ছাত্ররাজনীতি, অতীত ঐতিহ্য ও চলমান বাস্তবতা । লুৎফুল হোসেন

Comments

মূল রাজনৈতিক স্রোত ও জাতীয় স্বার্থের সাথে ছাত্রদের রাজনীতি সম্পৃক্ততা এদেশকে দিয়েছে। আদি থেকে দিয়েছে। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মাতৃভাষা, স্বাধীনতা, স্বৈরাচার থেকে মুক্তি; এ দেয়ার তালিকা অনেক দীর্ঘ ও গৌরবের। এই গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র রাজনীতির অন্দরে মাস্তানির মন্ত্র প্রথম বুনেছিলো পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী। তখন এর একটা প্রেক্ষিত ছিলো। স্বাধীনতা পরবর্তীতে সেই মাস্তানির বীজ উবে যায়নি। তখনও বজায় ছিলো দাপট আর কর্তৃত্বের দখলদারিত্বের গণিত।

মানুষ মাত্রেই নিজস্ব মত থাকবে। মতের ভিন্নতা থাকবে। কেবলমাত্র বর্ণ গোত্র বা ধর্মের সংকীর্ণতায় নয়, মতাদর্শের ভিন্নতা বা সহজ কথায় যে কোনো কাজ নিয়ে ভিন্ন মত এবং পথ ও পন্থার অস্তিত্ব সভ্যতার সাথে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। সেই সাথে হাবিল কাবিলের মতো অগুন্তি ঘটনাও সভ্যতার পরতে পরতে কালো দাগ রেখে গেছে। সভ্য হওয়া মানে কখনোই অসহিষ্ণুতা নয়, বরং পরমতসহিষ্ণুতা। পাঁচটা মত থেকে সেরা মতের পথ ধরে উন্নততর পন্থায় মানুষের এগিয়ে যাওয়া। এটাই চিরায়ত।
আমাদের মাইলফলক অর্জনগুলো, সেই বায়ান্ন একাত্তর নব্বুই, সকল সময়ই আন্দোলন কর্মসূচি বা পথ পরিক্রমায় ভিন্ন মত ছিলো। সময়ে সময়ে হয়তো অনিচ্ছায় মানুষ ভুল সিদ্ধান্তটাই বেছে নিয়েছে। হয়তো সময় অতিক্রম করে পরে বুঝতে পেরেছে কখন কোন সিদ্ধান্ত ভুল বা সেরা সিদ্ধান্ত ছিলো না। কিন্তু মত চাপিয়ে দেয়ার জোরাজুরি কোনো কালেই গ্রহণযোগ্য ছিল না, উচিৎ বা উৎকৃষ্ট ছিল না।

সমস্যাটা তাই ভিন্নমতে নয়, বল প্রয়োগের পথ গ্রহণে।এর চেয়ে ভয়ঙ্কর হলো চোরাস্রোতে সচেতন রাজনৈতিক ক্রিয়াশীলতাকে ভিন্নখাতে বা ভুল পথে পরিচালিত করার প্রক্রিয়াটি। এই অপপ্রচেষ্টার শিকড়টা শক্তিমত্তায় বলীয়ান হতে শুরু করে দেশ স্বাধীন হবার প্রথম দশক থেকেই। ক্ষমতার পট পরিবর্তনে সমাজের সব অঙ্গনেই অল্পবিস্তর ধাক্কা লাগবে। এটা স্বাভাবিক। রাজনৈতিক অঙ্গনে লাগবে বেশি।

আরও পড়ুন:
ছাত্র রাজনীতি এবং ”ফার্স্ট বয়” সংস্কৃতি
ধর্মান্ধরা শোনো, অন্যের পাপ গণিবার আগে নিজের পাপ গোনো

সামরিক সরকার এই চোরাস্রোতের কাণ্ডারি। এরশাদের স্বৈরশাসন আমলে জোর ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা থাকলেও মূল রাজনৈতিক অঙ্গনে চোরাস্রোতের প্লাবন লেগেছিলো। সেই শিকড় দিনে দিনে বটবৃক্ষ হয়ে উঠেছে সকলের অনবধানেই। ফলস্রুতিতে শুরু হয়েছে শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক দখলদারিত্বের ডালপালা বেড়ে উঠবার লাগামহীন তৎপরতা। নিয়োগ, ভর্তি, টেণ্ডার, সবকিছুতে খেই হারাবার সেই শুরু।

