।। আজিজুল হক ।।
The true revolutionary is guided by a great feeling of love. It is impossible to think of a genuine revolutionary lacking this quality.
If you tremble with indignation at every injustice, then you are a comrade of mine.
এই কথাগুলো যার উচ্চারণ সেই চে গুয়েভারাকে জড়িয়ে আছে একই সঙ্গে মিথ ও বাস্তব। এই দুটিকে মিলিয়ে বুঝতে পারলে তবেই ধারণা করা যায় কেন চে আজও সারা দুনিয়ার তরুণদের আইকন, বিপ্লবীদের লাইট হাউস, কেন চে আজও এত জরুরি।
চে কে নির্মম ভাবে হত্যা করার পর আমেরিকা লাগাতার তাঁর নামে কুৎসা করে গেছে, তাঁকে কাপুরুষ বলেছে, রক্তপিপাসু বলেছে, নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছে মানুষের মন থেকে তাঁকে মুছে ফেলার। অবশেষে যখন তা কিছুতেই করা গেল না, তখন তাঁকে কর্পোরেট ব্র্যান্ডিংএ পণ্য করে তুলেছে। কায়দাটা সহজ, লেনিন আগেই বলে গেছেন, প্রতিক্রিয়াশীলরা যে বিপ্লবীদের গাল না পেড়ে জলপান করে না, তাদেরই মৃত্যুর পর কুলুঙ্গিতে রেখে পুজো করে, অবশ্যই তাঁদের আদর্শগুলো মুছে ফেলে।
চে কি মার্কসিস্ট? ব্র্যান্ডওয়ালারা প্রাণপণে প্রমাণ করতে চান যে চে মার্কসবাদী নন, রোম্যান্টিক এক বিপ্লবী। সত্যি বলতে কি, চে মার্কসিস্ট হয়ে উঠেছেন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। আর তাই লাতিন আমেরিকার মূলধারার মার্কসবাদীদের প্রতিস্পর্ধী বিরোধী মার্কসীয় বিপ্লবের ধারার পুরোধা হিসেবে চের আত্মপ্রকাশ। পরে অবশ্য মূলধারার মার্কসবাদীরা চে কে আপন করে নিয়েছেন, মৃত্যুর পরে।
চে’র অনন্যতা ঠিক কোথায়? তাঁর আন্তর্জাতিকতায়, যেখানে তিনি বলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ‘রাইট টু রেবেল ইজ জাস্টিস’, বিশ্বের যে কোন জায়গায়, যে কোন দেশেই তা হোক না কেন। সত্যি বলতে কি মার্কস ও লেনিনের পরে আন্তর্জাতিকতাবাদের এমন একনিষ্ঠ প্রবক্তা আর আমরা দেখি না। এই কথাগুলো আরও স্পষ্ট হয় যখন আমরা তাঁর বিখ্যাত ত্রিদেশীয় দলিল পড়ে দেখি, যেখানে তিনি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার খেটে খাওয়া মানুষের লড়াই, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে লিখছেন। তিনি নিশ্চিত ভাবে বলেছেন, একটা জাতি যত ছোটই হোক না কেন, সে যদি তার নিজের ভাগ্য নির্ধারণ করার জন্য লড়াইয়ে নামে, তাকে কোন শক্তিই পরাজিত করতে পারে না।
চে বারবার বলেছেন, কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষয় শুরু হয় বিপ্লবের প্রতি অনাস্থা থেকে। বিপ্লবের বোধে নির্দ্বিধ আস্থাই স্থির করে দেয় সঠিক রণকৌশল। আদর্শের চর্চা ও জীবনচর্যায় চে এটা প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন, সেখানেই বাকিদের সঙ্গে তাঁর ফারাক। আর ফারাক মানুষের প্রতি তাঁর অপরিসীম নিখাদ ভালবাসায়, মানুষকে জানায়। বলিভিয়ার লড়াইয়ের দিনগুলোতেও আমরা দেখি তিনি গ্রামের চাষীদের, তাঁদের শিশুদের চিকিৎসা করছেন। বিজ্ঞানের ছাত্র ও ডাক্তার হওয়ার সুবাদে তিনি একবারেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সামাজিক ব্যাধিগুলিকে তদন্ত বা অনুসন্ধান করে সনাক্ত করেছেন, পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেগুলি নিরাকরণের। আবার অন্যদিকে শিল্পীর মত মমতায় তিনি মানুষকে ফেস ভ্যালুর নিরিখে বিচার করছেন না, খতিয়ে দেখছেন, জানছেন তাঁর মনকে। এইদিক থেকে দেখলে আমাদের ইতিহাসে যে কতিপয় সম্পূর্ণ মানুষ আমরা দেখতে পাই চে তার অন্যতম। এক সম্পূর্ণ মানুষ যাকে কোন ভৌগোলিক গন্ডিতে বাঁধা যায় না, এমন কি কোন ‘ইজমের’ গন্ডিতেও বোধহয় পুরোটা ধরা যায় না।
দুনিয়া জুড়ে যৌবন এই কারণেই চে কে প্রতীক হিসেবে, স্বপ্নের নায়ক হিসেবে আপন করে নিয়েছে। এখনও যার অন্য কোন বিকল্প নেই।
এই প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা না বললেই নয়। গেরিলা যোদ্ধা ও বিপ্লবী হিসেবে চে কে নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, কিন্তু আমরা বেশির ভাগ সময়ই ভুলে যাই ইকনমিস্ট হিসেবে চের ভূমিকা। চে যে সময় কিউবার ফিনান্স ও ব্যাংকিং মন্ত্রকের দায়িত্ব নিচ্ছেন তখন কিউবা মূলত আমেরিকার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, বলা যায় আমেরিকার বাগান। সেখানে চে তাঁর বাস্তব জ্ঞান প্রয়োগ করে না ধনতান্ত্রিক না সম্পূর্ণ টেক্সটবুক সুলভ সমাজতান্ত্রিক, এক নতুন ধারার ব্যাংকিং সিস্টেম তৈরি করলেন, যা কিউবার মেরুদন্ড, যার জোরে কিউবা আমেরিকাকে ঠেকাতে পেরেছে।
মার্কসের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে করুন, যে চিরকাল দার্শনিকরা শুধু সমাজকে ব্যাখ্যা করেছে, আর আমাদের কাজ তাকে পরিবর্তন করা। চে হলেন এই কথাটির মূর্ত প্রকাশ। তাই আজও যুগের মোড়কের মধ্যে দাঁড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথে লাল লন্ঠনের মত উজ্জ্বল দিশারী চে; রূপান্তরের, সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা যতদিন থাকবে ততদিন চে একই রকম উজ্জ্বল থাকবেন মানুষের মনে।
লেখক:
আজিজুল হক,
নকশাল নেতা, রাজনৈতিক ও সমাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রাবন্ধিক ও সুবক্তা