্যরা চেয়েছিল চে র মাথা কেটে ফেলতে। পরে তাঁর হাতদুটি কেটে ফেলা হয়। বলিভিয়ার সৈন্য বাহিনী এবং আমেরিকা সগর্বে ঘোষণা করে মৃত্যুসংবাদ। কারণ, ভিললদোর কথায় – আমরা ভেবেছিলাম এ এক বিরাট জয়, কিউবা তথা লাতিন আমেরিকার বিপ্লবের এখানেই সমাধি ঘটল। হায়, তারা ভাবে নি, চে র আদর্শ, তাঁর বিশ্বাসকে কবরে পাঠানো যাবে না, চে চিরজীবী হয়ে থাকবেন। চিলিতে, গুয়াতেমালায়, ব্রাজিলে, আর এশিয়ান, ও আফ্রিকান মানুষের মনে, সারা পৃথ্বীর বিপ্লবীদের মনে।
১৯২৮ সালের ১৪জুন এর্নেস্তো গেভারা রোসারিও, আর্জেন্টিনায় জন্ম গ্রহণ করেন। এক সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী পরিবারে বেড়ে ওঠায় শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত, অসহায়, দরিদ্রদের প্রতি এক ধরনের মমত্ব তাঁর ভিতর ছিল, অল্প বয়সেই তিনি রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠেন। ভাল ছাত্র এর্নেস্তো ভালবাসতেন খেলাধুলাও। পছন্দ ছিল সাঁতার, ফুটবল,গলফ, শুটিং, রাগবি, সাইক্লিং। কৈশোরে তাঁর আগ্রহ জন্মায় সাহিত্যে, দর্শনে, বিশেষ করে কবিতায়, সারা জীবন তিনি কবিতাকে আঁকড়ে রেখেছেন। প্রিয় কবিরা ছিলেন জন কিটস, পাবলো নেরুদা, এন্টনিও মারকাদো, ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল এবং ওয়াল্ট হুইটম্যান। এছাড়া তাঁর আগ্রহ ছিল ফটোগ্রাফিতে।
চে ১৯৪৮ সালে বুয়েনস এয়ারস বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে এক বছর বিরতি নিয়ে আলবারতো গ্রানাদো নমক এক বন্ধুকে সাথে করে মোটর সাইকেলে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমনে বেরিয়ে পড়েন যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পেরুর সান পাওলোর লেপার কলোনিতে স্বেচ্ছা সেবক হিসেবে কাজ করা| মাচু পিচ্চু যাওয়ার পথে তিনি কৃষকদের চরম দারিদ্র দেখলেন সরাসরি, কৃষকরা ধনী মহাজনদের অধীনে থেকে ছোট ছোট জমিতে কাজ করত। এই ভ্রমণ তাকে নিয়ে যায় আর্জেন্টিনা, চিলি, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, পানামা ও মিয়ামির মধ্য দিয়ে বুয়েন্স আয়রেস এর দিকে। এই প্রথম তিনি নিজে প্রত্যক্ষ ভাবে জানলেন এই বিরাট মহাদেশের মানুষকে। বুঝলেন যে দক্ষিণ আমেরিকা আলাদা আলাদা দেশের সমষ্টি নয় বরং এক অভিন্ন অস্তিত্ব, অতএব মানুষের দুর্দশা ঘোচাতে হলে দরকার এই মহাদেশ ব্যাপী গণ জাগরণ ও স্বাধীনতার পরিকল্পনা। এই ভ্রমণের কথা তিনি লিখেছেন The Motorcycle Diariesএ, বইটি নিউয়র্ক টাইমস এর বেস্ট সেলার হয়।
১৯৫৩ সালে ডাক্তার চে আবারও বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস এবং সালভাডরের উদ্দেশে বের হন। ১৯৫৪ সালের শুরুর দিকে মেক্সিকো শহরে পৌছান এবং সদর হাসপাতালে এলার্জি বিভাগে চাকরি নেন। পাশাপাশি লাতিনা সংবাদ সংস্থার চিত্রগ্রাহক হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৫৫ সালের জুন মাসে রাউল কাস্ত্রো ও পরে তার দাদা ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে চে র পরিচিতি ঘটে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ছাব্বিশে জুলাই আন্দোলন (এইদিন প্রথম মনকাডা ব্যারাক আক্রমণ হয়েছিল ১৯৫৩তে) দলের সদস্য হন, ডাক্তার হিসেবে যোগ দেন মেক্সিকো থেকে কিউবা আক্রমণে। ১৯৫৬ সালের ২৫শে নভেম্বর তারা গ্রানমা জাহাজে কিউবার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পৌছানোর সাথে সাথেই বাতিস্তার সেনাবাহিনীর আক্রমণে ৮২ জন কমরেড মারা যান অথবা বন্দী হন, মাত্র ২২জন এ যাত্রায় বেঁচে যায়। গেভারা লিখেছেন, এই অভিজানই তাঁকে ডাক্তার থেকে বিপ্লবীতে পরিনত করে।
সিয়েরা মায়েস্ত্রা পর্বতমালায় বিদ্রোহীদের ছোট একটা অংশ পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়। সেখানে তারা ২৬ শে জুলাই আন্দোলনের গেরিলা এবং স্থানীয় লোকজনদের সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। এখান থেকেই শুরু হয় গেরিলা যুদ্ধ যা অবশেষে বাতিস্তা রাজের অবসান ঘটায় ১৯৫৯র জানুয়ারির শুরুতে।