এতোসবের পাশাপাশি গত চার দশক ধরে ক্রমাগত সুস্থ সাংগঠনিক প্রক্রিয়া থেকে সরে আসতে থাকে ছাত্র রাজনীতি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ছাড়া অন্য সব মত ও তন্ত্রের রাজনৈতিক দলই যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির চেয়ে নিজ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পেশিশক্তি ও আপাত নিরাপদ এবং আমুদে বিবেচনায় চাটুকারিত্বকেই কেবলমাত্র প্রশ্রয় দিতে থাকে। ফলত গত তিন দশকে দেশ পায়নি সত্যিকারের রাজনৈতিক নেতার দেখা, কর্মী বাহিনীও ক্রমশ হয়ে উঠতে থাকে ইতিবাচক রাজনৈতিক চর্চা বিবর্জিত কিছু সুবিধাসন্ধানীর সমষ্টি মাত্র।

রাজনৈতিক এমন পথ পরিক্রমার পাশাপাশি পুঁজিবাদ ও ব্যক্তিস্বার্থের চরম উত্থান মানুষকে ক্রমশ করে তুলতে থাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও স্বার্থান্ধ। নব্বুইয়ের গণআন্দোলনের সময়ে একজোট হওয়া ছাত্র সংগঠনগুলোর ক্রিয়াকাণ্ড ছিল শেষ ইতিবাচক ক্রিয়াশীলতা।

পুঁজি ও প্রযুক্তির বিকাশ মানুষের সহনশীলতা কমিয়ে একদিকে যেমন প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলতে থাকে, অন্যদিকে তৈরি করতে থাকে সংঘাতমুখি ও প্রতিহিংসা পরায়ন সহিংস মানসিকতা।

বাঙ্গালী এমনিতেই আবেগপ্রবণ জাতি। তার উপর ঘটমান মনস্তাত্ত্বিক পরবর্তনের পিঠে বাস্তবতা বিবর্জিত ফিল্মি ফ্যান্টাসির প্রভাব বাড়তেই থাকে মানুষের দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপে।

পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ উবে যাওয়ার নজির ছাপ ফেলতে থাকে শিশুকিশোরদের শিক্ষাঙ্গনেও। ছোট ছোট বাচ্চাদের আচরণে যুক্ত হয় সহপাঠী এমন কি শিক্ষকদের বুলিং (গালমন্দ) করা। কারণে অকারণে এইসব করবার চর্চাই আজ আমাদের দিয়েছে কিশোর গ্যাঙ এর ভয়াবহ অস্তিত্ব। জ্ঞানীকে ও গুরুজনকে শ্রদ্ধার বদলে সমাজে চালু হয়েছে অর্থ প্রতিপত্তি ও পেশি শক্তিকে শ্রদ্ধা করা। বড়দের এই চর্চা যখন নৈমিত্তিক তখন ছোটদের শিখবার সুযোগটা থাকে কোথায়!

পুঁজিবাদের ইঁদুর দৌড়ে নেশাগ্রস্ত মানুষের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটবার লক্ষ্যে নৈতিকতা বিবর্জিত হয়ে জিতে যাবার চলমান সামাজিক প্রক্রিয়াকে জেনে পাশ্চাত্যে মূল্যবোধের ভিত্তি শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংযত সংহত রাখবার সচেতন পন্থাটি যত্নের সাথে নিশ্চিত করা হলেও আমরা তার ধার ধারিনি। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাই আজ বিশ্বমানের তালিকায় তলানীতে চলে গেছে। যেখানে দূর প্রাচ্যের শিক্ষায় পশ্চাদপদ দেশগুলোতেও আজ বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে গণ্ডায় গণ্ডায়।

কারিকুলাম ও গবেষণা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই সংশ্লিষ্ট কারো, কিন্তু পদ পদোন্নতি নিয়োগ কর্তৃত্ব এইসব নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনগুলো। শিক্ষকরাও যখন এই পথে হাটছেন তখন ছাত্ররা যাবে কোন পথে! (যাঁরা আজও সত্যিকারের শিক্ষক হিসেবে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন, সংখ্যায় তাঁরা কম হলেও আছেন। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই এই সত্য উচ্চারণ করলাম।)

