। বিশেষ প্রতিবেদন ।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট আর্মড সার্ভিসেস কমিটির কাছে বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০১৯-এ আশঙ্কা প্রকাশ করে মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ-এর চেয়ারম্যান জোসেফ ডানফোর্ড যে প্রতিবেশী দেশগুলিকে ঋণ দিয়ে ধীরে ধীরে আগ্রাসনের পথে হাঁটা শুরু করেছে চীন। চীনের এই নীতিকে তিনি “predatory economics” বা “ছদ্মবেশী অর্থনীতি” হিসেবে উল্লেখ করেন।
চীনের আর্থিক সহযোগিতায় বালুচিস্তান প্রদেশে গোয়াদর বন্দর বানাচ্ছে পাকিস্তান। গোয়াদর বন্দর-সহ বিভিন্ন নির্মীয়মাণ প্রকল্পের জন্য চীনের কাছে থেকে ১ হাজার কোটি ডলার যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে পাকিস্তান। ডানফোর্ড জানিয়েছেন, এ ভাবেই প্রতিবেশী দেশগুলিকে ঋণের জালে ফাঁসিয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে চীন। চীনের এই ঋণনীতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পারে সে সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরেছেন ডানফোর্ড।

বালুচিস্তানের গোয়াদর বন্দর
চীনের এই “ছদ্মবেশী অর্থনীতি” সম্পর্কে বলতে গিয়ে শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপের উদাহরণও তুলে ধরেন ডানফোর্ড। সমুদ্র বন্দর বানানোর জন্য চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। পরিবর্তে ওই বন্দর ৯৯ বছর ব্যবহারের জন্য চীনকে লিজ দেয় শ্রীলঙ্কা। শুধু তাই নয়, শর্ত অনুযায়ী বন্দরের ৭০ শতাংশই আয়ত্তে থাকবে চীনের। মালদ্বীপের ক্ষেত্রে চীনের ঋণের পরিমান দেশটির জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ।
বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়াচ্ছে চীন। তাতে রাজিও হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। আর সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ এশিয়া-সহ বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও নিজেদের প্রভাব বাড়াচ্ছে চীন।
ডানফোর্ডের অভিযোগ, প্রতিবেশী দেশগুলোর সেনাবাহিনীর উপর ইতিমধ্যেই যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে চীন। দক্ষিণ চীন সাগরে যে ভাবে চীন দাপট বাড়ানোর চেষ্টা করছে তা যথেষ্ট চিন্তার বিষয়। ২০১৩ থেকে ২০১৮-র মধ্যে দক্ষিণ চীন সাগর এবং ওই অঞ্চলে বিমান ও নৌবাহিনীর তৎপরতা ১২ গুণ বাড়িয়েছে। শুধু তাই নয় ওই অঞ্চলে আত্মরক্ষামূলক এবং আক্রমণাত্মক অস্ত্রও মোতায়েনের পরিমাণও বাড়াচ্ছে। ডানফোর্ড আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, এখনই যদি চীনের এই “ছদ্মবেশী অর্থনীতি”কে গুরুত্ব সহকারে নজর দেওয়া না হয়, তা হলে এর প্রভাব আমেরিকার উপরও পড়তে পারে।

অর্থনীতিবীদ আবুল বারকাত
চীনের এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক “সহায়তা” বা “বিনিয়োগ” নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে অর্থনীতিবীদ আবুল বারকাত বাঙালীয়ানাকে বললেন, “বিভিন্ন মাপকাঠি ও সার্ভে দেখা যাচ্ছে চীন বিশ্বের ১ নম্বর অর্থনীতি। নিজের স্বার্থেই তার এ ধরনের আগ্রাসী ভূমিকা, সেটাই স্বাভাবিক। আর আমার মনে হয় এটা তারা করছে তাদের এনার্জি বা তেল/গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করবার জন্যেই কারণ জ্বালানী ক্ষেত্রে তাদের নির্ভরশীলতা রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের উপর। আর এই সরবরাহ বিশ্ব রাজনীতির আবহ পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তনশীল, তারা তা জানে।”
এ প্রসঙ্গে বারকাত প্রশ্ন করলেন, “তবে যারা এই সহায়তা নিচ্ছে তারা কি বুঝতে পারছে এই সহায়তায় তাদের নিজেদের কি লাভ/ক্ষতি হচ্ছে?”
তিনি বললেন, “চীন যখন অন্য কোন দেশের প্রজেক্টে টেন্ডার বিড করে তখন তারা অন্য বিডারদের থেকেও কম মূল্যে বিড করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যা দেখা যায় যে তারা ঐ প্রজেক্ট নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারে না, ফলে কাজের খরচ বাড়তে থাকে। তারা তখন বর্ধিত খরচের নামে আরও ঋণ সুবিধা দিয়ে সে কাজ শেষ করে। দেখা যায় যদি তারা ১০০ টাকা দিয়ে লোয়েষ্ট বিডার হয়ে থাকে কাজ শেষে প্রজেক্টের খরচ ৩০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। চীনের প্রজেক্টের ক্ষেত্রে এ এক অবধারিত ব্যাপার হয়ে দেখা দিয়েছে। এভাবেই সাম্প্রতিককালে শ্রীলঙ্কা বাধ্য হয়েছে তাদের পোর্ট চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্যে বন্ধক দিতে।”
আবুল বারকাত আরো বললেন, “চীন জানে তার জ্বালানী সরবরাহ নিশ্চিত করতে ও বিশ্বে অর্থনীতিক আধিপত্য বজায় রাখতে এভাবেই তাকে চলতে হবে কিন্তু আমার মনে হয় তারা জানে না যে এর পরিনাম ভবিষ্যতে তাদের জন্যে ভয়াবহ হবে।”
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বিবেচনায় চীন, ভারত এমন কি সৌদি আরবের সাথেও যে কোন বড় “সহায়তা” বা “বিনিয়োগ”কে অত্যন্ত সাবধানে বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করছেন আবুল বারকাত। এ ব্যাপারে তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের বিভিন্ন বৃহৎ প্রকল্পে ‘বিনিয়োগ পর্যবেক্ষণ’ করতে গুরুত্ব আরোপ করেন।
বাঙালীয়ানা/এসএল