যুদ্ধচলাকালীন চে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর কম্যান্ডার হয়ে ওঠেন। তিনি গ্রেনেড তৈরির কারখানার পাশাপাশি, রুটির জন্য চুল্লি (কমিউনিটি কিচেন) এবং নিরক্ষর সঙ্গীদের জন্য স্কুল তৈরি করেন। এছাড়াও তিনি একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালাতেন, সামরিক প্রশিক্ষনের কর্মশালা এবং তথ্য সরবরাহের জন্য পত্রিকা ও রেডিও প্রচারও করতেন। গেভারা শৃঙ্খলার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন, কর্তব্যে অবহেলাকারীদের বা গুপ্তঘাতকদের তিনি নির্দ্বিধায় মৃত্যুদন্ড দিতেন। চে এমন কঠিন প্রশাসক হওয়া সত্ত্বেও সৈন্যদের শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। চে শব্দটির মানেই তাই–বন্ধু।
১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত চে কিউবার শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। এসময় তিনি কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। কিউবার অর্থনীতি, জন স্বাস্থ্য, শিক্ষা এমনকি চলচ্চিত্র নির্মাণেও তাঁর অবদান স্মরণীয়।
১৯৬৪ সালের ১১ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ১৯তম অধিবেশনে তিনি কিউবার প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। তাঁর বক্তৃতায় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জাতি বৈষম্যের দমনে জাতিসংঘের দুর্বলতার কথা বলেন। গেভারা ‘সেকেন্ড ডিক্লারেশন অব হাভানা’ নামক একটি ঘোষণার উল্লেখ করে তার বক্তৃতা শেষ করেন। তিনি বলেন যে এই ঘোষণার জন্ম হয়েছে ক্ষুধার্ত জনগন, ভূমিহীন কৃষক, বঞ্চিত শ্রমিক ও প্রগতিশীল মানুষের দ্বারা।
আরও পড়ুন: চে’র অনন্যতা ঠিক কোথায়? । আজিজুল হক
১৯৬৫ সালে গেভারা আফ্রিকা যাবার সিদ্ধান্ত নেন এবং কঙ্গোর যুদ্ধে তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবার প্রস্তাব দেন। ১৯৬৫ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি, তার সেকেন্ড কমান্ড ভিক্টর বার্ক এবং ১২ জন সহচরী নিয়ে কঙ্গোয় পৌছান। তার কিছু দিনের মধ্যে প্রায় ১০০ জন আফ্রো-কিউবান তাদের সাথে যোগ দেন। এখানে তিনি কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়া প্যাত্রিস লুমুম্বা ব্যাটেলিয়ন সংগঠনের দায়িত্ব নেন। এরপর বলিভিয়া পর্ব। দীর্ঘ দিন আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার পর জানা যায় যে চে সেখানে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। তিনি মন্টেন ড্রাই ফরেষ্ট নামক দুর্গম এলাকায় প্রশিক্ষণ চালাচ্ছিলেন বলিভিয়ার স্থানীয় সমাজতান্ত্রিকদের সাহায্যে, যাদের স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে সংগঠন তেমন কিছু ছিল না। ফলে বিপুল অসুবিধার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছিল তাঁকে। এই দিনগুলির কথা ছবির মত ধরা আছে তাঁর বলিভিয়ার ডায়েরিতে। উল্টোদিকে বলিভিয়ার সেনাবাহিনীকে সামরিক প্রশিক্ষণ ও আর্থিক মদত যোগাচ্ছিল আমেরিকা, সি আইএ প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ করছিল চে কে শেষ করে দেওয়ার জন্য। অবশেষে ৯ই অক্টোবর বলিভিয়া ঘোষণা করে যে বন্দী অবস্থায় গুলি চালিয়ে আর্জেন্টাইন ‘সন্ত্রাসবাদী’ চে কে মেরে ফেলতে পেরেছে তারা। একটি বাস্তবতা এইভাবেই লেজেন্ড হয়ে উঠল। লেখার অভ্যেস চে বজায় রেখেছেন আগাগোড়া, তাঁর বইগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘মোটর সাইকেল ডায়েরি’, ‘গেরিলা ওয়ারফেয়ার’ এবং ‘বলিভিয়ার ডায়েরি’। এছাড়া লিখেছেন অজস্র প্রবন্ধ। তার লেখা নিয়ে এখন পর্যন্ত বের হয়েছে নয় খণ্ড রচনাবলী। তাঁর লেখা পড়লে যেন তাঁর কণ্ঠস্বর শোনা যায়, এতই প্রাঞ্জল রচনা। এছাড়া রয়েছে কিছু অমূল্য ফুটেজ, ডকুমেন্টেশন ও ফিচার ফিল্ম। চে কে মুছে দেওয়া যায় নি। চে রয়ে গেলেন চির ভাস্বর।
বাঙালীয়ানা/এসসি/জেএইচ