যোগ্য কর্মীকে সুযোগ না দিয়ে পক্ষপাত ও অনুসারী চাটুকার বা পেশিকে সুযোগ ও নেতৃত্বের সুবিধা, ভাগ বা উত্তরণের পথ নির্মাণ করে যাচ্ছে ছাত্র রাজনীতিও। মূলস্রোত ঠেলে বিপরীত, সত্য ও সঠিক পথে হাটবার শক্তি ছাত্র রাজনীতিকে জোগান দেয়নি সমাজের কোনো অংশই। ক্রমাগত উলটোপথে পিছলেই গেছে তাই ছাত্র রাজনীতির গতিপথ।

সবল আর দুর্বলের গল্প মানব সভ্যতার বা পৃথিবী সৃষ্টির সমান বয়সী। কিন্তু তফাৎ তৈরি হচ্ছে দিনে দিনে সহিংসতার মাত্রায়। সেই সাথে শঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে নৃশংস ঘটনায় মানুষের নির্বিকারত্বে। ইভ টিজিং, খুন, ধর্ষণ, রাজনৈতিক পেশি শক্তির দাপটে দখলবাজি চাঁদাবাজি গুম খুন হয়ে উঠেছে দৈনন্দিন বাজার দরের মতোন স্বাভাবিক ও রুটিন খবর। বছরের পর বছর ধরে এসবের বিচারহীনতা এক অর্থে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে সকল অনাচার ও অনৈতিকতাকে। বিচার ও শাস্তির নজির যদি জবাবদিহিতার কিছুমাত্র চিহ্নও বজায় রাখতে পারতো আমাদেরকে ধারাবাহিক ভাবে একের পর এক হত্যা ধর্ষণের ঘটনা দেখে যেতে হতো না।

আবরার হত্যা বছরের পর বছর ধরে চলমান অব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতা থেকে ফায়দা নেয়া অগণিত অপরাধগুলো থেকে একটা ছাড়া আর কিছুই না। এর জের ধরে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা মানে চোরের ভয়ে মাটিতে ভাত খাওয়ার মতো একটা কিছুই। এতে করে শুদ্ধি হবে না। সমাধান হবে না। সমাধান চাইলে প্রতিটি অনাকাঙ্ক্ষিত অপকর্মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। করতে হবে দ্রুত এবং একের পর এক সকল অপ ঘটনারই। তাহলেই সামাজিক ও সাংগঠনিক চাকা উলটা পথ থেকে সঠিক পথে চলতে শুরু করার সুযোগ আছে। তবে হ্যাঁ, পরিস্থিতি সামাল দেয়া ও শুদ্ধিকরণের লক্ষ্যে সাময়িক ভাবে এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে, কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় নয়।

অতীত ঐতিহ্যের শিকড় কেটে ও বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে বা এড়িয়ে গিয়ে কখনোই প্রকৃত সমাধান আসতে পারে না। সমস্যা তো ছাত্র রাজনীতি নয়, সমস্যা এই শিরোনামের ছত্রছায়ায় চলমান অব্যবস্থার মদদে ঘটমান অপরাধের চর্চা। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করলে কি কিশোর গ্যাঙ বা দল পাকিয়ে কর্তৃত্ববাজি ও বল প্রয়োগের সংস্কৃতি রোধ করা সম্ভব হবে! সম্ভব যুক্তি ও বিবেচনাবোধ এবং পরমতসহিষ্ণুতা বাড়ানোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সম্ভব অপরাধী যে-ই হোক, সমাজের সকল স্তরে দ্রুততম সময়ে তার যথাযথ সাজা নিশ্চিত করে জবাবদিহিতা ও আইনের প্রতি, সত্যের প্রতি, সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল হতে বাধ্য করার মাধ্যমে।

১২ অক্টোবর ২০১৯

লেখক:
লুৎফুল হোসেন, কথাসাহিত্যিক
Lutful Hossain
*এই বিভাগে প্রকাশিত লেখার মতামত ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.